দূতাবাসের রিপোর্ট

১ বছরে সৌদি থেকে ফিরেছেন ২০,০০০ নারী কর্মী

১ বছরে সৌদি থেকে ফিরেছেন ২০,০০০ নারী কর্মী

নির্যাতন-যন্ত্রণা আর কাজের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পেরে গত এক বছরে প্রায় ২০ হাজার নারী কর্মী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন! এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার ফিরেছেন দূতাবাসের মাধ্যমে। বাকীরা নিজে নিজেই, কফিল এবং অন্যদের সহায়তায়।ঢাকায় পাঠানো রিয়াদস্থ বাংলাদেশের দূতাবাসের রিপোর্টে এমনটাই জানানো হয়েছে।

সৌদি আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদূত মো. নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন- গত এক বছরে প্রায় লাখ খানেক বাংলাদেশী নারী সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে গেছেন। এর মধ্যে ২০ শতাংশের মত নানা কারণে দেশে ফিরেছেন।

উপ-রাষ্ট্রদূত মনে করেন, কেবল গৃহকর্তা বা তার পরিবারের সদস্যদের অত্যাচারই এর একমাত্র কারণ নয়। ঢাকায় যেমনটা ঢালাও প্রচার রয়েছে যে অসহ্য নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে নারী গৃহকর্মীরা দলে দলে দেশে ফিরছেন- উপ-রাষ্ট্রদূত এর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, অত্যাচারের ঘটনাগুলো অস্বীকার করার সূযোগ নেই। তবে কর্মীদের বড় অংশই ফিরে গেছেন কাজ কঠিন হওয়া, হোম সিকনেস এবং তাদেরকে দেয়া পূর্বধারণার সঙ্গে কাজের বাস্তবতার মিল না পাওয়ার হতাশ থেকে।

নির্যাতনের প্রতিটি কেস দূতাবাস নোটে নিচ্ছে এবং তা সৌদি সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরে আনা হচ্ছে জানিয়ে মিস্টার ইসলাম বলেন, হাতাশার দিক হচ্ছে দূতাবাসের নোটে থাকা কেসগুলো আইনীভাবে প্রমাণ করার জন্য বাংলাদেশ চ্যাপ্টারে পদ্ধতিগত কিছু ঘাটতি রয়েছে।

তবে কী ঘাটতি তা খোলাসা করেননি উপ-রাষ্ট্রদূত। দূতাবাসের অন্য দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, সৌদি আরবে গৃহকর্মী পাঠানোর আগে ঢাকার কিছু প্রস্তুতি সম্পন্ন করার সুপারিশ বরাবরই করে রিয়াদস্থ বাংলাদেশ মিশন।

৩ বছর থেকে দূতাবাসের পাঠানো প্রতিটি রিপোর্টে প্রায় অভিন্ন সুপারিশ রয়েছে জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, সেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে- সৌদি আরবে নারী কর্মী পাঠানোর আগে অবশ্যই তারা কোথায়, কার বাসায় কাজ করতে যাচ্ছেন সে সংক্রান্ত তথ্য বা প্রস্তাব সম্পর্কে যাচাই-বাছাই করার সময় রাখতে হবে। এ সংক্রান্ত তথ্য আগাম দূতাবাসে পাঠানো এবং দূতাবাসের অনুমোদন পাওয়ার পর তাদের মোটামুটিভাবে কাজ সম্পর্কে ধারণা দেয়া, ভাষা, আচরণ এবং অন্যান্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করে পাঠানো জরুরি। তা না হলে অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। দূতাবাসের রিপোর্টে ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশের মেইড ওয়ার্কার সৌদি আরবে পাঠানো সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার বিষয়ে ঢাকাকে অবহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে সম্প্রতি সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশী কর্মী (পুরুষ) পাঠানোর বিষয়ে হাই কমিশনের এটাস্টেশন বা অনুমোদন যেভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে তা-ও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলা হয়- যত দিন সৌদি আরবে নারী জনশক্তি রপ্তানীকে সিস্টেমের মধ্যে না আনা গেছে ততদিন তা স্থগিত বা বন্ধ রাখতে। কিন্তু ঢাকার তরফে দূতাবাসের ওই সুপারিশ মানা হয়নি।

লাশ হয়েছে ফিরেছে শতাধিক, একটি কেসও আইনী প্রক্রিয়ায় নেয়া যায়নি: দূতাবাস সূত্র জানায়, গত এক বছরে প্রায় শতাধিক নারী কর্মী লাশ হয়ে দেশে ফিরেছেন। নানা কারণে এটি হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা, আত্মহত্যা, ধর্ষণ এবং বর্বর নির্যাতনের ঘটনাও আছে। কিন্তু একটি কেসও আইনী প্রক্রিয়ায় নিতে পারেনি বাংলাদেশ মিশন।

এ নিয়ে দূতাবাসের দায় স্বীকার করে একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, এখানে যা কিছু ঘটে তার দায় দূতাবাসের ঘাড়ে চাপে, এটা একটা ট্রেন্ড। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিষয়গুলো দূতাবাসের নজরে আসে ঘটনা ঘটার পর। আগে থেকে দূতাবাসের নজরদারির কোন ম্যাকানিজম নেই। এ দায় সবার। যারা মারা গেছেন তাদের প্রত্যেকটি কেসের ব্যাপারে দূতাবাস সচেতন রয়েছে। কিন্তু কেসগুলোকে সৌদি আরবের আইনে চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করার জন্য যেসব কাগজপত্র-প্রমাণাদি আদালতে উপস্থাপন করতে হয় তার ঘাটতি থেকেই যায়। প্রথমত: আত্মহত্যার বিচার পাওয়া কঠিন। আত্মহত্যার প্ররোচণার জন্য এখানে বিচার আছে।

