মালয়েশিয়ায় ‘মেগা-থ্রি’ অভিযান, আতঙ্কে বাংলাদেশি শ্রমিকরা

মালয়েশিয়ায় ‘মেগা-থ্রি’ অভিযান, আতঙ্কে বাংলাদেশি শ্রমিকরা

ঢাকা, ২৫ জুলাই (জাস্ট নিউজ) : মালয়েশিয়ায় অবৈধ শ্রমিকদের বিরুদ্ধে চলমান 'মেগা-থ্রি' অভিযানে সে দেশে শত শত অভিবাসীকে আটক করেছে সে দেশের ইমিগ্রেশন পুলিশ। যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের প্রায় অর্ধেকই বাংলাদেশী নাগরিক। মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশী কমিউনিটির প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, বহুদিন মালয়েশিয়াতে থাকার পরও যাদের বৈধ কাগজপত্র নেই, এই ধরপাকড় অভিযান নিয়ে তাদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ছড়িয়েছে।

মালয়েশিয়ার পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগ যৌথভাবে এই অভিযান চালাচ্ছে। কোথাও তারা হানা দিয়েছে, এ খবর জানামাত্র কমিউনিটির লোকজন ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে সবাইকে সতর্ক করে নিমেষে বার্তা পাঠাচ্ছেন।

কিন্তু তাতেও ধরপাকড় এড়ানো যাচ্ছে না। যেমন মঙ্গলবারই রাজধানী কুয়ালালামপুরের মারা ডিজিটাল মল ও তার আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৫৪ জন বাংলাদেশী সহ মোট ১৩৯ জনকে আটক করেছে ইমিগ্রেশন পুলিশ।

আটককৃতদের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান ও ভিয়েতনামের নাগরিকরাও ছিলেন।

ওই অভিযানের শেষে ইমিগ্রেশন বিভাগের মহাপরিচালক দাতুকশ্রি মোস্তাফার আলি স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, “আগামী ৩১ আগষ্টের মধ্যে এখান থেকে সব অবৈধ শ্রমিককে থ্রি-প্লাস ওয়ান পদ্ধতি অনুসরণ করে নিজ নিজ দেশে ফিরত যেতে হবে।”

যারা ওই তারিখের মধ্যে দেশে ফিরবেন না, তাদের বিরুদ্ধে 'কঠোর থেকে কঠোরতম ব্যবস্থা' নেওয়া হবে বলেও তিনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

মালয়েশিয়ার সাংবাদিক শেখ কবির আহমেদ বিবিসিকে জানাচ্ছেন, ভয়ে ভয়ে দিন-কাটানো এই অবৈধ বাংলাদেশীরা অনেকেই অভিযোগ করছেন কথিত এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হওয়াতেই তারা আজ অবধি সে দেশে বৈধ শ্রমিকের স্বীকৃতি পাননি।

“২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়ার সরকার রিহায়ারিং প্রোগ্রামের মাধ্যমে এই অবৈধ শ্রমিকদের বৈধ হওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু যে তিনটে ভেন্ডর কোম্পানিকে এর দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের নাম ভাঙিয়ে বেশ কিছু নকল এজেন্ট বা দালাল বাংলাদেশীদের সঙ্গে বিরাট প্রতারণা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।”

“আমরা প্রচুর এমন ঘটনা পেয়েছি, যেখানে বাংলাদেশী শ্রমিকরা না-বুঝে ওই ভুয়ো এজেন্টদের হাতে চার থেকে পাঁচ হাজার রিঙ্গিত (প্রায় হাজার থেকে বারোশো মার্কিন ডলার) তুলে দিয়েছেন, তাদের আঙুলের ছাপও নেওয়া হয়েছে - কিন্তু এজেন্টরা ওই টাকাটা মেরে দেওয়ায় তাদের আর কখনওই বৈধ হয়ে ওঠা হয়নি” , বলছিলেন মি আহমেদ।

শেখ কবির আহমেদ আরও বলছিলেন, যেসব ভুয়ো কোম্পানি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নিয়েছিল সেগুলোর বেশির ভাগেরই মালিকানাও ছিল বাংলাদেশীদের।

