ফেসবুকের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন জাকারবার্গ

ফেসবুকের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন জাকারবার্গ

ঢাকা, ৪ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : ফেসবুকের চেয়ারম্যান, সিইও ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ যখন গত মে মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সামনে হাজির হন, তখন আমি তাকে বলেছিলাম যে তিনি তার কোম্পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন। ব্যক্তিগতভাবে জাকারবার্গের মুখোমুখি হওয়া অল্প কয়েকজন রাজনীতিকের মধ্যে একজন হতে পেরে আমি খুব খুশি ছিলাম। কিন্তু আমি হতাশ হয়েছি এই কারণে যে আমি আমার কোনো প্রশ্নের সরাসরি উত্তর তার কাছ থেকে পাইনি।

আমি একা নই। বিশ্বজুড়ে রাজনীতিবিদেরা লাভের নামে জবাব দেওয়া এড়াতে ফেসবুকের ক্রমাগত চেষ্টায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। জাকারবার্গ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সামনে হাজির হওয়ার কয়েক মাস পরও ফেসবুকের ব্যবসার পদ্ধতি ও নীতিগুলোর বিষয়ে সবচেয়ে জরুরি প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া যায়নি।

কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কেলেঙ্কারির ঘটনার কথাই উল্লেখ করি। এটা এখনো অস্পষ্ট যে ফেসবুক এ ব্যাপারে কী জানত এবং কখন তারা এ কেলেঙ্কারির কথা জানতে পেরেছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক রাজনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ফেসবুকের তথ্য হাতিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে কাজ করেছে।

একইভাবে এটাও এখনো অস্পষ্ট যে কোনো বিদেশি হস্তক্ষেপে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফল ও যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট গণভোটের ফলাফলকে প্রভাবিত করেছে। ফেসবুক দাবি করছে যে তারা সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটটির ব্যবহারকারীদের ব্যক্তিগত সুরক্ষার উন্নতি সাধন করেছে। কিন্তু ইউরোপীয় পার্লামেন্টের দাবি অনুযায়ী তারা কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার কেলেঙ্কারির বিষয়ে একটি সমন্বিত অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা পরিচালনা করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এই আশঙ্কা করার যৌক্তিক কারণ রয়েছে, ফেসবুককে ব্যবহার করে কোনো বিদেশি শক্তি আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারে।

যদিও ফেসবুক ও অন্য ডিজিটাল প্রতিষ্ঠানগুলো মিথ্যা তথ্য ও ঘৃণামূলক বক্তব্য ছড়ানো থেকে বিরত থাকতে ইউরোপীয় কমিশনের ‘আচরণবিধি’তে স্বাক্ষর করেছে, কিন্তু তারপরও আরো অনেক কিছু করার রয়েছে। কারণ, ইউরোপীয় কমিশনের ওই আচরণবিধি খুব দুর্বল এবং প্রতিষ্ঠানগুলো কখন থেকে তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করা শুরু করবে, সে বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের তথ্য সুরক্ষা নীতিমালা কার্যকর করতে আরো অনেক সম্পদের প্রয়োজন।

ইউরোপেও একটি কার্যকর তদন্ত সংস্থার অভাব রয়েছে, যা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোকে জবাবদিহির মধ্যে রাখতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে ২০১৬ সালের নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপের অভিযোগের বিষয়ে তদন্তকারী বিশেষ পরামর্শদাতা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর (এফবিআই) সাবেক প্রধান রবার্ট ম্যুলার কয়েক ডজন নথি দাখিল করেছেন এবং তাতে দেখিয়েছেন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিরুদ্ধে মামলার ক্ষেত্রে প্রভাবশালী আইনজীবী নিয়োগ করা কতটা প্রয়োজন। এখন ইউরোপের সময় হয়েছে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে আক্রমণের বিষয়ে তদন্ত করার জন্য একটি তদন্ত সংস্থা গঠন করার এবং তাতে অভিজ্ঞ আইনজীবী নিয়োগ করার। এ ছাড়া তথ্যের অপব্যবহার করে যেসব অপরাধ ঘটছে, তা প্রতিরোধেও এ ধরনের তদন্ত সংস্থা দরকার।

এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নকে এখন সব সদস্যরাষ্ট্রে এবং প্রতিটি ভাষায় রাশিয়ার বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য প্রচারের বিষয়টি শনাক্ত এবং বিশ্লেষণের জন্য জরুরিভাবে একটি শক্তিশালী কৌশল গড়ে তুলতে হবে। সঠিক কৌশল নিয়ে আমরা তথ্য বিকৃতকারীদের শনাক্ত করে তাদের হাত থেকে সামাজিক মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে রক্ষা করতে পারি।

ইইউ পর্যায়ে ২০১৫ সালে ইউরোপীয় কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত ইস্ট স্ট্রাটকম টাস্কফোর্সকে সম্প্রসারিত করা উচিত এবং ইইউ কূটনৈতিক পরিষেবা থেকে এই টাস্কফোর্সকে স্বাধীন রাখা উচিত। এর একমাত্র কাজ হওয়া উচিত শনাক্তকরণ, বিশ্লেষণ, প্রকাশ এবং আসল তথ্য প্রকাশ করা। আসলে মে মাসে জাকারবার্গকে আমি যা বলেছিলাম তা এখনো প্রযোজ্য: তার সৃষ্টির ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বলেই মনে হচ্ছে। যদি তাঁর নিয়ন্ত্রণ থাকেও, তারপরও আমাদের সবার তাঁর ‘আরো খোলা এবং সংযুক্ত’ বিশ্বের ধারণার বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।

নিউইয়র্ক টাইমস সম্প্রতি প্রকাশ করেছে, ফেসবুক তার ব্যবসায়িক মডেলকে রক্ষা করার জন্য ব্যাপক মরিয়া। তারা ডিফাইনার্স পাবলিক অ্যাফেয়ার্স নামের একটি জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান ভাড়া করেছে, যা ফেসবুকের প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমালোচকদের নামে কুৎসা ছড়ায়। ফেসবুকের এ ধরনের নীতিগর্হিত আচরণ কাম্য নয়। এসব বাদ দিয়ে তাদের উচিত নিজের প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। তবে এতে খুব সামান্যই সন্দেহ আছে যে লাখো মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য এবং অনলাইন সংবাদ ও তথ্যপ্রবাহের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ গণতন্ত্রের জন্য পরিষ্কার হুমকি। ফেসবুকের ব্যবস্থাপনা বারবার দেখিয়েছে যে তারা দায়িত্বশীল আচরণ করবে, এমনটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। সেটাই ভয়ের কারণ।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/০৮২৭ঘ.)