গাজায় প্রচণ্ড ইসরাইলি হামলা, হামাস কমান্ডারসহ নিহত ২০

গাজায় প্রচণ্ড ইসরাইলি হামলা, হামাস কমান্ডারসহ নিহত ২০

গাজায় প্রচণ্ড ইসরাইলি বিমান ও স্থল হামলায় দুই অন্তসত্ত্বা নারী, দুই শিশু ও এক হামাস কমান্ডারসহ অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে। ২০১৪ সালের ভয়াবহ যুদ্ধের পর এটাই সবচেযে রক্তাক্ত হামলা।

নিহতদের মধ্যে হামাসের কমান্ডার হামাদ আহমদ আল-খোদারিও রয়েছেন। বিমান হামলায় তার গাড়ি বিস্ফোরিত হয়। ৫ বছরের মধ্যে এই প্রথম কোনো হামাস নেতাকে এভাবে টার্গেট করা হলো।

ইসরাইলি সূত্র জানিয়েছে, মানি চেঞ্জার হামাদ আহমদ গাজায় ইরানি তহবিল হস্তান্তর ও ইরান থেকে অস্ত্র আনার সাথে জড়িত ছিলেন।

মধ্য গাজায় ইসরাইলি বিমান হামলায় ইসলামিক জিহাদ গ্রুপের দুই সদস্যও নিহত হয়েছে। তারা হলেন আবু আরমানাহ, ৩০, ও মোহাম্মদ আবু আরমানাহ, ২৭।

ইসরাইল জানিয়েছে, শনিবার থেকে হামাস ও ইসলামিক জিহাদ ৪৫০ বারের বেশি রকেট ও মর্টার হামলা চালিয়েছে ইসরাইলে। এগুলোর মধ্যে ১৫০টির বেশি তারা ভূপাতিত করেছে।

রকেট ও মর্টার হামলায় অন্তত চার ইসরাইলি নিহত হয়েছে। ২০১৪ সালের পর এই প্রথম ইসরাইলি বেসামরিক লোকজন হতাহত হলো।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, নিহত শিশুটির নাম সাবা আরার। তাদের ভবনটি হানাদার বাহিনীর লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলে মর্মান্তিক এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। তবে দখলদার বাহিনীর দাবি, তারা শুধু সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে এ হামলা চালিয়েছে। গাজা উপত্যকায় তুরস্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আনাদোলু এজেন্সির সদর দফতর ভবনকেও বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে ইসরাইল। ইসরাইলি বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত স্কুলগুলো এক দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে গাজা কর্তৃপক্ষ।

ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে গাজায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই পক্ষের মধ্যে এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ লড়াই। ইসরাইলের দাবি, ফিলিস্তিনিরা শনিবার থেকে কমপক্ষে ৪৩০টি রকেট নিক্ষেপ করেছে তাদের ভূখণ্ডে। এর বেশির ভাগই মাঝ আকাশে বিকল করে দেয়া হয়েছে। তবে এতে নিহত হয়েছে একজন। ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বলেছে, জবাবে তারা গাজা উপত্যকায় প্রায় ২০০ স্থানে টার্গেট করেছে। গত মাসে উভয়পক্ষ একটি যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। এখানে একটি দীর্ঘমেয়াদি শান্তিচুক্তি করানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র।

সর্বশেষ এই উত্তেজনা শুরু হয় গত শুক্রবার। গাজায় অবরোধের বিরুদ্ধে এদিন বিক্ষোভ করেন ফিলিস্তিনিরা। ইসরাইলের দাবি, ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র যাওয়া বন্ধ করার জন্য ওই অবরোধ দেয়া হয়েছে। বিক্ষোভের সময় অস্ত্রধারী এক ফিলিস্তিনি সীমান্ত দেয়ালের কাছে দুই ইসরাইলি সেনাকে গুলি করে আহত করে। জবাবে ইসরাইল বিমান হামলা চালায়। এতে দুই ফিলিস্তিনি নিহত হন। এরপরই শনিবার সকালে গাজা থেকে রকেট ছোড়া শুরু হয় বলে দাবি ইসরাইলের। তাদের দাবি অনুযায়ী, ইসরাইলের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কয়েক ডজন রকেট ভূপাতিত করা হয়। তবে ইসরাইলের বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে কিছু বাড়িতে তা আঘাত করে। রোববার আশকেলন এলাকায় একজন ইসরাইলি নিহত হন। তিনি বাড়িতে শার্পনেলের আঘাতে আহত হয়েছিলেন। ইসরাইল বলছে, তারা শনি ও রোববার হামাস ও ইসলামিক জিহাদের সাথে যুক্ত দুই ফিলিস্তিনিকে বিমান হামলায় হত্যা করেছে। তবে গাজার নিয়ন্ত্রণে থাকা হামাস জানিয়েছে, দুইজন নয়, নিহত হয়েছেন চার ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে রয়েছেন একজন নারী ও তার ১৪ মাস বয়সী একটি মেয়ে। কিন্তু ইসরাইলের দাবি, ফিলিস্তিনিদের ছোড়া রকেটের আঘাতে ওই নারী ও তার মেয়ে মারা গেছে।

