বালাকোটে হামলা:

পাকিস্তানে চালানো হামলায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে কেন মুখ খুলছে না মোদী সরকার?

পাকিস্তানে চালানো হামলায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে কেন মুখ খুলছে না মোদী সরকার? এই মিরাজ যুদ্ধবিমান দিয়েই হামলা চালায় ভারত। ফাইল ফটো

পাকিস্তানের বালাকোটে মঙ্গলবারের বিমান হামলায় ঠিক কতজন জঙ্গি হতাহত হয়েছে তা নিয়ে ভারতে রাজনৈতিক বিতর্ক দিন দিন তীব্র হচ্ছে। কিছু কিছু বিরোধী দল এখন প্রকাশ্যে ঐ বিমান হামলায় জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির ধ্বংস এবং বহু জঙ্গি নিহত হওয়ার সরকারি দাবির প্রমাণ দেখতে চাইছে।

এই বিতর্কের মাঝে ভারতের বিমান বাহিনীর প্রধান সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তারা বালাকোটে জঙ্গি আস্তানায় আঘাত করেছেন, তবে তাতে কত লোক মারা গেছে, সে হিসাব দেওয়ার এখতিয়ার সরকারের।

এদিকে এখন পর্যন্ত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো সংখ্যা দেয়নি। তবে হামলার দিনেই সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে ভারতীয় মিডিয়াগুলো বলেছিল যে, বিমান হামলায় বালাকোটে জইশ-ই- মোহাম্মদ জঙ্গি গোষ্ঠীর তিনশোর মতো সদস্য নিহত হয়েছে।

বালাকোট নিয়ে যেহেতু বিজেপি সরকারের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না তাই এনিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানও দাবি করছে, এই হামলায় একজন মানুষও মারা যায় নি।

বিরোধী দলগুলির অভিযোগ যে এরকম এক যুদ্ধাবস্থা তৈরি হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উচিৎ ছিল সবকটি রাজনৈতিক দলকে নিয়ে একটি বৈঠক ডেকে এবিষয়ে তাদেরকে অবহিত করা।

দিল্লিতে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক গৌতম লাহিড়ী বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘অতীতে ভারতে যখন এধরনের ঘটনা ঘটেছে, প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে বিরোধী দলগুলোকে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানিয়েছিলেন।’

তার মতে এই বিভ্রান্তির আরো একটি কারণ হচ্ছে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে যেসব রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে ভারতীয় রাজনীতিকদের একটা ধারণা হয়েছে যে সরকার প্রকৃত তথ্য জানাচ্ছে না।

তিনি বলেন, ‘বিরোধীরা জানতে চাইছে প্রকৃত ঘটনা কী। কিন্তু সরকার ও প্রশাসন থেকে শুধু বলা হচ্ছে, ভারত যে কোন একটি ঘটনার প্রত্যুত্তর দিতে পারে সেই বার্তাটাই পাকিস্তানসহ বিশ্বের কাছে পৌঁছে দিতে চেয়েছে।

এরকম বিভ্রান্তির ভেতরেই বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ আজ সোমবারেও এক জনসভায় দাবি করেছেন যে ওই অভিযানে আড়াইশো জঙ্গি নিহত হয়েছে।

গৌতম লাহিড়ী বলছেন, এবিষয়ে সরকারের ওপর একটি চাপ তৈরি হওয়ার কারণে শাসক দলের সভাপতি এরকম বলতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সরকার এবিষয়ে কিছুই বলছে না।

এই বিভ্রান্তি আগামী লোকসভা নির্বাচনী প্রচারণায় অন্যতম একটি ইস্যু হয়ে উঠবে বলে মনে করেন মি. লাহিড়ী।

হামলার খবর আসার পর কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকের উল্লাস।হামলার খবর আসার পর কয়েকজন ভারতীয় নাগরিকের উল্লাস।

তাহলে বিজেপি কেন বিষয়টি খোলাসা করছে না? এই প্রশ্নের জবাবে মি. লাহিড়ী বলেন, ‘আমার মনে হয় বিজেপির কাছে এখনও কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। যে কারণে তারা সংখ্যা নিয়ে কিছু বলছেন না। বিজেপির মন্ত্রীরা যেসব বলছেন তার দায়িত্বও কিন্তু সরকার নিচ্ছে না।’

