আরাফাত হত্যায় যেভাবে চেষ্টা চালিয়েছিল ইসরায়েল

আরাফাত হত্যায় যেভাবে চেষ্টা চালিয়েছিল ইসরায়েল

ঢাকা, ২৩ মার্চ (জাস্ট নিউজ) : লেবাননের রাজধানী বৈরুত। বেশ গরম পড়েছে। এরই মধ্যে গাড়ির সারি কাঁটাতারের বেড়া আর কংক্রিটের ব্লক ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর চলে গেছে। ১৯৮২ সালের ইসরাইল-লেবানন যুদ্ধে এক দিনের বিরতি চলছে, আর এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হাজার হাজার মানুষ শহরের পূর্ব ও পশ্চিমে আসা-যাওয়ার চেকপয়েন্টগুলোতে হাজির হয়েছেন - ওইসব চেকপয়েন্ট, যেগুলো শহরটিকে পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ করেছে।

এদের একজন ইউরি আভনেরি। রূপালী চুলের ভদ্রলোকের ওপর আদেশ হয়েছে বৈরুত জাদুঘরের কাছে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)’র একটি চেকপোস্টে সশরীরে হাজির হতে হবে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই আভনেরি হবেন প্রথম ইসরাইলী, যিনি আনুষ্ঠানিকভাবে পিএলও নেতা ইয়াসির আরাফাতের সাথে দেখা করেছেন।

নিজের দেশ যাকে সবচেয়ে বড় শত্রু বলে মনে করে, তার সাথে যেভাবে দেখা হয়েছিল তা স্মরণ করেন আভনেরি। তিনি স্বীকার করেন, ‘একটু বিপজ্জনক ছিল’ ।

একটি সাঁজোয়া মার্সিডিজ গাড়ি তাকে তুলে নেয়, আর এরপর একেবারে আকাবাঁকা পথ বেয়ে দক্ষিণ বৈরুতে একটি পিএলও ভবনে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেও যায়। আভনেরি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই কথা বলেছিলাম শান্তি নিয়ে - ইসরাইল এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের মধ্যে শান্তি’। কিন্তু ইয়াসির আরাফাতের সাথে বৈঠকটি আভনেরির বামপন্থী ম্যাগাজিনের জন্যে কেবল একটি হৈচৈ ফেলা খবরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তিন দশক পরে এই গল্পের আরও অনেক কিছু এখন বেরিয়ে আসছে। অভিযোগ উঠেছে যে ইসরাইলী কমান্ডোরা পিএলও নেতার সাথে তাদের দেশি মানুষটির বৈঠকটি অনুসরণ করার চেষ্টা করছিলো। এমনকি তাদের প্রস্তুতিও ছিল একে লক্ষ্যবস্তু বানানোর।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি বইয়ে ইসরাইলী সাংবাদিক রনেন বার্গম্যান পিএলও প্রধানকে হত্যার অনেকগুলো চেষ্টার কথা লিখেছেন। বইটিতে ইসরাইল কর্তৃক সুনির্দিষ্ট হত্যাকাণ্ড ঘটানোর বিবরণ রয়েছে। বার্গম্যান ঘটনা জানতেন এমন অনেক মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। তবে এটা বিতর্কও উস্কে দিয়েছে। কারণ পুরো বিষয়টি ইসরাইলে মোটামুটি গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত। তিনি বলছেন, তার গবেষণার সময় একজন সেনাপ্রধান তাকে ‘উত্ত্যক্তকারী গুপ্তচরবৃত্তি’র অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। বার্গম্যান লিখেছেন, ১৯৮২ সালে যখন বৈরুত অবরোধ করা হয়, তখন ‘সল্ট ফিশ’ কোডনামের একটি অভিজাত কমান্ডো ইউনিট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল - উদ্দেশ্য ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করা।

তিনি দাবী করছেন যে, পিএলও নেতার সাথে ইউরি আভনেরির বৈঠকের সুযোগ নিতে চেয়েছিল এই ইউনিট। তারা চেয়েছিল ওই সাংবাদিক ও তার দুই সহকর্মী অজান্তেই তাদেরকে ইয়াসির আরাফাতের সন্ধান দিক। বার্গম্যান লিখেছেন : ‘সল্ট ফিশ টিমের মধ্যে এমন একটি তর্ক বেঁধে যায় যে ইসরাইলী নাগরিকদের বিপদে ফেলা - যার পরিণতি সম্ভবত মৃত্যু - কতটা সঠিক? উত্তর ছিল - তাদের সিদ্ধান্ত মতে - হ্যা সঠিক।’

তবে তার দাবি হলো, সল্ট ফিশের সদস্যরা শেষ পর্যন্ত বৈরুতের অলিগলিতে সাংবাদিকদের হারিয়ে ফেলেন। ইউরি আভনেরি এখনও ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে তার আলোচনার সবকিছু স্মরণ করতে পারেন। কারণ তিনি ‘প্রতিটি শব্দ প্রকাশ’ করেছিলেন। তার বয়স এখন ৯৪। তেলআবিবে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে তিনি বিবিসি’র টম বেটম্যানের সঙ্গে কথা বলেন। তার ওই অ্যাপার্টমেন্টের দেয়ালে টাঙ্গানো আরাফাত, বিল ক্লিনটন এবং হত্যাকাণ্ডের শিকার ইসরাইলের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আইজাক রবিনের অনেক ছবি - ওইসব ব্যক্তি যারা মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির পরিকল্পনা করেছিলেন।

