করোনাভাইরাস: প্রবাস ফেরত অনেক বাংলাদেশি শঙ্কা আর হয়রানির মুখে

করোনাভাইরাস: প্রবাস ফেরত অনেক বাংলাদেশি শঙ্কা আর হয়রানির মুখে

বিদেশফেরত অনেকের বিরুদ্ধে কোয়ারেন্টিনের শর্ত না মানার অভিযোগ যেমন রয়েছে, অনেকে আবার বলছেন, তারা সব শর্ত মানার পরেও হয়রানির শিকার হচ্ছেন।

অস্ট্রেলিয়া থেকে মার্চ মাসের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ফরিদপুরের একজন প্রবাসী নারী ও তার স্বামী। তারা উভয়েই অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক। বাংলাদেশে এসে তারা স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন। কিন্তু প্রবাসী এই নারী বলছেন, প্রবাসী হওয়ার কারণে তাদের নানারকম হয়রানির মুখে পড়তে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই নারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ''আমরা অনেকদিন আগেই টিকেট কেটে রেখেছিলাম। আমি ভেবেছি, বাসায় গিয়ে নিজ দায়িত্বে থাকবো। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশীরা বলছে, আমরা নাকি অস্ট্রেলিয়া থেকে পালিয়ে আসছি।

"দুইবার বাসায় পুলিশ এসেছে। দুইবার পুলিশ এসে আমাদের হ্যারাস করেছে। এমনকি আমার বাবা চাকরি করেন, তাকেও ঘরের মধ্যে থাকতে বলেছে।''

তিনি জানান, প্রতিবেশী তো বটেই, দূরের আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকেও একটা দূরত্ব টের পাওয়া যাচ্ছে।

''আমি আসলে কোথাও যাচ্ছি না। যাওয়ার ইচ্ছাও নাই। সবার ভেতরে টের পাচ্ছি, একটু এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে।''

মাদারীপুরের শিবচরে অনেকে সংক্রমিত হওয়ায় এলাকাটি লকডাউন করা হয়
তিনি জানান, বাড়ির বাইরে এবং ভেতরে পুলিশ স্টিকার লাগিয়ে দিয়েছে যে, এই বাড়িতে বিদেশ ফেরত ব্যক্তি রয়েছে।

বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণে প্রবাসীদের নিয়ে এক প্রকার আতঙ্ক তৈরি হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে অনেক স্থান থেকে।

দেশটিতে এ পর্যন্ত ৩৩ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। তাদের বেশীরভাগই প্রবাসী বা বিদেশ ফেরত কারো সংস্পর্শে এসেছিলেন বলে আইইডিসিআর থেকে জানানো হয়েছে।

এরপরেই প্রবাসীদের নিয়ে আতঙ্ক তৈরি হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়।

গত রবিবার শরিয়তপুরের একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি বরিশালে বেড়াতে গিয়ে প্রবাসী সন্দেহে মারধরের শিকার হন। পরে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিদেশ ফেরত নন বলে জানা যায়।

মার্চ মাসের ১৭ তারিখে কুমিল্লা থেকে নারায়ণগঞ্জে একজন আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন কিছুদিন আগে বিদেশফেরত একজন ব্যক্তি। খবর পেয়ে ওই বাড়ি ঘিরে রেখে পুলিশে খবর দেয় স্থানীয়রা।

বগুড়াতেও এ রকম একজন বিদেশফেরত যুবকের বাড়ি স্থানীয় লোকজনের ঘিরে রাখার খবর পাওয়া গিয়েছিল।

করোনাভাইরাস সংক্রমণ বাড়ার পর অনেকের মধ্যেই ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে
মুন্সীগঞ্জের একজন বাসিন্দা বাবুল হোসেন ছয় বছর পর কিছুদিন আগেই বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন।

নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, আমি দেশে এসেছি ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে। আমার ১৫ দিন ঘরে থাকা অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে, আমি বা পরিবার, প্রতিবেশী সবাই ভালো আছে। কিন্তু তারপরেও আমি বাসার বাইরে গেলেই সবাই প্রশ্ন করে, তুমি বাইরে এসেছো কেন?

সবাই বাঁকা চোখে তাকায়, বাজে কথা বলে। এমনও শুনেছি, আমার মতো লোকজনই নাকি সবকিছুর জন্য দায়ী। তাই এখন ইচ্ছে করে ঘরে বসে থাকি। দেশে এসেও মনে হচ্ছে যেন পরবাসে আছি।''

মাদারীপুরের অনেক বাসিন্দা বা অনেকের পরিবারের সদস্য বিভিন্ন দেশে থাকেন। করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর তাদের অনেকেই দেশে ফিরে এসেছেন।

সংক্রমণ ঠেকাতে এই জেলার একটি উপজেলা শিবচরকে সরকারিভাবে প্রথম 'লকডাউন' করা হয়। সেখানকার কর্মকর্তারা জানাচ্ছেন, শিবচরের একটি পরিবারের একজন বিদেশ‌ফেরত ব্যক্তির মাধ্যমে ছয়জন সংক্রমিত হন।

মাদারীপুরের স্থানীয় সাংবাদিক জহিরুল ইসলাম খান বিবিসিকে বলছেন, প্রবাসীদের নিয়ে পুরো জেলা জুড়েই একপ্রকার মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। অনেক পরিবারের সদস্যরা বিদেশে থাকেন। ফলে সংক্রমণ নিয়ে ভীত হলেও পরিবার তো আর তাদের সদস্যদের ফেলে দিতে পারছে না।

তবে মানুষজন প্রবাসীদের ব্যাপারে অনেক সতর্ক হয়ে গেছে। স্থানীয় প্রশাসনকে গ্রামবাসী এবং প্রতিবেশীরা প্রবাসী, বিদেশফেরত সবার নাম ঠিকানা ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছে। পুলিশ তাদের বাড়িতে যাচ্ছে। গ্রামবাসী, প্রতিবেশীরা প্রবাসীদের ওপর নজরদারি করছেন।

‘সব মিলিয়ে বলা যায়, যারা একমাস আগে এসেছেন, যারা পরে এসেছেন, সব বিদেশ ফেরতই নজরদারির মধ্যে পড়ে গেছেন।’

বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) থেকে জানানো হয়েছে, বাংলাদেশে যে ৩৩ জন ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১৩ জনই বিদেশ থেকে এসেছেন। বাকীদের বেশীরভাগই আক্রান্ত হয়েছেন বিদেশ ফেরতদের সংস্পর্শে এসে।

সরকার বলেছে, বিদেশ ফেরত প্রত্যেক ব্যক্তি অবশ্যই ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকবেন। এই সময় তারা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও আলাদা থাকবেন। কেউ যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, তাহলে আইইডিসিআরের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তখন আইইডিসিআর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

তবে বিদেশ ফেরত অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোয়ারেন্টিনের শর্ত না মানা, ইচ্ছেমত ঘোরাফেরা করার অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে এসব অভিযোগে অনেককে জরিমানাও করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ফলে প্রবাসীদের নিয়ে এই উদ্বেগের কারণ তারাই তৈরি করেছেন কি-না জানতে চাইলে, বাবুল আক্তার বলছেন, ‘সেটাও আমি একেবারে অস্বীকার করবো না। অনেকেই অসচেতন হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে।’

‌‘কিন্তু এখন যেন গুটিকয়েকের দোষে আমাদের মতো সব প্রবাসীকে দায়ী করা হচ্ছে,’ আক্ষেপ করছিলেন তিনি।