প্রসঙ্গ: ভারতের লোকসভা নিবার্চন

“তোমার হল শুরু, আমার হল সারা”

“তোমার হল শুরু, আমার হল সারা” Image Credit: Ramachandra Babu/©Gulf News

বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারতের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন চমকে দিয়েছে বিশ্বকে! কংগ্রেসের ভরাডুবি আর নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপির ভূমিধস জয় যেনো উলট-পালট করে দিয়েছে পুরো হিসেব-নিকেশ। লোকসভার নির্বাচনের যে ফলাফল পাওয়া গেল তাতে মাত্র ৫ বছর আগে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেয়া কংগ্রেস সরকারের এমন বেহাল দশাকে মেনে নিতে পারছেন না কেউই। ভারতের জনপ্রিয় এই দলটিসহ অন্যান্য বিরোধীদলগুলোর কী জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে, নাকি পৃথিবীর অন্যান্য কর্তৃত্ববাদী দেশের মতোই একই পথে হাঁটা শুরু করেছে ভারত, সে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

৫৪৩ আসনের ভোটে যেখানে সংখ্যাগরিষ্টতা পেতে প্রয়োজন ২৭২ আসন সেখানে মোদির দল পেয়েছে ৩০৩ আসন।বিরোধীদলগুলো তাদের পরাজয়ের সমীকরণ যখন মেলাতে বসেছে তখনি ভারতের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক একটি দেশের মূল্যবোধ চর্চা, উদারতা, অংশগ্রহণমূলক পরিবেশ আর ভোটাধিকারের মিটারটি ঠিক কোন জায়গায় উঠেছে তা নিয়ে দুনিয়াজুড়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

এবারের নির্বাচনে ইভিএম (ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন) বিতর্ক ঝড় তুলেছে। তবে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএমের ব্যবহার নতুন নয়। ১৯৮২ সালে প্রথম ইভিএম ব্যবহার প্রচলিত। এবারের ইভিএমের ব্যবহার বেড়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে যেখানে ১.৮ মিলিয়ন ইভিএম’র ব্যবহার হলেও এবার হয়েছে ২.৩ মিলিয়ন; কিন্তু কংগ্রেসসহ বিরোধী দল এবার ইভিএমে কারচুপির আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। এজন্য ২২ দলের নেতারা নির্বাচন কমিশনে যান এবং সব ইভিএম স্লিপ গণনার দাবি জানান।

সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের কাজকর্ম নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রবল বিতর্ক। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে উঠছে হাজারো প্রশ্ন। কমিশনের সদস্য বেছে নেওয়ার পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনার পক্ষে জোর মত দিয়েছেন স্বয়ং প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি।

লোকসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষেই ভারতের নির্বাচন কমিশনের তীব্র সমালোচনা করেছেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধী। ১৯ মে সন্ধ্যায় তিনি অভিযোগ করেন, নির্বাচনে সকল দলের মধ্যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব থাকা সত্ত্বেও বিজেপি’র ক্ষমতার কাছে নত হয়েছে নির্বাচন কমিশন।

এক টুইটে রাহুল বলেন, “নির্বাচনী বন্ড ও ইভিএম থেকে শুরু করে নির্বাচনের সময়সূচি পাল্টানো, নামো (নরেন্দ্র মোদী) টিভি, মোদির সেনাবাহিনী আর এখন কেদারনাথে করা নাটক; মোদির গ্যাংয়ের কাছে নির্বাচন কমিশনের সমর্পণ সব ভারতীয়র কাছেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। একসময় ইসিকে সবাই ভয় পেত, শ্রদ্ধা করতো। সেদিন আর নেই।”

ভারতের নির্বাচনের ফল নিয়ে করা এক প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন পোস্ট মোদীর এ বিজয়কে ‘অপ্রত্যাশিত’ বলে মন্তব্য করেছে। এ নির্বাচনের মাস চারেক পূর্বে প্রতিবেশি বাংলাদেশেও জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ভোট-ভোট খেলে শেখ হাসিনার সরকারের টানা তৃতীয়বারের মতো গদিতে বহাল থাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে। বাংলাদেশের মতো এতোটা ন্যাংটো পরিবেশে ভারতের নির্বাচন না হলেও মোদীর দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসা আর বিরোধীদলগুলোর বেহাল দশায় প্রশ্নের তৈরি করেছে যে-ভারতও কী কর্তৃত্ববাদ কিংবা একদলীয় শাসনে হাঁটা শুরু করেছে?

