যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান খাশোগির হত্যাকান্ডের অনুমোদন দেন:যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন

যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান খাশোগির হত্যাকান্ডের অনুমোদন দেন:যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ২০১৮ সালে, নির্বাসিত সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে হত্যার অনুমোদন দিয়েছিলেন বলে যুক্তরাষ্ট্রর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় শুক্রবার বাইডেনের প্রশাসন এই সংক্রান্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

সেখানে বলা হয়েছে যে, তুরস্কের ইস্তানবুলে গিয়ে খাসোগজিকে "ধরতে বা খুন" করতে যে অভিযান চালানো হয়েছিল, যুবরাজ মোহাম্মদ ওই পরিকল্পনার অনুমোদন দিয়েছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্র বেশ কয়েকজন সৌদি নাগরিকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও খোদ যুবরাজের ওপর এমন কোন নিষেধাজ্ঞা নেই।

সৌদি আরব এই প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করে বলেছে যে এটি "নেতিবাচক, মিথ্যা এবং অগ্রহণযোগ্য"।

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ, যিনি কার্যত দেশটির শাসক, তিনিও এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

খাসোগজি যখন তুরস্কের ইস্তানবুলে সৌদি কনস্যুলেটে গিয়েছিলেন তখনই তাকে হত্যা করে তার দেহ খণ্ড বিখণ্ড করা হয়।

৫৯ বছর বয়সী এই সাংবাদিক একসময় সৌদি সরকারের উপদেষ্টা এবং রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন।

তবে এক পর্যায়ে তিনি সব আনুকূল্য হারান এবং ২০১৭ সালে নিজেই যুক্তরাষ্ট্রে নির্বাসনে চলে যান।

সেখান থেকে তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে একটি মাসিক কলাম লিখতেন, যেখানে তিনি যুবরাজ মোহাম্মদের নীতির সমালোচনা করেন।

প্রতিবেদনে কী লেখা আছে?
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ডিরেক্টর অব ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, "আমরা ধারণা করছি সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান ইস্তানবুলে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে গ্রেফতার বা হত্যার জন্য একটি অভিযানের অনুমোদন দিয়েছিলেন,"

ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ হলেন সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদের ছেলে এবং দেশটির বর্তমান শাসক।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিতে এমন ধারণার পেছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করা হয়, যা এটা পরিষ্কার করে যে ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদই ওই অভিযানের অনুমোদন দিয়েছিলেন।

২০১৭ সাল থেকে সৌদি আরবের সব সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার একক নিয়ন্ত্রণ।
ওই অভিযানে প্রিন্স মোহাম্মদের একজন উপদেষ্টা সেইসঙ্গে তার প্রতিরক্ষা দলের সদস্যের সরাসরি সম্পৃক্ত থাকা।
বিদেশে নির্বাসনে থাকা ব্যক্তিদের মুখবন্ধ রাখতে সহিংস পদক্ষেপ গ্রহণের পক্ষে প্রিন্স মোহাম্মদের সমর্থন দেয়া।
এই প্রতিবেদনে খাসোগজির হত্যার সাথে জড়িত বা দায়ী ব্যক্তিদের নাম দেওয়া হয়েছে।

তবে এতে বলা হয়েছে, "খাসোগজির ক্ষতি করার পরিকল্পনায় আর কারা কারা সামিল ছিল সেটা এখনও আমরা পুরোপুরি জানি না।

সৌদি কর্তৃপক্ষ এই হত্যার পেছনে, একদল এজেন্টকে দোষারোপ করছে, যারা বিরোধীদের বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছিল।

এছাড়া সৌদি আদালত প্রাথমিকভাবে পাঁচ ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দিলেও গত সেপ্টেম্বরে বিচারক সেই সাজা কমিয়ে প্রত্যেককে ২০ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে।

২০১৯ সালে, জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাগনেস ক্যালামার্ডের অভিযোগ, সৌদি আরব ইচ্ছাকৃতভাবে এবং আগে থেকে পরিকল্পনা করেই খাসোগজিকে হত্যা করেছে।

সেইসঙ্গে এ ঘটনায় সৌদি আরবের আদালত যে রায় দিয়েছে তা "ন্যায়বিচারের পরিপন্থী" উল্লেখ করে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

যুক্তরাষ্ট্র-সৌদি সম্পর্কে, এই ঘটনা কী বার্তা দেয়?
এই প্রতিবেদন প্রকাশের অল্প সময়ের মধ্যেই, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন কয়েকজন সৌদি নাগরিকের উদ্দেশ্যে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করেন। যাকে "খাসোগজি ব্যান" বলা হয়।

মি. ব্লিংকেন বলেন, "যাদেরকে উদ্দেশ্য করে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তারা নিজ দেশের বাইরেও ভিন্নমত দমনে ভয়াবহ সব কার্যকলাপের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত।"

"যেসব অপরাধী কোন বিদেশি সরকারের হয়ে ভিন্নমতের মানুষদের লক্ষ্যবস্তু বানায়, তাদেরকে আমেরিকান মাটিতে পা রাখতে দেয়া হবে না," তিনি সতর্ক করেন।

এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগও ক্রাউন প্রিন্সের আশেপাশের কিছু ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

এরমধ্যে রয়েছে: তার অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী, সাবেক উপ গোয়েন্দা প্রধান আহমাদ আসিরি, সেইসঙ্গে তার ব্যক্তিগত সুরক্ষায় নিয়োজিত বাহিনী, যারা হত্যার সাথে জড়িত ছিল অভিযোগ রয়েছে।