শনিবার রাতে গাজার সীমান্তবর্তী ইসরাইলি এলাকাগুলোতে বারবার রকেট হামলার সাইরেন বেজে ওঠে। এতে ওই এলাকার ইসরাইলিদের রাতভর আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে যাওয়া-আসার মধ্যে থাকতে হয়। এ সময় ইসরাইলি রকেট প্রতিরোধী ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে আকাশে ফিলিস্তিনি রকেট নিষ্ক্রিয় করতে দেখা যায়। ইসরাইলি পুলিশ জানিয়েছে, গাজা থেকে ছোড়া রকেটগুলোর একটি আশকেলন শহরের একটি বাড়িতে আঘাত হেনেছে, এতে এক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। অপরদিকে ইসরাইলি বোমাবর্ষণে গাজার ভবনগুলো কেঁপে কেঁপে উঠেছে এবং ফিলিস্তিনিরা পালিয়ে আড়াল নিতে বাধ্য হয়েছে বল জানিয়েছেন স্থানীয়রা। রোববার ভোরের আগে তাদের দুই সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন ইসলামী জিহাদ।

শনিবার ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র লেফটেনেন্ট কর্নেল জনাথন কনরিকাস জানিয়েছেন, হামলার মাত্রা আরো বাড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরাইল। তিনি অভিযোগ করেন, ইসলামিক জিহাদ সীমান্তকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আর হামাস তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে একইদিন এক যৌথ বিবৃতিতে হামাস ও ইসলামিক জিহাদ বলেছে, ‘শত্রু যদি যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তাহলে আমাদের প্রতিক্রিয়া আরো বিস্তৃৃত ও আরো যন্ত্রণাদায়ক হবে’।

বরাবরের মতো ইসরাইলে রকেট হামলার নিন্দা জানিয়ে গাজায় ইসরাইলের হামলার প্রতি সমর্থন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। শনিবার মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এ কথা জানিয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নারী মুখপাত্র মর্গেন ওর্তাগাস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের নিরপরাধ বেসামরিক লোক ও আবাসিক এলাকায় হামাসের চলমান রকেট হামলার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা সহিংসতাকারীদের প্রতি অবিলম্বে তাদের এই আগ্রাসন বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছি।’ মর্গেন বলেন, ‘আমরা ইসরাইলের পাশে আছি এবং তাদের ওপর এই হামলার জবাবে তাদের আত্মরক্ষার যে অধিকার রয়েছে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছি।’

মুসলিমদের পবিত্র মাস রমজান ও ইসরাইলের প্রতিষ্ঠা দিবসের ছুটির ঠিক আগে ইসরাইল-গাজা সঙ্ঘাত ফের উসকে উঠল। ফিলিস্তিনিদের নিজেদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর থেকে ইসরাইল পূর্ব জেরুসালেম দখল করে রেখেছে। ফিলিস্তিনিরা চায় পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে পশ্চিম তীরে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। অন্য দিকে পূর্ব জেরুসালেমকে নিজেদের অবিভাজ্য রাজধানী বলে দাবি করতে থাকে ইসরাইল। অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ব জেরুসালেমে ইসরাইলি দখলদারিত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেমে অবৈধভাবে নির্মিত বসতিতে প্রায় ছয় লাখ ইসরাইলি বসবাস করে। এই দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি জনতার প্রতিরোধকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে আখ্যায়িত করে ইসরাইল। আর ইসরাইলের যেকোনো পদক্ষেপে সমর্থন জোগায় যুক্তরাষ্ট্র।

এমজে/