মোদী সরকারের বিগত পাঁচ বছরের শাসনামলে আহামরি কোনো ম্যাজিক ছিলোনা। বিজেপির ফিরে আসাকে দুঃস্বপ্ন উল্লেখ করে নিউইয়র্ক টাইমস তাদের এক সম্পাদকীয়তে বলেছে, “মোদীর মেয়াদকাল জুড়ে ছিলো সহিংসতার উসকানি; কখনো তা ভার্চুয়াল কিংবা কখনো বাস্তব জগতে। যারা মোদীর পক্ষে তারা খুঁজে বেড়িয়েছে কারা কথিত দেশবিরোধী। তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একরকম যুদ্ধ চালানো হয়েছে। মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি বাদ যায়নি। উগ্র হিন্দুদের হাত থেকে রেহাই পায়নি মুসলিম এবং নিম্নবর্ণের হিন্দুরা। বুদ্ধিজীবি এবং সাংবাদিকরা নিজেদের প্রাণহানি আর বেআইনী গ্রেফতারের ভয়ে ছিলেন ভীত।সনাতন হিন্দুরা জীন বিদ্যা এবং বিমান আবিষ্কার করেছিলো এরকম কথা বলে তারা পুরো দেশকেই বোকা বানাতে চেয়েছিলো। গতমাসে দেশটির সেনাবাহিনী ইয়েতির পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে বলে টুইট করেছে। আর ভোটের মাধ্যমে সর্বশেষ সেই দুঃস্বপ্নকেই প্রলম্বিত করা হলো।”

বিজেপির শাসনকালে বেকারত্ব বেড়েছে, অস্থিরতা চরম হয়েছে কাশ্মিরে। ২০১৪ সালে চাকুরি আর জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দিলেও মোদী তা পালনে ব্যর্থ হয়েছেন।

প্রতিবেশী বৈরী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আচরণেও বুদ্ধির পরিচয় দিতে দেখা যায়নি মোদীকে। মেঘাচ্ছন্ন দিনকে রাডার ফাঁকির কৌশল বানিয়ে পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরে বিমান হামলার নিদের্শ দেন তিনি। কাজের কাজ কিছু না হলেও সীমান্তের গুলিবিনিময়ে প্রাণ যায় ৭ ভারতীয় নাগরিকের।

নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে মোদীর জয়ের কারণ হিসেবে বলা হয়, “গরীবদের টয়লেট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, সহজ ঋণ সুবিধা, বাড়ি, বিদ্যুৎ, আর সিলিন্ডার গ্যাস সুবিধা দেবার প্রচারণা নির্বাচনে সুবিধা দিয়েছে মোদিকে। এছাড়া ভারতের বড় বড় কোম্পানিগুলো এই দ্বিতীয় মেয়াদের প্রচারণায় মোদির পাশে দাঁড়িয়েছে, দিয়েছে তাঁর দলের সব খরচের যোগান। এ জায়গাটাতে পিছিয়ে ছিলাে অন্য দলগুলো। একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানতো মোদীকে ‘ভারতের ত্রাণকর্তা’ বলে প্রচারণা চালিয়েছে। ভারতের যে নির্বাচন কমিশন একসময় তা ছিলো অনড়-শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান আর তাকেই এবার ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলেছে বিরোধীদলগুলো।”

২০০২ সালে গুজরাটের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য নরেন্দ্র মোদীকে দায়ী মনে করা হয়। পশ্চিমা সরকাররাও এজন্য তাকে দায়ী মনে করে। গুজরাটে তাঁর তত্ত্বাবধানে ঘটে যাওয়া সে দাঙ্গায় হাজারো মুসলিম প্রাণ হারায়। এতবড় অপরাধ আর অভিযোগের পরও শীর্ষ ধনীদের পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১৪ সালে রাজনীতির মাঠে প্রবেশ এবং ক্ষমতায় যাবার সুযোগ পান মোদী।

মোদীর জয়ের কৌশলের বিষয়টি উল্লেখ করে ঐ সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “মোদীর বিগত ৫ বছরে অনলাইন ব্যবহারকারীর সংখ্যাটা দ্বিগুণ হয়েছে। দরিদ্রদের বিশাল একটা অংশ যারা শিক্ষায় পিছিয়ে তারা কমদামে স্মার্ট ফোনের সুবিধা পেয়েছে। আর ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটস অ্যাপ, ইউটিউবে ভূয়া সংবাদের ফাঁদে পড়েছে। ভূয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে-বিমান হামলায় পাকিস্তানের হাজার-হাজার মানুষ মারা গেছে। মোদী পাকিস্তানের এমন ভয় পাইয়ে দিয়েছেন যে তারা পাইলটকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। এ কৌশল মোদীর নির্বাচনে কাজে দিয়েছে।”