২০১৮ সালে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ধারণা করেছিল যে ক্রাউন প্রিন্সই এই হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন।

তবে তিনি যে জড়িত ছিলেন সে অভিযোগ মার্কিন কর্মকর্তারা এখন পর্যন্ত প্রকাশ্যে বলেননি।

বিশ্বের বৃহত্তম তেল রফতানিকারী দেশ সৌদি আরব মধ্য প্রাচ্যে আমেরিকার প্রধান মিত্র।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবের মানবাধিকার এবং আইনের শাসনের বিষয়ে তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে দৃঢ় অবস্থান নেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

বৃহস্পতিবার বাদশাহ সালমানের সাথে ফোনালাপ করেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

"যুক্তরাষ্ট্র যে সার্বজনীন মানবাধিকার এবং আইনের শাসনকে গুরুত্ব দিয়ে থাকে", বাইডেন সেই বিষয়টি ফোনালাপে নিশ্চিত করেছেন বলে জানিয়েছে হোয়াইট হাউস।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের বরাতে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে যে, সৌদি আরবের সাথে অস্ত্র চুক্তি বাতিল করার বিষয়েও বাইডেন প্রশাসন চিন্তাভাবনা করছে। কারণ এই চুক্তি মানবাধিকারকে উদ্বেগের মুখে ফেলেছে।

ভবিষ্যতে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রয় শুধুমাত্র "প্রতিরক্ষামূলক" অস্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বিষয়টিও বিবেচনা করছে বাইডেন প্রশাসন।

যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জোর দিয়ে বলেছে যে, এই অপরাধের পেছনে দায়ীদের খুঁজে বের করতে যথাযথভাবে তদন্ত করা হয়েছে এবং ন্যায়বিচারের করা হয়েছে।

"এটা সত্যিই দুঃখজনক যে এই প্রতিবেদনটি যেসব তথ্য দিয়েছে সব অযৌক্তিক ও ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

"এবং এই ত্রুটিপূর্ণ প্রতিবেদনটি এমন সময় প্রকাশ করা হল যখন সৌদি আরব এই জঘন্য অপরাধের স্পষ্ট নিন্দা জানিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে যাতে এ ধরণের ঘটনা আর না ঘটে।"

সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, দেশটির নেতৃত্ব, সার্বভৌমত্ব এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে এমন সব পদক্ষেপও তারা প্রত্যাখ্যান করছে।

বিশ্লেষণ, বারবারা প্লেট উশার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংবাদদাতা
এ ঘটনায় মোহাম্মদ বিন সালমান সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়লেও তিনি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে পার পেয়ে গেছেন।

যদিও তাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে কংগ্রেসের ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধি, জাতিসংঘের বিশেষ রিপোর্টার অ্যাগনেস ক্যালামার্ডসহ বহু অ্যাকটিভিস্ট আহ্বান জানিয়েছিল।

এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন খুব সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নিচ্ছেন। তিনি তার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সৌদি আরবকে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী করতে চান তেমনি আবার সৌদি আরবের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চান।

কারণ মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে সৌদি আরব বেশ বড় ভূমিকায় আছে যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: ইয়েমেনের যুদ্ধ শেষ করা, ইরানকে পুনরায় পরমাণু চুক্তিতে যুক্ত করা, ইসলামপন্থী চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং আরব-ইসরায়েলি সম্পর্ককে এগিয়ে নেয়া।

তবে প্রেসিডেন্ট স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তার পূর্বসূরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো যুবরাজ মোহাম্মদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করবেন না।

এর পরিবর্তে মি. বাইডেন তার বাবা বাদশাহ সালমানের সাথে কাজ করছেন।

খাসোগজিকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল?
খাসোগজি তার তুর্কি বাগদত্তাকে বিয়ে করার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে, ২০১৮ সালের অক্টোবরে তুরস্কের সৌদি কনস্যুলেটে যান।

ক্রাউন প্রিন্সের ভাই প্রিন্স খালিদ বিন সালমানের কাছ থেকে তিনি এই আশ্বাস পান যে, কনস্যুলেটে যাওয়াটা তার জন্য নিরাপদ হবে।

সে সময় প্রিন্স খালিদ, যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।

যদিও প্রিন্স খালিদ ওই সাংবাদিকের সাথে তার যোগাযোগের বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।

সৌদি আইনপ্রণেতাদের মতে, খাসোগজি আত্মরক্ষার চেষ্টা করলে তার সঙ্গে খুনিদের ধস্তাধস্তি হয়।

এক পর্যায়ে তারা জোর করে খাসোগজির শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে প্রচুর ওষুধ দেয়।

অতিরিক্ত মাত্রার ওষুধের ফলে খাসোগজি সেখানেই মারা যান।

এরপর তার দেহটি খণ্ড বিখণ্ড করা হয় এবং ওই টুকরোগুলো কনস্যুলেটের বাইরে থাকা স্থানীয় একটি সহযোগীর কাছে দেয়া হয়, আইনপ্রণেতারা বলেছেন।

খাসোগজির দেহাবশেষ কখনও পাওয়া যায় নি।

তুরস্কের গোয়েন্দা বিভাগ হত্যাকাণ্ডের অডিও রেকর্ডিংটি সামনে আনার পর সেটার লিখিত প্রতিবেদনে বিশদ বিবরণ প্রকাশ পায়।-বিবিসি

এমজে/