১৯৮২ সালে তার আরাফাতের সাক্ষাৎকার নেয়ার বিষয়টি অনেক ইসরাইলীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। তিনি বলছেন, সরকার একটি তদন্ত করারও নির্দেশ দিয়েছিল। ‘অ্যাটর্নি জেনারেলের সিদ্ধান্ত ছিল আমি কোন আইন ভাঙিনি। কারণ ওই সময় এমন কোনো আইন ছিল না যে পিএলও’র সাথে কোনো ধরনের বৈঠক করা যাবে না।’

কিন্তু অভিযোগ উঠেছে যে, ইয়াসির আরাফাতের সাথে ওই বৈঠক এমনকি তার প্রাণ যাওয়ারও কারণও হতে পারতো? তিনি বলেন, ‘আমার অবশ্য এ ব্যাপারে খানিকটা সন্দেহ আছে’, বলছিলেন আভনেরি। তার ব্যাখ্যা, তিনি বৈঠকটি হওয়ার ২৪ ঘন্টারও কম সময় আগে ফোন করে এটির আয়োজন করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘কিন্তু তারা যদি খুব দক্ষ হতো, তাহলে তারা ফোনে আমাদের কথা শুনতে পারতো, এরপর যেখানে আমি সীমানা পেরিয়েছি, সেখান থেকে তারা আমাদের গাড়ি অনুসরণ করতে পারতো। এটা সম্ভব ছিল।’ সল্ট ফিশ ইউনিটের প্রধান ছিলেন লেফটেনান্ট কর্নেল উজি দায়ান, যিনি এক সময় ইসরাইলী সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান হয়েছিলেন।

তিনি বিবিসি’র টম বেটম্যানকে বলেন যে, তার টিম আট থেকে দশটি চেষ্টা চালিয়েছিল ইয়াসির আরাফাতকে হত্যা করতে। বেসামরিক মানুষ এসব হামলায় মারা গিয়েছিল কি-না, এমন এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি যতদূর জানি, না’।

তবে তিনি আরো বলেন : ‘নিরাপরাধ মানুষের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তার লোকজন কি নিরাপরাধ? না। তার কোনো অফিসারের স্ত্রী নিরাপরাধ? সেটা চিন্তা করা যেতে পারে এবং তিনি যদি সাথে করে একটি শিশু নিয়ে আসেন? সুতরাং আমি যদি জানতাম যে সেখানে কোনো বেসামরিক মানুষ আছে, তাহলে আমরা তাকে লক্ষ্যবস্তু বলতাম না। কিন্তু আপনি জানেন, যুদ্ধ একেবারেই অন্ধ। আপনি বলতে পারবেন না যে, কোনো একটি এলাকায় একটি মানুষও আহত হবে না।’

বৈরুতে ইসরাইলের অবরোধ এতটা কঠোর ছিল যে মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনের ক্ষমতা খর্ব করেছিলেন। করণেল দায়ান তার নিজের মিশন সম্পর্কে আপসহীন ছিলেন। তিনি স্মরণ করছিলেন পিএলও’র হাতে ইসরাইলীদের সহিংস মৃত্যু অথবা লেবানন থেকে পিএলও’র সহযোগী কোনো বাহিনীর হামলার কথা। কিন্তু রনেন বার্গম্যান যে অভিযানের কথা লিখেছেন, তার পেছনে নিজের ইউনিটের কেউ জড়িত ছিল এমন অভিযোগ তিনি নাকচ করে দেন।

তিনি বলেন, ‘এটা একেবারে একটা পাগলাটে একটি ধারণা যে, একজন ইসরাইলী কর্মকর্তা, কিংবা একজন ইসরাইলী প্রতিরক্ষামন্ত্রী বা একজন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আরাফাতকে হত্যার অনুমোদন দেবেন। আবার একই সাথে ইউরি আভনেরির মতো ইসরাইলীকেও হত্যার আদেশ দেবেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাই ওই পরিস্থিতির বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’

কর্নেল দায়ান ‘গুপ্তহত্যা’ শব্দটি এগিয়ে যান। তিনি বারবার বলেন যে, তার লক্ষ্য ছিল এটা নিশ্চিত করা যে, আরাফাত ‘জীবিত থাকবেন না’। অনেক বছর পরে যখন ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিরা শান্তি আলোচনা চালাচ্ছিলেন, তখন এই দু’জনের মধ্যে অনেকবার দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছিল। কর্নেল দায়ান বলছেন, তিনি যে পিএলও নেতাকে হত্যা চেষ্টার সাথে জড়িত ছিলেন, তা তিনি কখনই ইয়াসির আরাফাতকে বলেননি। কিন্তু আমার মনে হয় তিনি জানতেন। -বিবিসি

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২২৩২ঘ.)