সম্মান না থাকার কারণে চাকরি ছাড়ছেন পশ্চিমবঙ্গের পুলিশরা

সম্মান না থাকার কারণে চাকরি ছাড়ছেন পশ্চিমবঙ্গের পুলিশরা

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী পুলিশকর্তাকে বাঁচাতে ধর্নায় বসেছিলেন। কিন্তু এই রাজ্যেই বহু পুলিশ কর্মী নীরবে যোগ দিচ্ছেন অপেক্ষাকৃত কম বেতন ও মর্যাদার অন্য চাকরিতে! প্রশ্ন উঠছে, এর রহস্য কী?

চাকরিতে বৈপরীত্য
কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারকে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআইয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে তৎপর হয়েছিলেন রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর তিনি ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেল ধর্না মঞ্চ থেকে ভারতীয় পুলিশ বাহিনীকে রক্ষা করার ডাকও দিয়েছিলেন। এই ঘটনাক্রমে মনে হতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে পুলিশের কর্মীরা সরকারের ছাতার আশ্রয়ে নিশ্চিন্তে রয়েছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়েই দেখা যাচ্ছে, পুলিশের চাকরির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছেন পুলিশকর্মীদের একটা অংশ। গত ৮ বছরে শুধু ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট পদ থেকেই প্রায় ৬০ জন ইস্তফা দিয়েছেন।

অতি সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক কন্ট্রোলে কর্মরত সার্জেন্ট করুণাময় চট্টোপাধ্যায় কলকাতা পুলিশের চাকরি ছেড়ে রেলের গ্রুপ ডি পদে যোগদান করেছেন। বেতন ও মর্যাদা তো বটেই, প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক থেকেও যা পুলিশের চাকরির সঙ্গে তুলনীয় নয়। তার চাকরি ছাড়ার আবেদন ঘিরে পুলিশমহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। প্রশ্ন উঠছে, ভালো বেতন ও সম্মানের চাকরি ছেড়ে অপেক্ষাকৃত কম বেতন ও নিচু পদের চাকরিতে যোগদান কি তবে পুলিশি পেশায় বিরক্ত হয়েই? অনেকের মতে, পুলিশের চাকরিতে স্বাধীনতার অভাব, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং সর্বোপরি পুলিশ হেনস্থার যে সংস্কৃতি পশ্চিমবঙ্গে চালু হয়েছে, তাতে এই চাকরি মোটেও আর সম্মানের নয়। এর পাশাপাশি পুলিশ কর্মীদের রয়েছে নানাবিধ অভিযোগ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা পুলিশের এক কর্মচারী বলেন, ‘ঠিকঠাক বেতন পেলেও পুলিশরা ভালো নেই। কাজের চাপ এত বেশি যে, ছুটিই পাওয়া যায় না৷। পাশাপাশি বিমার জন্য টাকা কেটে নিলেও ভালো চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া যায় না। আমাদের যা কিছু অভাব-অভিযোগ তা যদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছাতে যাই, তাহলে বদলির আশঙ্কা। পাশাপাশি সাধারণ মানুষ অশ্রদ্ধা করে, উপরতলার চাপ তো আছেই। এ জন্যই অনেকে চাকরি পরিবর্তন করে স্কুলে জয়েন করেছেন বা বাড়িতে ব্যবসা শুরু করেছেন।’

ঠুঁটো জগন্নাথ?
পুলিশমহলের অনেকেই স্বীকার করেছেন যে, রাজনৈতিক প্রভাবে পুলিশ ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’, কাজেও স্বাধীনতা নেই। রাজনৈতিক চাপে পিষ্ট পুলিশমহলকে যখন তখন রাজনৈতিক কর্তারা অপদস্থ করে থাকেন। এ ব্যাপারে নজির গড়েছেন বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল। পুলিশ যে ঠিকঠাক কাজ করতে পারছে না সেটার প্রেক্ষিতেও বহু উদাহরণ আছে। অতীতে পুলিশকে বোমা মারার হুমকি দিয়ে সেই মামলায় খালাসও পেয়ে গিয়েছেন তিনি। রায় দেওয়ার আগে বিচারকও তাঁর মন্তব্যে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ার মূল কারণ পুলিশি ব্যর্থতা।

এ ব্যাপারে প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘পুলিশকে সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে দেওয়ার পরিস্থিতি নেই। দেশের ভয়ংকর গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে আজ পুলিশকে যদি বোমা মারাও হয়, তা-ও পুলিশ কিছু করতে পারবে না।’

এই প্রাক্তন পুলিশ কর্তা মনে করেন আগের চেয়ে পরিস্থিতি অনেক খারাপ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘পুলিশকে যেভাবে দুর্বৃত্তদের কথা অনুযায়ী চলতে হচ্ছে, সেটা আগে এতটা ছিল না। অবস্থার অবনতি হতে হতে আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে৷ সে কারণেই বিবেকের তাড়নায় আজ অনেকে পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিচ্ছে।’

