রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন দুর্ধর্ষ লুটেরা, হোয়াইট হলে তার মূর্তির কোনও জায়গা নেই

রবার্ট ক্লাইভ ছিলেন দুর্ধর্ষ লুটেরা, হোয়াইট হলে তার মূর্তির কোনও জায়গা নেই

যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর প্রতিবাদে শুরু হওয়া বিক্ষোভ যুক্তরাজ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই আন্দোলনে বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিক শাসন আর দাস ব্যবসায় জড়িত ব্যক্তিদের মূর্তি অপসারণের দাবি উঠেছে। ব্রিস্টলে বিক্ষুব্ধ জনতা দাস ব্যবসায়ী এডওয়ার্ড কোলস্টোনের মূর্তি উপড়ে সেটি সাগরের পানিতে ফেলে ফেলে দিয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র বিক্ষোভ চলছে আফ্রিকায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে ভূমিকা রাখা সেসিল রোডসের মূর্তি সরানোর দাবিতে। এরই ধারাবাহিকতায় দাবি উঠেছে, ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারে ভূমিকা রাখা রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি অপসারণের। যারা এই দাবি জানাচ্ছেন, তাদের মধ্যে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রয়েছেন ব্রিটেনের অনেক বিখ্যাত লেখক ও ইতিহাসবিদ। এদের একজন উইলিয়াম ডালরিম্পল। বিখ্যাত দুটি বই ‘হোয়াইট মুঘলস‌’ এবং ‘দ্য অ্যানার্কি: দ্য রিলেন্টলেস রাইজ অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি‌’- এর লেখক ডালরিম্পল ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে লেখা এক কলামে জোরালো ভাষায় যুক্তি তুলে ধরেছেন রবার্ট ক্লাইভের মূর্তি অপসারণের পক্ষে।

পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো।

ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাতা রবার্ট ক্লাইভ ১৭৭৪ সালে যখন আত্মহত্যা করেন, তখন তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের অন্যতম ঘৃণ্য ব্যক্তিদের একজন। ব্যাপকভাবে নিন্দিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি।

রাতের বেলা গোপন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। তার কবরে পরিচিতিমূলক কোনও ফলক বা চিহ্নও রাখা হয়নি।

ক্লাইভ কোনও সুইসাইড নোট লিখে যাননি। তবে তার আত্মহত্যার পিছনে বহুল প্রচারিত মতটিকেই উদ্ধৃত করে স্যামুয়েল জনসন লিখেছেন, “(ক্লাইভ) এমন সব অপরাধের মাধ্যমে তার ভাগ্য গড়ে তুলেছিলেন, যেগুলো সম্পর্কে তার চৈতন্য শেষমেশ তাকে নিজের গলা কাটতে বাধ্য করেছিল।”

দুই তথ্য ফাঁসকারী ক্লাইভের শাসনের অধীনে বাংলার ধ্বংস ও সম্পদ লুণ্ঠনের মাত্রা প্রকাশ করেছিলেন। আর তার পরই আত্মহত্যা করেন ক্লাইভ। হোরেস ওয়ালপোলে লিখেছেন, “আমরা খুন করেছি, ক্ষমতাচ্যুত করেছি, লুণ্ঠন করেছি এবং দখল করেছি। ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া বিধানের কারণে বাংলার দুর্ভিক্ষে ৩০ লাখ মানুষ মারা যাওয়া’ সম্পর্কে আপনাদের কী ধারণা?”

সেই গ্রীষ্মে, ক্লাইভকে এক অস্থির প্রকৃতির অতিলোভী সাম্রাজ্যবাদী শয়তান, ‘লর্ড ভালচার’ বা শকুনি লর্ড আখ্যা দিয়ে লন্ডনে একটি ব্যঙ্গরচনা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে ক্লাইভ সম্পর্কে বলা হয়– “ন্যায়বিচার এবং মানবতাবিষয়ক যেকোনও অনুভূতির প্রতি সম্পূর্ণ বধির ... যার লোভের কোনও সীমা নেই।”

ক্লাইভ সংক্রান্ত ইস্যু পার্লামেন্টেও উত্থাপিত হয়েছিল। তার সম্পদ ও আভিজাত্য কেড়ে নিতে পার্লামেন্টে আহ্বান জানানো হয়েছিল। নির্বাচক কমিটির হাতে আরও তথ্য ছিল যে, লোভনীয় গোপন লেনদেনের পাশাপাশি বাংলায় দুই মিলিয়ন পাউন্ড মূল্যের উপহার সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছিল। ক্লাইভ ও তার সহচরদের অধিকৃত বিপুল পরিমাণ অর্থ পুনরায় বণ্টনের সুপারিশ করেছিল পার্লামেন্ট। আনুষ্ঠানিক শাস্তি থেকে বেঁচে গেলেও ক্লাইভকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সহিংসতা ও দুর্নীতির দানবীয় মূর্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

