
বর্তমানে আমাদের সমাজ ও জাতীয় জীবনে অপরাধ, সুদ-ঘুস ও দুর্নীতির অবস্থান কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু আমরা যদি আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, মানুষ গড়ার কারিগর বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মাদ (সা.) অপরাধ ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত একটি সমাজকে কীভাবে উদ্ধার করেছিলেন। অন্ধকার সমাজকে আলোয় রূপান্তর করেছিলেন।
তিনি এমন এক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সে শিক্ষাব্যবস্থার সিলেবাস ছিল আল-কুরআন ও আল-হাদিস। এ শিক্ষা গ্রহণ করে গড়ে উঠেছিলেন আবুবকর, উমর, উসমান ও আলী (রা.)-এর মতো মানবেতিহাসখ্যাত শাসক ও মনীষী। এ ব্যবস্থা আত্মস্থ করে এমন একদল মানুষ তৈরি হয়েছিলেন, যারা অপরাধের পর বিবেকের কশাঘাতে টিকতে না পেরে নিজেদের অপরাধের বিচার প্রার্থনার জন্য নবিজির বিচারালয়ে হাজির হতেন। নিজে ক্ষুধার্ত থেকে অভুক্তকে নিজের খাদ্য বিলিয়ে দেওয়ার মানসিকতা গড়ে উঠেছিল তাদের মধ্যে। তাদের পরিচালিত রাষ্ট্রে একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে রাতে-দিনে সুন্দরী-রূপবতী মহিলারা মূল্যবান সব অলংকার পরে একাকী পথ চলেছে, কিন্তু কেউ তাকে জিজ্ঞেসও করেনি। কেউ তার দিকে চোখ তুলে দৃষ্টিপাতও করেনি। প্রত্যেকটি মানুষ পরস্পরের জানমাল, ইজ্জত-আবরুর বিশ্বস্ত আমানতদার বনে গিয়েছিল।
এ ধরনের তাকওয়াভিত্তিক রাষ্ট্রের উন্নয়নকল্পে আল্লাহ আসমান ও জমিনের দুয়ারগুলো খুলে দেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, যদি সে সময় জনপদের মানুষগুলো ইমান আনত এবং তাকওয়া অবলম্বন করত, তাহলে আমি তাদের ওপর আসমান ও জমিনের যাবতীয় বরকতের দুয়ার খুলে দিতাম, কিন্তু তারা তা প্রত্যাখ্যান করেছে, অতঃপর তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য আমি তাদের পাকড়াও করেছি। (সূরা আরাফ, আয়াত : ৯৬)।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, মাখজুম গোত্রের এক নারীর চুরির ঘটনা কুরাইশের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলল। এ অবস্থায় তারা বলাবলি করতে লাগল এ ব্যাপারে আল্লাহর রাসূলের সঙ্গে কে আলাপ করতে পারে? তারা বলল, একমাত্র রাসূল (সা.)-এর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ উসামা বিন জায়েদ (রা.) এ ব্যাপারে আলোচনা করার সাহস করতে পারেন। উসামা (রা.) নবিজির সঙ্গে কথা বলেন। নবিজি বললেন, তুমি কি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘনকারিণীর সাজা মওকুফের সুপারিশ করছ? অতঃপর নবিজি দাঁড়িয়ে খুতবায় বললেন, তোমাদের আগের জাতিগুলোকে এ কাজই ধ্বংস করেছে, যে যখন তাদের মধ্যে কোনো বিশিষ্ট লোক চুরি করত, তখন তারা বিনা সাজায় তাকে ছেড়ে দিত। অন্যদিকে কোনো অসহায় গরিব সাধারণ লোক যদি চুরি করত, তখন তার ওপর হদ জারি করত। আল্লাহর কসম, যদি মুহাম্মাদ-এর কন্যা ফাতেমা চুরি করত, তাহলে আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দিতাম। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩৪৭৫)।
এ হাদিস থেকে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় জাতি, গোত্র, বর্ণ নির্বিশেষে সর্বকালে সব সমাজে ইসলামি আইন সমতার বিধান করে। এখানে জাতি, গোত্র, আর বর্ণের কোনো বিভেদ থাকে না।