বালাকোটে অভিযান চালানোর পরই সরকারি সূত্রকে উদ্ধৃত করে ভারতের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছিল যে তিনশোর মতো জঙ্গি নিহত হয়েছে। ধ্বংস করা হয়েছে জইশ-ই-মোহাম্মদের একটি প্রশিক্ষণ শিবির।

এনিয়ে ভারতের বিমান বাহিনীর প্রধানকেও সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়েছিল। জবাবে তিনি বলেছেন, তাদের কাজ ছিল বিমান দিয়ে আক্রমণ করা। ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হবে।

হামলার পরপরই যখন হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা জানতে চেয়ে দাবী উঠতে থাকে তখন অনেকেই বলেছিলেন স্যাটেলাইট ইমেজ থেকে আনুমানিক একটা সংখ্যা বলা যেতে পারে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত স্যাটেলাইট থেকে তোলা এরকম কোন ছবিও প্রকাশ করা হয়নি।

বেসরকারিভাবে যা কিছু বলা হচ্ছে সেসবের সত্যতাও সরকার স্বীকার করছে না।

‘আমার মতে সবচেয়ে ভালো হতো প্রধানমন্ত্রী যদি সবকটি দলকে বৈঠকে ডেকে বলতে পারতেন প্রকৃত পরিস্থিতি কী তাহলে বিভ্রান্তিটা এতো বাড়তো না,’ বলেন সাংবাদিক লাহিড়ী।

তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও এমপিরা জানতে চেয়েছিলেন ঘটনা সম্পর্কে কিন্তু পররাষ্ট্র সচিবও তাদেরকে কিছু জানাতে পারেন নি।

তিনি মনে করেন, এর ফলে সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে মানুষের মনে একটা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

নির্বাচনের উপর প্রভাব
বালাকোট নিয়ে ভারতে যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বিরোধী দলগুলো সেটাকে তাদের প্রচারণার ইস্যু করতে চাইছে। কিন্তু শাসক দল বিজেপি জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সমঝোতা করা বলে অভিযোগ করছে।

গৌতম লাহিড়ী বলেন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও অভিযোগ করেছেন যে বিরোধী দলগুলো পাকিস্তানকে মদত দিচ্ছে।

‘ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যখনই কোন ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়েছে ভারতের শাসক দল সবসময়ই সেটা ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে। যাতে সরকারের ব্যর্থতার খতিয়ান বিতর্কের মধ্যে চলে আসতে না পারে।’ এটাকে শাসক দলের কৌশল বলেই তিনি মনে করছেন।

তিনি বলেন, ভারতীয় পাইলট যখন পাকিস্তানের হাতে বন্দী ছিলেন সেই দিনও প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে বিজেপির কর্মীদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে এবিষয়ে কথা বলেছিলেন। পরে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশেও তিনি এনিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।

পাকিস্তানে অভিযানের বিশ্বাসযোগ্যতার ব্যাপারে বিরোধীরা কেন প্রশ্ন তুলছেন এবিষয়টিকেই প্রধানমন্ত্রী মোদী সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন।

এনিয়ে ইতোমধ্যে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় কংগ্রেস থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীও।

দিল্লির সাংবাদিক লাহিড়ী বলেন, এই বিতর্কে শাসক দল বিজেপি কিছুটা সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করছে। তবে শেষ পর্যন্ত কতোটা করতে পারবে সেটা মুশকিল।

‘কারণ অতীতের লোকসভার নির্বাচনের দিকে তাকালে দেখা যায় সেসব নির্বাচনের আগে সীমান্তে যেসব উত্তেজনা হয়েছিল তাতে যে শাসক দল সবসময় বড় ধরনের সুবিধা লাভ করতে পেরেছে তা নয়। এর পেছনে একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে যে পাঁচ বছরে সরকারের ব্যর্থতাকে বিতর্ক থেকে মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া।’ সূত্র: বিবিসি বাংলা।

এমআই