পরাজিত কনফেডারেট জেনারেলদের মৃত্যুর অনেকদিন পর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের চিহ্ন হিসেবে তাদের মূর্তি গড়ে তোলা হয়েছিল। সেগুলোকেই আবার নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সময় হুমকির মুখে পড়তে দেখা গেছে। একইভাবে বিশ শতকের গোড়ার দিকে ক্লাইভেরও স্মারক মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। ব্রিটিশ রাজের ভিত্তির বিরুদ্ধে যখন প্রতিরোধ শুরু হলো, তখনই হঠাৎ লর্ড ভালচার বা শকুনি লর্ড রূপান্তরিত হন ভারতবর্ষের বীর ক্লাইভে। কনফেডারেট জেনারেলদের মূর্তিগুলোর উত্থানের মতই সেই সময় এটিও ভীষণ বিতর্কিত বিষয় ছিল।

১৯০৭ সালে ভারতবর্ষ থেকে ফেরার কিছু দিনের মধ্যেই সাবেক ভাইসরয় লর্ড কার্জন ‘পলাশী যুদ্ধের বিজেতা’ লর্ড ক্লাইভের একটি স্মৃতিচিহ্ন স্থাপনের পক্ষে তার ক্যাম্পেইন শুরু করেন। তার উত্তরসূরি লর্ড মিন্টো তখন কার্জনের করা বঙ্গভঙ্গের কারণে সৃষ্ট চরম অস্থিরতাপূর্ণ পরিস্থিতি সামলানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি কার্জনের এই প্রস্তাবে ভীত হয়ে পড়েন এবং একে ‘অহেতুক উস্কানিমূলক’ বলে আখ্যা দেন। ভারতে ব্রিটিশ শাসন বিষয়ক দফতরের সচিবের কার্যালয়ের সামনে মূর্তিটি স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। তিনি মিন্টোর সঙ্গে একমত প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন, ক্লাইভ পলাশী যুদ্ধে পরাজিত হতো বলে এখন মনে হচ্ছে তার।

বর্তমানে ব্রিটিশ সরকারের কেন্দ্রভাগে, একেবারে ডাউনিং স্ট্রিটের পেছনে অবস্থিত পররাষ্ট্র দফতরের বাইরে ক্লাইভের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। যদিও এটি পরিষ্কার যে, ক্লাইভ এমন কোনও ব্যক্তি নন যাকে আজকের দিনে আমরা সম্মান জানাবো। যদিও ওই সময় অনেকে ভেবেছিলেন যে মূর্তিটি তৈরি করাই উচিত হয়নি। এখন এডওয়ার্ড কোলস্টনের (মূর্তির) পতনের পরে আমরা গুরুত্বপূর্ণ এক সন্ধিপথে এসে দাঁড়িয়েছি। অবশ্যই এই মূর্তিটিকে জাদুঘরে পাঠানোর মুহূর্ত এসে গেছে। ব্রিটিশ অতীতের অন্ধকারতম অধ্যায়গুলো সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

যেসব ব্রিটিশ নাগরিকদের দাদা-দাদি সাবেক কলোনিগুলো থেকে এসেছিলেন এই মূর্তিটি তাদের জন্য যে প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ হিসেবেই শুধু দাঁড়িয়ে আছে তা নয়, পররাষ্ট্র দফতরের বাইরে এর উপস্থিতির কারণে উপনিবেশ স্থাপনকারীদের বংশধররা আরও বেশি করে বিপজ্জনক নব্য-সাম্রাজ্যবাদী আকাঙ্ক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়তে পারে।

এখনও ব্রিটেনে ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতে সাম্রাজ্যবিষয়ক পাঠ ব্যাপকভাবে অনুপস্থিত। এই ইতিহাস এখনও টিউডর থেকে নাৎসি, হেনরি থেকে হিটলার আর উইলিয়াম উইলবারফোর্স ও ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের পরিচিতির সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আকারে আছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের এমন ধারণা দেওয়া হয় যে, ব্রিটিশরা সবসময় দেবদূতদের পক্ষে ছিল। আমাদের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার অনুষঙ্গ হিসেবে যে নৃশংসতা আর শোষণের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে তা সম্পর্কে আমরা প্রায় পুরোপুরি অজ্ঞ থেকে গেছি। অন্য যেকোনও সময়ের তুলনায় এখন আরও ভালোভাবে আমাদের যে বিষয়টি বোঝা দরকার তা হলো, ইতিহাসের বড় অংশজুড়ে আমরা ছিলাম আগ্রাসী বর্ণবাদী এবং সম্প্রসারণবাদী শক্তি; যারা প্রতিটি মহাদেশে সহিংসতা, অবিচার এবং যুদ্ধাপরাধের জন্য দায়ী।

