বাইডেন-ইউক্রেন-ট্রাম্প: আমেরিকায় নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক

বাইডেন-ইউক্রেন-ট্রাম্প: আমেরিকায় নতুন রাজনৈতিক বিতর্ক

যুক্তরাষ্ট্রে নতুন এক রাজনৈতিক বিতর্ক ক্রমেই উস্কে উঠছে। অভিযোগ উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ডেমোক্রেট দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বী জো বাইডেনের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর তথ্য খুঁড়ে বের করার চেষ্টা করেছেন। তবে ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের যুক্তি, ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে জো বাইডেনই একটি ফৌজদারি অপরাধ তদন্ত থেকে সরে যেতে ইউক্রেনকে চাপ দিয়েছেন, যাতে হয়তো ফেঁসে যেতে পারতো তার ছেলে হান্টার বাইডেন। এ নিয়ে বিবিসি একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন করেছে।

প্রসঙ্গত, বর্তমান ডেমোক্রেটিক দল থেকে যারা আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রার্থী হতে চান, তাদের মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন বাইডেন।

যেভাবে বিতর্কের সূচনা
এ বছরের ২৫শে জুলাই ট্রাম্প ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির মধ্যে একটি ফোনালাপ হয়। অভিযোগ উঠেছে, ওই ফোনালাপে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাকে বাইডেনের বিরুদ্ধে তদন্ত করতে চাপ প্রয়োগ করেন। ওই আলাপে তিনি ইউক্রেনের জন্য কংগ্রেসের বরাদ্দকৃত ২৫০ মিলিয়ন ডলারের প্রসঙ্গও তোলেন। ট্রাম্প প্রশাসন পরে ওই সাহায্য দীর্ঘদিন ঝুলিয়ে রাখে। ওয়াশিংটন পোস্ট সহ অন্যান্য মার্কিন সংবাদমাধ্যম বলছে, ওই ফোনকলের অন্তত এক সপ্তাহ আগে ট্রাম্প তার ভারপ্রাপ্ত চিফ অব স্টাফ মাইক মালভ্যানিকে বলেছিলেন, ওই সাহায্য যেন পিছিয়ে দেওয়া হয়।

ট্রাম্প কি এই অভিযোগ স্বীকার বা অস্বীকার করেছেন?
এই অভিযোগের কিয়দাংশ ট্রাম্প নিশ্চিত করেছেন। ট্রাম্প বলেছেন, তিনি জেলেনস্কির সঙ্গে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি দুর্নীতির সমস্যা, বাইডেন ও তার ছেলের ব্যাপারে আলাপ করেছেন। তার ভাষ্য, এটি খুব দারুণ আলাপ ছিল। একেবারে নিখুঁত। তিনি আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই অর্থ ইউক্রেনকে দিচ্ছে। সুতরাং আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে যে তারা যেন সৎ থাকে। টুইটারে ট্রাম্প লিখেছেন, এই বিতর্ক সৃষ্টি করছে মূলত ডেমোক্রেট ও মিডিয়া।

উল্লেখ্য, এই ফোনালাপের বিষয়টি প্রথম গণমাধ্যমে আসে এক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তার অভিযোগের প্রেক্ষিতে। এ ধরণের ব্যক্তিকে বলা হয়, হুইসেলব্লোয়ার। ট্রাম্প ওই হুইসেলব্লোয়ারের দেশপ্রেম নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।

অন্যান্য রাজনীতিকরা কী বলছেন?
কংগ্রেসের ডেমোক্রেটদলীয় সদস্যরা বলছেন, আনুষ্ঠানিক অভিযোগের মাধ্যমে ওই গোয়েন্দা যে ফোনালাপের প্রসঙ্গ তুলেছেন, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, এ থেকে বোঝা যায় প্রেসিডেন্ট কীভাবে বিদেশী নেতাদের সঙ্গে আলাপ করেন। হোয়াইট হাউজের সমালোচকরা বলছেন, ট্রাম্প ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির ওপর চাপ প্রয়োগ করেছেন। তাকে বলেছেন, হান্টার বাইডেনের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড নিয়ে তদন্ত করতে। হান্টার বাইডেন ছিলেন ইউক্রেনের এক ধনকুবেরের মালিকানাধীন একটি কোম্পানির বোর্ড সদস্য। ডেমোক্রেটরা বলছেন, প্রেসিডেন্ট এই তদন্ত করাতে চান যেন এর ফলে হান্টার ও তার পিতা জো বাইডেনের সুনাম ক্ষুন্ন হয়।

রিপাবলিকানরা এই বিতর্ক নিয়ে তেমন কিছু বলছেন না। তবে অন্তত একজন রিপাবলিকান সিনেটর মিট রমনি বলছেন, তিনি এ ব্যাপারে আরও জানার আগে মন্তব্য করবেন না।