একই সুরে প্রাক্তন আইপিএস ড. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ চিরকালই শাসকদলের হয়ে কাজ করে এসেছে৷ এটা নতুন নয়৷ তবে আগের সরকারের আমলে যেটুকু রাখঢাক ছিল, এই সরকারের আমলে সেটাও নেই৷ মুখ্যমন্ত্রীর ধর্না মঞ্চে যেভাবে আইপিএস অফিসাররা বসে ছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়ে, সেটা থেকে এটা স্পষ্ট৷’

বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল অবশ্য বলেন, তিনি মুখ ফস্কেই পুলিশের বিরুদ্ধে নানা সময়ে নানা কথা বলে থাকেন৷ তিনি বলেন, ‘এমনিতে পুলিশ কর্মীদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। পুলিশদের জিজ্ঞাসা করে দেখুন। যা কিছু বলেছি, তা আসলে স্লিপ অফ টাংগ হয়ে গেছে।’ তবে নজরুল ইসলাম মনে করেন, ‘পুলিশরা যদি সৎ থাকতেন, তাহলে অনুব্রতর এমন বলার সাহস থাকত না।’

পুলিশকে হুমকির প্রবণতা
অনুব্রত মন্ডল যা-ই বলুন না কেন, সাগর ঘোষের হত্যাকাণ্ড, রবিলাল সোরেনের বাড়িতে আগুন লাগানো– সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু পুলিশ প্রমাণ করতে পারেনি সে সব। উল্টোদিকে আবার উত্তর দিনাজপুরের বিজেপি জেলা সভাপতি শঙ্কর চক্রবর্তী যখন পুলিশকে গাছে বেঁধে পেটানোর কথা বলেছিলেন, তখন পুলিশ তাকে ঠিকই গ্রেপ্তার করেছে। এই দুমুখো আচরণ প্রসঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেন, ‘বিরোধীদের, বিশেষ করে বিজেপিকে আটকানোর জন্যই পুলিশকে ব্যবহার করা হচ্ছে। পুলিশ প্রশাসন আজ নিজের কাজ বাদ দিয়ে বাকি সব করছে। এতে প্রশাসনিক কাজকর্মের অসুবিধা হচ্ছে যেমন, তেমনি পুলিশও নিন্দার মধ্যে পড়ছে। পুলিশের গাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, থানায় অ্যাটাক করা হচ্ছে। বড় বড় আইপিএস অফিসাররাও আইনমতো চলতে পারছেন না, অসম্মানের মুখোমুখি হচ্ছে৷ এসব তাঁরই পরিণাম৷ পুলিশ খুব হতাশ হয়ে পড়ছে, পুলিশ কষ্টের মধ্যে আছে।’

অনুব্রত মণ্ডলের মতো দিলীপ ঘোষও পুলিশের বিরুদ্ধে আপত্তিকর কথা বলে থাকেন। পুলিশের ইউনিফর্ম খুলে পিঠের চামড়া ছাড়িয়ে নেওয়ার মতো হুমকিও দিয়েছেন তিনি। তবে এ জন্য তিনি অনুতপ্ত নন। বরং তিনি বলেন, ‘বিরোধীদের দমন করার জন্য যদি পুলিশকে ব্যবহার করা হয়, তাহলে পুলিশের বিরুদ্ধে কথা বলার অধিকার বিরোধী নেতা হিসেবে আমার আছে। আমাদের হাজার হাজার কর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দেওয়া হচ্ছে, বারবার আক্রমণ করা হচ্ছে। আমারই দায়িত্ব এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা৷ সেটাই আমি করি।’

চাকরি ছাড়লেই নিষ্কৃতি?
করুণাময় চট্টোপাধ্যায় চাকরি ছাড়লেন কেন? তিনি জানিয়েছেন, পরিবারকে সময় না দিতে পারার জন্যই তিনি পুলিশের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু কলকাতা পুলিশের এক প্রাক্তনী জানিয়েছেন, তিনি ক্রমবর্ধমান চাপের কাছে নতি স্বীকার করেই স্কুল শিক্ষকতা বেছে নিয়েছেন। ওই ব্যাচের আরো অনেকে ভূমি রাজস্ব আধিকারিক বা আরো কম বেতনের চাকরিতে যোগদান করেছেন।

রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশকর্তা নজরুল ইসলাম সরাসরি বলেন, ‘উপরের প্রচণ্ড চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে সৎভাবে কাজ করে যাওয়ার জন্য যে দৃঢ়তা দরকার হয়, তা অনেকেরই থাকে না। এর মধ্যে অনেকে মাথা নিচু করে পদোন্নতি, আর্থিক সমৃদ্ধি বেছে নিয়ে চাকরি করেন৷ আবার মানসিক শান্তির জন্য অনেকেই কম চাপের চাকরিতে চলে যান।’

প্রাক্তন পুলিশকর্তা সন্ধি মুখোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে খুবই চিন্তিত৷ তিনি মনে করেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের ৭ দফা গাইডলাইন অনুসরণ করে পুলিশ রিফর্ম কমিশন কার্যকর করা উচিত৷ গোটা কতক রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর জন্য পুলিশের চাকরি নয়, পুলিশ চাকরি করে দেশের জন্য, আইনের রক্ষায়।’ সূত্র: ডয়চে ভেলে।

এমআই