“মালয়েশিয়ান স্ত্রী থাকার সুবাদে তারা তাদের নামে ওই কোম্পানিগুলো খুলেছিলেন। কিন্তু তাদের ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেওয়ার কোনও অধিকারই ছিল না, শুধু অর্থের লোভে তারা ওই অবৈধ শ্রমিকদের ঠকিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন”, জানাচ্ছেন তিনি।

মালয়েশিয়াতে শিল্পাঞ্চল অধ্যুষিত এলাকা পেনাংয়ে কর্মরত সুলেমান নামে এক বাংলাদেশী যেমন জানাচ্ছেন, ২০১৬ সালে বাংলাদেশের এজেন্ট তার কাছ থেকে চার হাজার রিঙ্গিত (বাংলাদেশী ৮০ হাজার টাকা) নিয়ে বিনিময়ে শুধু একটি মাই ইজির কাগজ (ভেন্ডর সংস্থা) ধরিয়ে দেয়।

“তারপর দীর্ঘদিন ঘুরেও আমার ভিসা না হওয়ার কারণে আমাকে এখন দেশে ফিরে যেতে হচ্ছে। টাকা ফেরত চাইতে গেলে ওই এজেন্ট বিভিন্ন প্রকার হুমকি-ধামকি প্রদর্শন করছে”, বলছিলেন সুলেমান।

পাহাং জেলার কুয়ান্তান এলাকাতেও বাংলাদেশী এজেন্টদের হাতে প্রতারিত হয়ে প্রায় দুই থেকে তিনশো বাংলাদেশী এর মধ্যেই দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছেন। এখন মালয়েশিয়ার তেরোটি প্রদেশ জুড়ে মেগা-থ্রি অভিযান শুরু হওয়াতে সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন এই অবৈধ শ্রমিকরাই।

মালয়েশিয়ার স্থানীয় ব্যবসায়ী কামরুজ্জামান কামাল বলছিলেন, “যখনই একটা এলাকায় অভিযান চালানো হচ্ছে প্রথমেই বৈধ ও অবৈধ - সব বিদেশি শ্রমিককে ধরে এনে খোলা জায়গায় সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রোদ হোক বৃষ্টি - তাদের ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে।”

“তারপর কাগজপত্র পরীক্ষা করে যারা বৈধ তাদের ছেড়ে দেওয়া হলেও বাকিদের লরিতে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ক্যাম্পে। কিন্তু কাগজপত্র ঠিক থাকুক বা না-থাকুক, হেনস্থা হতে হচ্ছে সবাইকেই!”

সাংবাদিক শেখ কবির আহমেদও বলছিলেন, ক্যাম্পে নেওয়ার পরও অবৈধ শ্রমিকদের দুর্দশার শেষ হচ্ছে তা মোটেই নয়। ১৪ দিনের মধ্যে আদালতে পেশ করা হলে তাদের যে সাজা হয়, প্রথমে সেই মেয়াদটা জেলে কাটাতে হয়। তারপর যদি তারা দেশে ফেরার টাকা জোগাড় করতে পারেন, তাহলে নিজেকে বিমানের টিকিট কেটে ফেরার ব্যবস্থা করতে হয়।

ওদিকে সম্প্রতি মালয়েশিয়া সরকারের চালু করা 'থ্রি প্লাস ওয়ান' স্কিমের আওতাতেও যে কেউ এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনে চারশো রিঙ্গিত (একশো ডলার) জমা দিয়ে সসম্মানে নিজ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন।

কিন্তু বাংলাদেশীরা অনেকেই অভিযোগ করছেন, চারশোর জায়গায় তাদের কাছে নশো, হাজার বা তারও বেশি রিঙ্গিত দাবি করা হচ্ছে - যে পরিমাণ অর্থ জোগাড় করার ক্ষমতাই তাদের নেই।

ফলে তারা না-পারছেন মালয়েশিয়া ছেড়ে যেতে, আবার অবৈধ শ্রমিক হিসেবে সে দেশে থেকে গেলেও হেনস্থা হতে হচ্ছে পুলিশ ও ইমিগ্রেশন বিভাগের হাতে। সব মিলিয়ে এক দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়েছেন এই হাজার হাজার বাংলাদেশী। সূত্র: বিবিসি

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/১৯০৮ঘ.)