আমাদের দেশে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো সাময়িকভাবে দুর্নীতির বিস্তার রোধ করেছে, কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষের চরিত্র পরিবর্তনে এসব পদক্ষেপের সাফল্য খুব কমই পাওয়া গেছে। একমাত্র ইসলামি শিক্ষাই একজন দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তির মনে প্রয়োজনীয় নৈতিক মনোবল তৈরি করতে পারে, যাতে সে দুর্নীতিতে লিপ্ত না হওয়ার জন্য আহ্বান অনুভব করবে। একইভাবে অধিকাংশ সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ কাক্সিক্ষত ফল আনতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর মূল কারণ আমরা সমস্যার মূলে আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়েছি। যেটা একমাত্র ইসলাম ও ইসলামি আইনি কাঠামোর মাধ্যমেই করা যায়। ইসলাম বাহ্যিক দৃষ্টিকোণ ও বহিরাবরণের দিক থেকে কোনো সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করে না, বরং সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে তার প্রকৃতি ও কারণ বোঝার চেষ্টা করে। একেবারে গোড়া থেকে সমস্যার মূলোৎপাটন করে।
রাসূল (সা.)-এর সময় ইসলামি আইনের বিভিন্ন কাঠামোর সূচনা ও বিকাশ শুরু হয়। পরে বিভিন্ন খেলাফতের সময় তা পরিপক্বতা লাভ করে। তখন সমাজে অপরাধপ্রবণতা ছিল কম এবং মানুষ সুখ-শান্তিতে বসবাস করত। যে দেশে ইসলাম আইন থাকবে সে দেশে মানুষের মাঝে দুর্নীতি প্রবণতা একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে আসবে। তাই ইসলামি আইন ও বিচারব্যবস্থার ওপর গবেষণা ও অধ্যয়ন আরও বৃদ্ধি করতে হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ইসলামি আইনের কার্যকারিতা মানুষের সামনে তুলে ধরতে হবে।
দুর্নীতিমুক্ত সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষে ধর্মীয় আদর্শ ও মূল্যবোধ এবং তাকওয়ার (আল্লাহভীতি) ব্যাপক অনুশীলন হওয়া প্রয়োজন। সব পিতা-মাতার উচিত নিজের প্রাণপ্রিয় সন্তানটিকে সৎ, আল্লাহভীরু ও ইসলামি অনুশাসনের পূর্ণ অনুসারী হিসাবে গড়ে তোলা। নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অনুশীলন করানো। সমাজপতি এবং সচেতন নাগরিকদের উচিত ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনে দুর্নীতির ভয়াবহ পরিণতি ও কুফল সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করে তোলা।
সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার মানদণ্ড রক্ষা করা। রাজনৈতিক পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত প্রশাসন গড়ে তোলা প্রয়োজন। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পদমর্যাদা ও দ্রব্যমূল্য সামনে রেখে সম্মানজনক জীবন-জীবিকার উপযোগী বেতনভাতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। এভাবেই সমাজকে দুর্নীতিমুক্ত করা সম্ভব। কারণ, দুর্নীতির সব ব্যবস্থা উন্মুক্ত রেখে দুর্নীতি দমন অসম্ভব। এজন্য রাসূল (সা.) পন্থায় আলোকিত মানুষ তৈরির জন্য আমাদের সেই কুরআন, যা আজো অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে, সেটিকে আঁকড়ে ধরতে হবে। ইসলামি আইনকে আমাদের সব কাজে মূলনীতি রূপে গ্রহণ করতে হবে। ইসলামের সেই সোনালি যুগের ন্যায়নীতি বর্তমানেও বাস্তবায়ন করা হলে সমাজব্যবস্থায় দুর্নীতি থাকবে না।