মোদীর এই জয়ে ভবিষ্যত শংকার কারণ রয়েছে বলে মন্তব্য করেছে নিউইয়র্ক টাইমস।

ওয়াশিংটন পোস্ট’র ভাষায়-মোদীর বিজয় হচ্ছে এক ধরনের ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের বিজয়, যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে ভারতীয়দের বিবেচনা করা হয় একটি মৌলবাদী হিন্দু জাতি হিসেবে। এই জাতীয়তাবাদের ভিত্তি হচ্ছে, দেশের প্রতিষ্ঠাতাদের গড়ে তুলা দীর্ঘদিনের ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ পরিহার।

ভারতের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন যেকোনো বিবেচনায় বাংলাদেশের চাইতে একটি শ্রেষ্ঠ নির্বাচন। বাংলাদেশে আদতে কোনো নির্বাচনই হয়নি।হয়েছে দাড়িয়াবান্দা, গোল্লাছুটের মতো ভোট-ভোট খেলা। দুনিয়াজুড়ে এ নির্বাচনের ভোট জালিয়াতি আর অনিয়মের চিত্র ফুটে উঠেছে। সর্বশেষ যে নির্বাচন হলো তাতে আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮ আসনে নিজেদের জয় ভাগিয়ে নেয়। এ নির্বাচন নিয়েও নিউইয়র্ক টাইমসে একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয় যাতে একে ‘প্রহসন’ বলে উল্লেখ করা হয়।

ওই সম্পাদকীয়তে বলা হয়, “৩০ ডিসেম্বরের ভোটের পূর্বে বিরোধী দলের প্রার্থীদের প্রচারণায় সরকার কর্তৃক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি, সহিংসতা এবং বেআইনী গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ করেছে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে জানায়- সমাজের বুদ্ধিজীবি থেকে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত একটা আতংকের পরিবেশ বিরাজ করছে। আর তাতে হাতগুটিয়ে বসে আছে আদালত এবং নির্বাচন কমিশন।”

বাংলাদেশের এই স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থা সম্পর্কে টাইমসের পক্ষ থেকে হাসিনা প্রশ্ন করা হলে তিনি জবাব দেন- “আমি খাবার, চাকরি আর স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছি কিনা এটাই হলো মানবাধিকার। বিরোধীদল, সুশীল সমাজ আর সংস্থাগুলো কী বললো তা পরোয়া করিনা। দেশ কী সেটা আমি জানি, কীভাবে উন্নয়ন করতে হয় তাও জানি।”

সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়, “খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় জেলে পুরে হাসিনা আবারো ক্ষমতায় বসলেন। আর তাতে দেশটি একদলীয় শাসনে ফিরে গেলো এবং তা আরো পাকাপোক্ত করবে।”

বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা ও বহুল প্রত্যাশিত জাতীয় নির্বাচনে বিশ্বের বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারত ও তার প্রশাসনের ভূমিকা সকলেরই জানা। একটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন জাতি রাষ্ট্রকে ক্রমান্বয়ে কর্তৃত্ববাদে নিপতিত করার পেছনে সাউথ ব্লকের অগাধ পরিশ্রম মোটেই বৃথা যায়নি। সুজাতা সিংয়ের গণতন্ত্র বিরোধী ‘শার্টল ডিপ্লোমেসি’ নিশ্চয়ই দুই দেশের জনগণ দীর্ঘ দিন মনে রাখবে। গণতন্ত্রের অবাধ প্রবাহে বাঁধা প্রদান করে ভারতের হাসিল করার যে কিছু নেই ভারতের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনই দেশটির রাজনৈতিক বোদ্ধাদের এমন ভাবনার যোগাড়। গত একদশকেরও বেশিসময় ধরে যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিনাশে শ্রম-ঘাম দিয়েছেন, তাঁরাই আজ নিজ দেশে কর্তৃত্ববাদের আভাস পাচ্ছেন মর্মে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। গণতন্ত্র কোনো গোত্রীয় বিষয় নয়, বরং সার্বজনীন। গণতন্ত্রের ব্যাপ্তি ও বিকাশ সীমান্ত প্রাচীরের মধ্যে আটকে রেখে প্রতিবেশি ছোট রাষ্ট্রগুলোকে স্বৈরতন্ত্রের পথে উৎসাহিত করার পরিণতি যে সুখকর নয় বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের উদারপন্থী রাজনীতিকরা এবার নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। গত এক দশকে বাংলাদেশে কর্তৃত্ববাদ  প্রতিষ্ঠিত হলেও ভারত এ ক্ষেত্রে অনেকটা নবীন। ভারতের উল্টো রথের যাত্রা তবে কী শুরু! দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়ীতা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

তোমার হল শুরু, আমার হল সারা -
তোমার আমায় মিলে, এমনি বহে ধারা