ওই হুইসেলব্লোয়ারের দায়ের করা অভিযোগের কী হলো?
ওই অভিযোগ পাওয়ার পর, মহাপরিদর্শক দেশের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জোসেফ ম্যাগুইরেকে জানান। তিনি বলেন, এ বিষয়টি ‘জরুরী।’ মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার হুইসেলব্লোয়ার আইন অনুযায়ী, যদি মহাপরিদর্শক কোনো অভিযোগকে বিশ্বাসযোগ্য ও জরুরী মনে করেন, তাহলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধান ৭ দিনের মধ্যে বিষয়টি কংগ্রেসের গোয়েন্দা সংস্থা বিষয়ক কমিটিকে অবহিত করবেন। কিন্তু জোসেফ ম্যাগুইরে তা করেননি। তিনি একজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেন। ওই আইনজীবী তাকে জানান, আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে ওই ইস্যু জরুরী কিছু নয়। ফলে ম্যাগুইরে সিদ্ধান্ত নেন যে, এটি দেখার প্রয়োজন নেই কংগ্রেসের ওভারসাইট কমিটির।

৯ই সেপ্টেম্বর খোদ মহাপরিদর্শক কংগ্রেসকে ওই অভিযোগের অস্তিত্ব থাকার বিষয়ে অবহিত করেন। তবে তিনি বিস্তারিত জানান নি। এরপর থেকে কংগ্রেসের ডেমোক্রেট দলীয় সদস্যরা আরও তথ্যের জন্য দাবি জানিয়ে আসছেন। তারা ট্রাম্পের ওই ফোনালাপের ট্রান্সক্রিপ্ট চেয়েছেন, তবে প্রশাসন থেকে তা পালন না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবার কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ হাউজ-এর ইন্টিলিজেন্স কমিটির সামনে প্রকাশ্য শুনানিতে অংশ নেবেন ম্যাকগুইরে। কংগ্রেস সদস্যরা হয়তো ওই অভিযোগ দেখতে চাইবেন। কিন্তু ম্যাকগুইরে রাজি না হলে, হাউজ ইন্টিলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম শিফ হয়তো মামলা করবেন।

জো বাইডেন ও তার ছেলের বিরুদ্ধে অভিযোগের কি কোনো সারবত্তা আছে?
ট্রাম্প ও তার আইনজীবী রুডি জিলিয়ানি (যিনি আবার নিউ ইয়র্ক সিটির সাবেক মেয়র) বাইডেন-দ্বয়ের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন, তার মূল ভিত্তি হলো, ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বাইডেন ২০১৬ সালে ইউক্রেনের শীর্ষ সরকারী কৌঁসুলি ভিক্টর শোকিনকে বরখাস্তের দাবি জানান ও এতে সফলও হন।

শোকিনের কার্যালয় থেকে ইউক্রেনিয়ান গ্যাস কোম্পানি বুরিজমা হোল্ডিংস-এর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছিল। তখন বুরিজমা হোল্ডিংস-এর বোর্ড পরিচালক ছিলেন জো বাইডেনের ছেলে হান্টার বাইডেন। এজন্য তিনি মাসে ৫০ হাজার ডলার পেতেন।

ভাইস প্রেসিডেন্ট তখন চাপ দিয়ে ইউক্রেনের সরকারকে বলেছেন, ভিক্টর শোকিনকে সরান না হলে তাদেরকে ১ বিলিয়ন ডলারের যে ঋণ নিশ্চয়তা আমেরিকার দেওয়ার কথা ছিল, তা দেওয়া হবে না। ট্রাম্প, জিলিয়ানি ও অন্যান্যদের অভিযোগ হলো, এই চাপ দেওয়ার মাধ্যমে ভাইস প্রেসিডেন্ট মূলত শোকিনের তদন্ত থেকে বুরিজমা, তথা নিজের ছেলেকে বাঁচাতে চাইছিলেন।

তবে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, জো বাইডেন দুর্নীতি করেছেন বা ইউক্রেনে নিজের ছেলের কাজের কারণে প্রভাবিত হয়েছেন। তবে সমালোচকরা বিশ্বাস করেন, এই ঘটনায় অন্ততপক্ষে এক ধরণের কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট, বা স্বার্থের দ্বন্দ্ব হয়েছে।

তবে এই অভিযোগের বিপক্ষে পালটা যুক্তিও আছে। সেটি হলো, ওই সময় কেবল বাইডেনই শোকিনকে বরখাস্তের দাবি জানাননি। তখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপিয়ান জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারাও শোকিনকে সরানোর দাবি জানিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, শোকিন ওই সময় বুরিজমার বিরুদ্ধে তদন্ত সক্রিয়ভাবে পরিচালনা করছিলেনও না। বরং, বিভিন্ন কোম্পানির মালিকদের কাছ থেকে মামলার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করছিলেন বলে অভিযোগ ছিল। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে ব্যর্থ হওয়া ও নিজেই দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়ে যাওয়ায় পশ্চিমা কমবেশি সকল দেশই তাকে বরখাস্তের দাবি জানিয়েছিল।

শোকিনের স্থলে যিনি এসেছিলেন, সেই ইউরি লুটসেঙ্কো ১০ মাস ধরে বুরিজমার বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়েছিলেন। বুরিজমার বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে তিনি তদন্ত শেষ করেন।

এমআই