ভারতে মুসলমানের সংখ্যা আসলে কত?

ভারতে মুসলমানের সংখ্যা আসলে কত?

উত্তর ও মধ্য ভারত জুড়ে ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইনে’র পক্ষে কট্টরপন্থী হিন্দুদের প্রচারণা বেশ জোরেশোরেই এগিয়ে চলেছে। এই আন্দোলনটি আপাতদৃষ্টিতে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ ভারতের ১৩৪ কোটির বিশাল অধিবাসীর ভার লাঘব করার প্রয়োজনে সচেতনতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা মনে হতে পারে। কিন্তু এ আন্দোলন ভারতের উগ্রপন্থী হিন্দু সংগঠনগুলোর একটি মূল বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে। আর তা হলো, মুসলমানরা জনসংখ্যার দিক থেকে হিন্দুদের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।

এ প্রচারণার নেপথ্যে ‘ইসলামভীতি’ কাজ করছে, এমনটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। আর প্রচারণাটি বাস্তব জীবন এবং সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ও ফেসবুক পোস্টগুলোতে ভয় ও ঘৃণা উদ্দীপক একটি ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে যে, ভারতের মুসলমানের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২০ কোটি, যা কোনো এক সময় ৯৬ কোটি ৬০ লাখের শক্তিশালী হিন্দু জনগোষ্ঠীকে ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া কৌশলে এবং বিভিন্ন জনসভায় বলা হচ্ছে, ভারতে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য মুসলমানেরা দায়ী।

উদাহরণস্বরূপ, জনসংখ্যা সমাধা ফাউন্ডেশন (পপুলেশন রেজুলিউশন ফাউন্ডেশন) নামক এনজিও উত্তর ভারতজুড়ে ভ্রমণ করে এ বিষয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা আগামী অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে দুই দিনের পদযাত্রার পরিকল্পনা করছে এবং সে লক্ষ্যে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে।

আলজাজিরার সাথে এক সাক্ষাৎকারে এনজিওটির প্রধান চৌধুরী বলেছেন, ‘যদি আমরা এখনই এ বিষয়ে আইন করতে না পারি তাহলে ভারত খুব শিগগিরই গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হবে।’ জনসংখ্যা সমাধা ফাউন্ডেশন দুই সন্তান নীতিকে সমর্থন করে এবং এ নীতি ভঙ্গকারীদের অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করে কারাদণ্ডের আইন চায়।

চৌধুরীর দাবি, তাদের গোষ্ঠীটি ভারতের ৭২৫টি প্রশাসনিক জেলার প্রায় অর্ধেকজুড়ে দেড় লাখ বিক্ষোভ ও সভা করেছে। তারা ৪০০-এর বেশি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ পরিচালনা করছে এবং ১০ লাখ মানুষকে তাদের সাথে সম্পৃক্ত করেছে।

‘যখন আমরা দেশজুড়ে ভ্রমণ করি তখন ৯৫ শতাংশ লোক বলেছে যে, মুসলমানেরা ভারতের জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জন্য দায়ী। হিন্দুরা আমাকে বলেছে, ‘আমাদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে বলার কোনো মানে নেই, আপনার উচিত মুসলমানদের এ কথা বলা।’ চৌধুরী বলেন, কথা হলো এটাই সত্য।

চৌধুরীর বৈঠকগুলোতে সরকারি মন্ত্রী গিরিরাজ সিংহ এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের (আরএসএস) নেতাদের উপস্থিতি দেখা যায়। আরএসএস ক্ষমতাসীন কট্টোর ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি দলের আদর্শিক অভিভাবক হিসেবেই বিবেচিত।

স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যার সমস্যা নিয়ে কাজ করা মুম্বাইভিত্তিক এনজিও, পপুলেশন ফার্স্টের পরিচালক ডা: আল শারাদা এই আহ্বানগুলোকে বিপজ্জনক ও অবিবেচনাপ্রসূত বলে এর সমালোচনা করেছেন। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, ‘এই জাতীয় আইনের পক্ষে আহ্বান একটি কর্তৃত্ববাদী, সুবিধাভোগী অবস্থান এবং এসব উদ্দেশ্য হাসিলে সর্বদা দরিদ্র ও বঞ্চিতদের জন্য লক্ষ্যে পরিণত করা হয়।’

কথিত জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের এই আন্দোলনের অনলাইন সাফল্যের আরেকটি উদাহরণ হলো, লাখনৌয়ের ৩৬ বছর বয়সী ফার্মাসিউটিক্যাল ব্যবসায়ী অমিত পান্ডে। সে, তার ‘জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন’ নামের ফেসবুক পেজে মাত্র দুই মাসে ৩০ হাজারের এর বেশি ফলোয়ার সংগ্রহ করেছে। পান্ডে দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করেছেন যে, মুসলমানরা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।

তিনি প্রতিদিন বেশ কয়েকবার পোস্ট করেন এবং এসব পোস্টে প্রায়ই ভুল তথ্য দেয় সে। তার পেজটি ছবি, উপহারসহ ভিডিওতে পূর্ণ থাকে। তার পেজে এক উগ্রপন্থী হিন্দু কর্মী ইউরোপের মুসলমানদের বিরুদ্ধে আধুনিক যুগের ক্রুসেডের (ধর্মযুদ্ধ) পরামর্শ দিয়েছে। অন্য একজন মুসলমানদের ‘আরব দাস’ বলে অভিহিত করেছে।

ভারতীয় উগ্রপন্থীদের একটি বিশাল অংশ দীর্ঘদিন ধরে এই বিশ্বাস ধারণ করছেন যে, হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই মুসলমানেরা তাদের জনসংখ্যা আরো বাড়ানোর ষড়যন্ত্র করেছে। আরএসএস এর আগে দাবি করেছে যে, জার্মানি ও ফ্রান্সসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে যেভাবে মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে তাতে করে ওই সব দেশ দ্রুতই ‘ইসলামী রাষ্ট্রে’ পরিণত হবে।

২০১১ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ ভারতীয় আদমশুমারিতে দেখা গেছে যে, হিন্দুরা জনসংখ্যার ৭৯.৮ শতাংশ এবং মুসলমানরা ১৪.২ শতাংশ, যা এক পঞ্চমাংশেরও কম। ওই শুমারিতে এ-ও দেখা গেছে, দেশটির জনসংখ্যা বিবেচনায় হিন্দুদের জন্মহার ০.৭ শতাংশ কমেছে এবং মুসলমানদের জন্মহার ০.৮ শতাংশ বেড়েছে।

আদমশুমারি অনুসারে ২০০১ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে ভারতের দ্রুত বর্ধমান ধর্ম ছিল ‘ইসলাম’। যার বৃদ্ধির হার ছিল ২৪.৬ শতাংশ এবং একই সময়ে হিন্দু ধর্ম বৃদ্ধির হার ছিল ১৫.৮ শতাংশ। হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা এই পরিসংখ্যান তাদের যুক্তি হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলেছেন যে, তথ্যটি অসম্পূর্ণ ও বিভ্রান্তিকর।

জুলাইয়ে বিজেপির এমপি রাকেশ সিনহা ভারতীয় পার্লামেন্টে একটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল ২০১৯ উত্থাপন করেছিলেন। প্রস্তাবটি নিয়ে হয়তো এখনো আলোচনা হতে পারে এবং সরকার এটিকে প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। তবে পার্লামেন্টে এ ধরনের পদক্ষেপ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আইন গঠনের পক্ষে ক্রমবর্ধমান সমর্থনকেই উপস্থাপন করে। সূত্র: আলজাজিরা।

এমআই