কিন্তু এটা প্রমাণ করার প্রক্রিয়া বেশ জটিল। আত্মহত্যা বা অন্য কারণে লাশ হয়ে দেশে ফেরা কর্মীদের পরিবারগুলোর মামলা করার কাগজপত্র যোগাড় করার সেই মানসিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা থাকে না। যাদের পরিবার একটু এগিয়ে আসে তারা পদ্ধতিগত হয়রানীতে অতিষ্ট হয়ে মাঝপথে উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। ফলে বারবার তাগদা দেয়া সত্বেও কেসগুলো পরিচালনার জন্য পাওয়ার অব এটর্নি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ দূতাবাসের পৌঁছায়নি বলে দাবি করেন এক কর্মকর্তা।

অতি সম্প্রতি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার নাজমা বেগমের আত্মহত্যা এবং খুলনার আবিরুনের হত্যার ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হওয়ার প্রসঙ্গে ওই কর্মকর্তা বলেন, এ দুটি ঘটনায়ও এখন পর্যন্ত দূতাবাসের তরফে কোন মামলা করা যায়নি। কারণ তাদের পরিবারের পক্ষ থেকে দূতাবাসকে মামলা করার জন্য পাওয়ার অব এটর্নি বা ক্ষমতাপত্র দেয়া হয়নি। সৌদি আইনে পরিবারকেই মামলা করতে হয় অথবা দূতাবাসকে ক্ষমতাপত্র দিতে হয়। তবে আশার দিক হচ্ছে- আবিরুন হত্যকাণ্ডের বিষয়টি সৌদি পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। সৌদি পুলিশ নিজেরাই মামলা করেছে। তার কফিল এবং ছেলেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মামলা চলমান রয়েছে। চূড়ান্ত বিচারে অর্থাৎ আদালতের রায় পর্যন্ত তাদের জেলেই থাকতে হবে। দূতাবাস মামলাটি পর্যক্ষেণে রেখেছে। আবিরুনের পরিবারের কাছ থেকে মামলায় যুক্ত হওয়ার জন্য ক্ষমতাপত্র বা পাওয়ার অব এটর্নি পেতে ঢাকায় চিঠি পাঠানো হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, সেটির জবাব এখনও আসেনি। কেবল আবিরুন নয়, লাশ হয়ে ফেরা কিংবা নির্যাতিত, বেতন-বঞ্চিত এবং অন্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যে কোন বিদেশী কর্মী সৌদি আইনে ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। সে জন্য ক্ষমতাপত্র দিতে হবে দূতাবাসকে। এ বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জেলা অফিসগুলো পাওয়ার অব এটর্নিসহ অন্যান্য কাগজপত্র প্রস্তুতিতে ভিকটিমের পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক সহায়তা দিতে পারে বলে মনে করেন রিয়াদস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছেড়ে আকুতির পর উদ্ধার হন অনেকে: ওদিকে দূতাবাস সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ছেড়ে আকুতির পর অনেক নারীই উদ্ধার হয়েছেন। তারা দেশে ফিরে গেছেন। গত বছরের আগস্ট মাসে সৌদি আরবে বসবাসকারী এক বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ভিডিও নিয়ে তখন দেশী বিদেশী সংবাদমাধ্যমে খবরও হয়। নির্যাতনের সত্যতা পাওয়া যায়। পরে তিনি উদ্ধার হন। অতিসম্প্রতি ঢাকার আশুলিয়ার এক নারী তার ওপর বয়ে যাওয়া যৌন নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ভিডিও ছেড়েছেন। যা এএফপি, আল-জাজিরাসহ আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার পেয়েছে।

গার্ডিয়ানকে কেনিয়ার নারী- ‘গৃহকর্মী নয়, ওরা আমাদের দাসী মনে করে’: শুধু বাংলাদেশ নয়, আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশ থেকে সৌদি আরবে যাওয়া নারী কর্মীদের অভিজ্ঞতাও সুখকর নয়। বৃটিশ সংবাদ মাধ্যম গার্ডিয়ান মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা আফ্রিকার নারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে গত ২৯শে অক্টোবর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে এক কেনিয়ার নারীর ভাষ্য ছিল এমন “ আমরা আগ্রহ নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আরব রাষ্ট্রগুলোতে গৃহকর্মীর কাজ করতে যাই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একইরকম শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হই।

পামেলা এমবোগো নামের ২৯ বছর বয়সী এক কেনিয়ান নারী গার্ডিয়ানকে সৌদি আরবে তার ওপর চলা নির্যাতনের কথা জানিয়ে বলেন, এর আগে আমি বাহরাইনে এক পরিবারে কাজ করতে গিয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। এরপরে ভেবেছিলেন হয়ত সৌদি আরব অন্যরকম হবে। কিন্তু এখানে আরো ভয়াবহ অবস্থায় পড়ি। আমার বিবেচনায় আরব রাষ্ট্রগুলো গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করা নারীদের জন্য সবথেকে ভয়াবহ অঞ্চল। এমবোগোর ভাষায়, ‘তারা আমাদের গৃহকর্মী নয় দাসী মনে করে।’

গার্ডিয়ানের রিপোর্ট মতে, বিভিন্ন সময়ে আরব রাষ্ট্রগুলোতে কর্মরত আফ্রিকান নারীরা ধর্ষণ, নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে খবরও প্রকাশিত হয়েছে। ফলে কেনিয়া সরকার এখন আরব রাষ্ট্রগুলোতে নারী গৃহকর্মী প্রেরণে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। সুত্র: মানবজমিন।