সেনাবাহিনীর মেজাজ মর্জির ওপর কাশ্মীরের জীবন

সেনাবাহিনীর মেজাজ মর্জির ওপর কাশ্মীরের জীবন

 

মোহাম্মদ রিয়াজ খান। কাশ্মীরি কৃষক। শুক্রবার সকালে বাঙ্কারের ভেতর থেকে গুলি লাগার ভয়ে অনেকটা হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য মাঠের ভেড়াগুলো সব ঠিকঠাক আছে কি না, তা দেখা। বের হয়ে কিছু দূর গিয়েছেন।

ঠিক তখনই একেবারে তার পায়ের কাছে এসে পড়ল একটা তাজা মর্টার। হকচকিয়ে উঠে কিছু বুঝে ওঠার আগেই আচমকা বিস্ফোরণ।

স্পি­ন্টারের একটি টুকরোয় এফোড়-ওফোড় হয়ে যায় তার পা। আঘাতে বের হয়ে যায় একটি হাড়ও। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন। দৌড়ে আসে তার পরিবার। কাঁধে করে নিয়ে পাহাড়ি পথ বেয়ে দৌড়াতে থাকে নিকটস্থ হাসপাতালের দিকে। ততক্ষণে রক্তে ভিজে গেছে পুরো শরীর।

গভীর দুঃখ আর চোখের কোণে পানি নিয়ে রিয়াজের চাচাতো ভাই মনির আহমেদ বলতে থাকেন, ‘এখানে সেনাদের মেজাজ-মর্জির ওপর নির্ভর করছে আমাদের জীবন। ভয় আর শঙ্কার মাঝেই আমাদের বেঁচে থাকা।’ নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে কাশ্মীরের এই করুণ চিত্র উঠে এসেছে।

পাকিস্তান আর ভারতের মধ্যে কয়েক দশকের শত্রুতায় যে জায়গাটিকে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ্য পোহায় সেটা হচ্ছে কাশ্মীর। ১৯৪৭ সালের পর থেকে যার পুরোটাই দাবি করে আসছে দুই পক্ষই।

অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য পৃথিবীর ভূস্বর্গ হিসেবে খ্যাত হলেও হিমালয়ের পাদদেশের ভূখণ্ডটি আজ যেন এক অভিশপ্ত উপত্যকায় পরিণত হয়েছে। প্রতিবেশি দ্ইু দেশের মধ্যে এ যাবৎ যত সংঘাত হয়েছে তা এই কাশ্মীরকে ঘিরেই। চলতি সপ্তাহ থেকে সেই সংঘাত আবার ফিরে এসেছে। আবার শুরু হয়েছে কাশ্মীরিদের দুঃখ-দুর্দশা।

সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে ভারতীয় বিমান বাহিনীর বিমান হামলার পরদিন থেকেই নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর মর্টার হামলা আর গোলাগোলি চলছে হরদম। এমনকি আটক ভারতীয় পাইলটকে ফিরিয়ে দেয়ার তোড়জোড়ের মধ্যেও। এতে গত কয়েক দিনে হতাহত হয়েছে অনেকেই। অবিরাম গোলাগুলি প্রাণে বাঁচতে সীমান্তের মানুষদেরকে বাঙ্কারের মুধ্যে লুকাতে বাধ্য করছে।

জম্মু-কাশ্মীর সীমান্তে সরকারি উদ্যোগে হাজার হাজার বাঙ্কার নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু বহু এলাকাই অরক্ষিত রয়ে গেছে। পুলওয়ামার বাসিন্দা কুমার জানান, ২৫০ পরিবারের গ্রামটিতে কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থা নেই। সরকারি উদ্যোগে বাঙ্কার নির্মাণ শুরু হলেও বৃষ্টির কারণে বন্ধ রয়েছে। তাই পরিবার নিয়ে পালাতে পারলেই যেন বাঁচেন কুমার।

কুমারের স্ত্রী বলেন, ‘আমরা এমন ভয়ের মধ্যে বাস করতে চাই না। সামর্থ্য থাকলে আমরা অবশ্যই পালিয়ে যেতাম। আমরা খুবই গরিব। তাই এখনও আছি।’ একই অবস্থা পাকিস্তান শাসিত আজাদ কাশ্মীরেও।

সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে রাত নামলেই যেন ভয় নেমে আসে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেছে গ্রামের নারীরা। আর রাত জেগে পৈতৃক ভিটাবাড়ি পাহারা দিচ্ছেন পরিবারের পুরুষরা। ভয়ে ঘুম আসে না- কখন শুরু হয়! কখন গুলি লাগে, বোমা এসে পড়ে। গত দুই সপ্তাহ ধরে এই আতঙ্কেই সকাল দেখছেন পাকিস্তানি কাশ্মীরিরা।

সীমান্তে শত শত শরণার্থী

পাক-ভারত গোলাগুলিতে ভিটেবাড়ী শেষ। চাল-চুলো হারিয়ে এখন শরনার্থী! একজন দুজন নয়, গত কয়েকদিনের গোলা-বোমা-মর্টার শেলে শত শত কাশ্মিরর হঠাৎ এই দুর্দশা। মাথাগোঁজার ঠাঁই নেই । কখন কী হয় তার ও নিশ্চয়তা নেই। নিয়ন্ত্রন রেখার কোলঘেষা জম্মু-কাশ্মিরের পুঞ্চ জেলার সাজলা গ্রামের অস্থায়ী শরনার্থি ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছেন সবহারানোর দল। দিন গড়াচ্ছে আর দল ভারী হচ্ছে!

এমজে/