আমাদের আরও জানা দরকার, জার্মানদের মতো ব্রিটিশরাও কীভাবে বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের একটি পদ্ধতিগত কাঠামো তৈরি করতে ভূমিকা রেখেছিল। ক্রমক্ষমতাতান্ত্রিক বর্ণবাদী কাঠামো তৈরি করেছিল তারা। যার উপরের দিকে রাখা হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ ককেশীয়দের আর নীচের দিকে ছিল কৃষ্ণাঙ্গ, ভবঘুরে ইহুদি ও ভারতীয় মুসলমানেরা। যখন জার্মানরা তাদের অতীতের অন্ধকারতম সময় নিয়ে অবগত হয়েছে এবং তাদের স্কুলগুলোতে অকপটে এই ইতিহাস পড়ানো হচ্ছে, তখন আমরা এই প্রক্রিয়ার শুরুটা পর্যন্ত করতে পারিনি। এর বদলে আমরা জানতে পারছি যে, জার্মান ও বেলজিয়ান সাম্রাজ্য ছিল গভীরভাবে পাপে পূর্ণ। সেখানে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ রাজ সম্পর্কে আমরা এরকম ভাবতে পছন্দ করি যে, এটি ছিল মার্চেন্ট আইভরি ফিল্মের মতো হিন্দুস্তানের সমতল ভূমিজুড়ে বিস্তৃত গোলাপ, ছোট ছোট ছাতার নিচে শিমলার চা-চক্র,বন্ধুত্বপূর্ণ হাতির দল আর ক্রোকোয়েট খেলারত সুদর্শন মহারাজার সমাহার।

এটি একটি সত্যিকারের সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সবকিছু নিয়ে আমাদের বিপুল অজ্ঞতা বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী অতীতকে এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টি প্রতিনিয়ত বাকি বিশ্বের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নির্দিষ্ট করে বললে সাম্রাজ্যবাদী অতীতের বিস্মৃতি আমাদেরকে ব্রেক্সিট নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে উৎসাহিত করেছে। ব্রেক্সিটাররা যে ফ্যান্টাসিতে ভুগছে বাস্তবে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাবে। আমাদের সাবেক কলোনিগুলো আমাদেরকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবে না। ৭০ বছর ধরে গ্যারেজে পড়ে থাকা একটা পুরনো মোটরবাইকের মতো আমরাও সাম্রাজ্যটিকে পুনরায় চালু করতে পারব না। কমনওয়েলথ দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি শুরু করার চেষ্টাকে সিভিল সার্ভিসের অনেকে দ্বিতীয় সাম্রাজ্যবাদ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

বিশেষ করে ব্রিটিশ শাসন নিয়ে ভারতবর্ষের মানুষের তিক্ত স্মৃতি রয়েছে। তাদের দৃষ্টিতে লুটেরা হিসেবে আমাদের আগমন হয়েছিল এবং তাদেরকে আমরা বহু শতাব্দীর লাঞ্ছনার শিকারে পরিণত করেছি। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানগুলিও সেকথাই বলে। ১৬০০ সালে যখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তখন ব্রিটেন বিশ্বের জিডিপির ১.৮% উৎপাদন করত আর বৈশ্বিক জিডিপিতে ভারতবর্ষের অবদান ছিল ২২.৫%। ব্রিটিশ রাজের উত্থানের মধ্য দিয়ে সেই পরিসংখ্যানগুলি কমবেশি ওলট-পালট করে দেওয়া হয়েছিল। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় উত্পাদনকারী অঞ্চল থেকে দুর্ভিক্ষ ও বঞ্চনার প্রতীকে পরিণত হয়েছিল ভারতবর্ষ।

ডাউনিং স্ট্রিটের পেছন থেকে ক্লাইভের মূর্তি সরিয়ে ফেলার মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা শিক্ষা এবং প্রায়শ্চিত্তের প্রক্রিয়া শুরুর সুযোগ পেতে পারি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের শেষে ভারতবর্ষের মানুষ সমস্ত সাম্রাজ্যবাদী মূর্তিগুলি সরিয়ে নিয়ে শহরতলির পার্কগুলিতে রাখে। যেখানে মূর্তিগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে। সেগুলো পড়ার মধ্য দিয়ে যথাযথভাবে ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। আমরা একই কাজ করতে পারতাম। পর্যায়ক্রমে ক্লাইভ এবং তার মতো অন্যদের মূর্তিগুলোকে একটি জাদুঘরে রেখে দিতে পারতাম। ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বহুল আলোচিত ও বিপুল সংগ্রহশালার ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আফ্রিকান আমেরিকান হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার জাদুঘরের মতো করেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যেতো। এর মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত আমরা আমাদের কৃতকর্মের মুখোমুখি হতে পারব। আমাদের ক্ষমা চাওয়া দরকার এমন অনেক কিছুর জন্য ক্ষমা চাওয়ার প্রক্রিয়াটা শুরু করতে পারব। একমাত্র তখনই আমরা সাম্রাজ্যবাদী অতীতের ভারী বোঝা থেকে মুক্ত হয়ে ঠিকমত এগিয়ে যেতে পারব।

এমজে/