'একটি নির্বাচনেই যুক্তরাষ্ট্রে সত্যের অবক্ষয় থামানো যাবে না'

'একটি নির্বাচনেই যুক্তরাষ্ট্রে সত্যের অবক্ষয় থামানো যাবে না'

সাবেক যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, আমেরিকার সামনে এক বিশাল বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটিকে 'পাগলাটে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের‌' সংস্কৃতি থেকে উল্টোপথে ফেরানো। তার মতে, এসব 'ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' আমেরিকার বিভক্তিকে আরও মারাত্মক করে তুলেছে।

বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, চার বছর আগে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এখন তার চেয়ে আরও বেশি বিভক্ত।

মিস্টার ওবামা বলেছেন, ২০২০ সালের নির্বাচনে জো বাইডেন জয়ী হলেও এই বিভেদ দূর করার কাজ শুরু হয়েছে মাত্র।

তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রে এই ধারাকে উল্টো দিকে ফেরাতে একটা নির্বাচনে জেতা যথেষ্ট নয়, এর জন্য আরও অনেক কিছু করতে হবে।

তিনি বলেন, চরমভাবে দুটি শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়া একটি জাতিকে এক করার কাজটি কেবল রাজনীতিকদের সিদ্ধান্তের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। এর জন্য দরকার হবে একদিকে অনেক কাঠামোগত পরিবর্তন‌। অপরদিকে মানুষকে একে অন্যের কথা শুনতে হবে। আর যে কোন বিতর্কে লিপ্ত হওয়ার আগে কিছু অভিন্ন 'প্রকৃত সত্যের' ব্যাপারে একমত হতে হবে।

তবে মিস্টার ওবামা বলছেন, তিনি পরবর্তী প্রজন্মের 'পরিশীলিত' দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা 'বিরাট আশা' দেখতে পাচ্ছেন। তিনি তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এই 'সতর্ক আশাবাদ' যেন তারা লালন করে। তারা যেন বিশ্বাস করে যে পরিবর্তন আনা সম্ভব এবং তারা যেন সেই পরিবর্তনের অংশীদার হয়।

আমেরিকায় কীভাবে বিভেদে উস্কানি দেয়া হচ্ছে?

বারাক ওবামা তার নতুন প্রকাশিত স্মৃতিগ্রন্থ নিয়ে কথা বলতে বিবিসির আর্টস অনুষ্ঠানকে এই সাক্ষাৎকারটি দিয়েছেন। এটি নিয়েছেন ইতিহাসবিদ ডেভিড ওলুসোগা।

সাক্ষাৎকারে মিস্টার ওবামা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে শহর এবং পল্লী অঞ্চলের মধ্যে এবং অভিবাসন এবং অবিচার নিয়ে যে ধরণের অসন্তোষ এবং ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে, যেভাবে নানা রকম 'মাথা খারাপ ষড়যন্ত্র তত্ত্ব' ছড়িয়ে পড়েছে- যাতে অনেকে সত্যের অবক্ষয় বলে বর্ণনা করছেন, তা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে কিছু গণমাধ্যম। আর এসবের আরও বেশি ইন্ধন দিয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া।

"এই মূহুর্তে আমরা খুবই বিভক্ত, আমি যখন ২০০৭ সালে প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়াই এবং ২০০৮ সালে নির্বাচনে জিতি, সেই সময়ের চেয়ে অনেক বেশি বিভেদ এখন আমাদের মাঝে।"

বারাক ওবামা বলছেন, এর জন্য অংশত দায়ী মিস্টার ট্রাম্প। কারণ তিনি ইচ্ছে করে এই বিভেদে হাওয়া দিয়েছেন, যা থেকে তিনি রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চেয়েছেন।

তার মতে এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় ব্যাপকভাবে দায়ী। এটি হচ্ছে অনলাইনে ব্যাপক অপপ্রচার, যেখানে 'প্রকৃত সত্য' নিয়ে যেন কারও কিছু আসে-যায় না।

"লাখ লাখ মানুষ আছে, যারা বিশ্বাস করে জো বাইডেন হচ্ছেন একজন সমাজতন্ত্রী। বহু মানুষ আছেন যারা বিশ্বাস করেন হিলারি ক্লিন্টন এমন এক গুপ্তচক্রের সদস্য, যারা শিশুদের ওপর যৌন-নিপীড়ন চালায়", বলছেন মিস্টার ওবামা।

বারাক ওবামা এখানে হিলারি ক্লিন্টনের যে উদাহরণটি দিয়েছেন, সেটি এক ভুয়া ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এতে দাবি করা হয় যে, ডেমোক্রেটিক পার্টির রাজনীতিকরা ওয়াশিংটনের একটি পিৎজা রেস্তোরা থেকে এক 'পিডোফাইল চক্র' (শিশুদের যৌন সম্ভোগে আসক্ত ব্যক্তিদের চক্র) পরিচালনা করে। হিলারি ক্লিন্টন এই চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে দাবি করা হয় এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বে।

"আমার মনে হয় একটা পর্যায়ে আমাদেরকে কিছু নিয়ন্ত্রণ এবং মানদণ্ডের ব্যাপারে একমত হতে হবে। যাতে করে আমরা আগের সেই অবস্থায় ফিরে যেতে পারি, যেখানে আমরা যে কোন বিষয়ে তর্কে লিপ্ত হওয়ার আগে অন্তত কিছু অভিন্ন 'প্রকৃত সত্যের' ব্যাপারে একমত হতে পারবো।"

মিস্টার ওবামা বলেন, যদিও কিছু মূলধারার গণমাধ্যম অনলাইনে মিথ্যে অপপ্রচার মোকাবেলায় 'ফ্যাক্ট চেক' বা আসল সত্য যাচাই করার কাজ শুরু করেছে, সেটা যথেষ্ট নয়। কারণ "গণমাধ্যমের 'ফ্যাক্ট চেকের' কাজ শেষে সত্য যতক্ষণে দরোজা দিয়ে বেরুচ্ছে, মিথ্যে ততক্ষণে গোটা পৃথিবী ঘুরে এসেছে।"

তিনি আরও বলেন, আমেরিকায় এই বিভেদের পেছনে আছে একই সঙ্গে অনেক আর্থ-সামাজিক কারণ। যেমন আমেরিকার শহর এবং পল্লী অঞ্চলের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বৈষম্য।

মিস্টার ওবামা বলেন, এই সমস্যা কেবল আমেরিকার নয়, যুক্তরাজ্য সহ বিশ্বের অনেক জায়গাতেই একই ঘটনা ঘটছে।

 

"লোকের মনে হচ্ছে, তাদের সামনে থেকে অর্থনৈতিকভাবে উপরে ওঠার সিঁড়িটা যেন সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এসব লোককে তখন বোঝানো সহজ যে তাদের এই বঞ্চনার জন্য দায়ী হচ্ছে এই বিশেষ গোষ্ঠী বা ঐ গোষ্ঠী।"

'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আন্দোলন সম্পর্কে কি বলছেন তিনি?

বারাক ওবামা ইতিহাস তৈরি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হওয়ার মাধ্যমে।

তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে সবচেয়ে মৌলিক একটি বিভাজন রেখা হচ্ছে বর্ণ বিভেদ। 'এটি হচ্ছে আমাদের আদি পাপ', বলছেন তিনি।

জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে তীব্র বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে।

এবছরের গ্রীষ্মে পুলিশ হেফাজতে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গের মৃত্যু এবং একে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র এবং সারা বিশ্বে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল সেটির কথা উল্লেখ করেন তিনি।

মিস্টার ওবামা বলেন, ঐ ঘটনা একই সঙ্গে এক চরম হতাশা এবং ব্যাপক আশাবাদ তৈরি করেছিল।

"নৈরাশ্য এই কারণে যে, আমাদের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এখনো এত নির্লজ্জভাবে বর্ণ-বিভেদ এবং পক্ষপাত টিকে আছে। আবার অন্যদিকে একটি এক বিরাট আশা তৈরি করেছিল, যখন এর বিরুদ্ধে বিরাট আকারে বিক্ষোভ এবং আন্দোলন শুরু হলো, যা আমরা আগে কখনো দেখিনি। এবং এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ।"

"এই বিক্ষোভে যেন সব জাতি-বর্ণের মানুষ অংশ নেয়, সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল", বলছেন তিনি।

বারাক ওবামা বলেন, ২০১২ সালে ফ্লোরিডায় ট্রেভন মার্টিন নামে এক নিরস্ত্র তরুণকে যখন জর্জ জিমারম্যান নামে স্থানীয় এক স্বেচ্ছাসেবী নিরাপত্তা রক্ষী গুলি করে হত্যা করে, তার তুলনায় এবারের বিক্ষোভ ছিল আলাদা। বহুল আলোচিত সেই ফৌজদারি মামলায় ১৭ বছর বয়সী ঐ তরুণকে হত্যার দায় থেকে মিস্টার জিমারম্যানকে পরে অব্যাহতি দেয়া হয়েছিল।

মিস্টার ওবামা ২০১৪ সালে মিসৌরিতে ১৮ বছর বয়সী নিরস্ত্র এক কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ মাইকেল ব্রাউনকে হত্যার ঘটনাও উল্লেখ করেন। ফার্গুসন শহরে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার মাইকেল ব্রাউনের ওপর ছয়বার গুলি চালায়।

 

তিনি বলেন, এসব ঘটনা পুরো আমেরিকা জুড়ে মানুষের আবেগকে নাড়া দিয়েছে, বর্ণভেদ এবং ন্যায় বিচার নিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়েছে। কিন্তু তিনি বলছেন, এখনো যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গদের একটি বিরাট অংশ এখনো যেন মনে হচ্ছে একথা মেনে নিতে নারাজ যে সেখানে কোন বর্ণ-বিভেদ বা অবিচার রয়েছে। "তারা এসব ঘটনাকে দেখে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বা কোন একজন খারাপ লোকের কাজ হিসেবে।"

"এই গ্রীষ্মে দেখা গেল যেসব শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত এলাকায় খুবই কম সংখ্যায় কৃষ্ণাঙ্গরা থাকেন, সেখানেও সবাই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে অংশ নিলেন, বললেন, কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনেরও দাম আছে। সত্যিকারের পরিবর্তন যে আসতে হবে, সেকথা তারাও বললেন।"

মিস্টার ওবামা বিবিসিকে এই সাক্ষাৎকার দেন তার নতুন স্মৃতিগ্রন্থ 'অ্যা প্রমিজড ল্যান্ডের' প্রকাশনার আগে। কীভাবে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটে এবং প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, সেটি নিয়ে এই বই।

১৭ই নভেম্বর বইটি প্রকাশিত হবে। হোয়াইট হাউসে তার শাসনকাল নিয়ে যে দুটি বই তিনি লিখছেন, এটি হচ্ছে তার প্রথমটি।