মোদি সরকারের গ্রেপ্তার করা কে এই মোহাম্মদ জুবায়ের?

মোদি সরকারের গ্রেপ্তার করা কে এই মোহাম্মদ জুবায়ের?

ভারতের নয়া দিল্লি পুলিশ ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে এক মুসলিম সাংবাদিককে সোমবার গ্রেপ্তার করেছে। যদিও সমালোচকরা বলছেন, ওই সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের ঘটনা দেশটিতে মোদি সরকারের শাসনামলে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বের সর্বশেষ উদাহরণ।

গ্রেপ্তার সাংবাদিকের নাম মোহাম্মদ জুবায়ের। তিনি ভারতের শীর্ষ স্থানীয় স্বাধীন ফ্যাক্স-চেকিং ওয়েবসাইট অল্ট নিউজের (Alt News) সহ-প্রতিষ্ঠাতা। তিনি মোদির ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি), বিশেষ করে ভারতের হিন্দু আধিপত্যবাদী গ্রুপের ক্রমাগত ভুয়া এবং মিথ্যা সংবাদ নজরে আনার ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। খবর আল-জাজিরার।

মহানবী (সা:) কে নিয়ে বিজেপি নেতার আপত্তিকর মন্তব্যের পর চলতি মাসে মোদি সরকার সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কূটনৈতিক সংকটের মুখে পড়ে। গাল্ফ কোঅপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) সদস্য দেশসহ এক ডজনের বেশি মুসলিম দেশ ওই মন্তব্যের জেরে নয়া দিল্লির কঠোর নিন্দা জানায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিজেপি বিবৃতি দিয়ে ‘সব ধর্মকে সম্মান’ করে বলতে বাধ্য হয়।

মাইক্রো ব্লগিং সাইট টুইটারে জুবায়েরের পাঁচ লাখের বেশি অনুসারী আছেন। তিনি প্রথমদিকের সাংবাদিকদের একজন, যিনি টেলিভিশন বিতর্কে মহানবী (সা:) কে নিয়ে বিজেপি নেতা নুপুর শর্মার ওই আপত্তিকর মন্তব্যের ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করেছিলেন। ওই মন্তব্যের জেরে নুপুর শর্মাকে বিজেপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।

জুবায়ের ওই ভিডিও শেয়ার করলেও তাতে নুপুরের নাম বা তাকে ট্যাগ করেননি। তিনি ওই টেলিভিশন চ্যানেল, তার মালিক এবং বিতর্ক অনুষ্ঠানের উপস্থাপককে ওই রকম বক্তব্য দেওয়ায় অনুমোদন দেওয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ করেন।

গত সপ্তাহে আল-জাজিরার সঙ্গে এক টেলিফোন সাক্ষাৎকারে জুবায়ের বলেন, নুপুরকে ওই বক্তব্য দেওয়ার জন্য সুযোগ দেওয়ায় আমি অনুষ্ঠানটির সঞ্চালকের ওপর বেশি রাগান্বিত ছিলাম। এমনকি বিজেপির এই নেতা ওই বক্তব্য দেওয়ার পরও তাকে থামানো হয়নি। আমার খুব খারাপ লাগছিল তাই আমি টুইট করি। যেখানে আমি নুপুর শর্মার নাম নিইনি বা তার টুইটার হ্যান্ডেল উল্লেখ করিনি। কিন্তু সঞ্চালক এবং নিউজ চ্যানেলের ওপর আমি ক্ষিপ্ত ছিলাম।

তিনি বলেন, আমি তাদেরকে নজরে আনতে চেয়েছিলাম। প্রকৃতপক্ষে আমি নিউজ চ্যানেলটিকে টার্গেট করেছিলাম।

যখন এই আপত্তিকর বক্তব্য গুরুতর কূটনৈতিক সংকট তৈরি করে তখন বিজেপির বহু সমর্থক জুবায়েরের গ্রেপ্তার দাবি করেন এবং টুইটারে অ্যারেস্টজুবায়ের হ্যাশট্যাগ চালু করেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে পুলিশ ৩৯ বছর বয়সী এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে কিছু উগ্র ডানপন্থি হিন্দু ধর্মীয় নেতাকে ‘বিদ্বেষী’ বলার ব্যাপারে অভিযুক্ত করে। ওই ধর্মীয় নেতারা মুসলিমদের সম্পর্কে উগ্র বক্তব্য দেন এবং তাদের মধ্যে অন্তত একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে ‘গণহত্যা’ চালানোর জন্য আহ্বান জানান।

সোমবার জুবায়েরকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর এর পাঁচদিন আগে মোদি সরকারের কাছ থেকে একটি অনুরোধ পায় টুইটার কর্তৃপক্ষ। সরকার দাবি করে জুবায়েরের টুইটার অ্যাকাউন্টটি ভারতের আইন লঙ্ঘন করেছে।

কর্ণাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরু শহর থেকে আসা জুবায়ের ১০ বছরের বেশি সময় টেলিকম জায়ান্ট নোকিয়ায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ২০১৭ সালে তিনি এবং প্রতীক সিনহা নামের অপর এক সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মিলে অল্ট নিউজ প্রতিষ্ঠা করেন। সিনহা মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটের আহমেদাবাদের সন্তান।

প্রতিষ্ঠার অন্তত এক বছর পর্যন্ত সাইটি পরিচালনার ক্ষেত্রে সিনহাকে সহযোগিতা করতে থাকেন জুবায়ের এবং নোকিয়ার চাকরি চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে ২০১৮ সালে তিনি নোকিয়ার চাকরি ছেড়ে দেন এবং অল্ট নিউজে ফুল টাইম কর্মী হিসেবে যোগ দেন।

সিনহা-জুবায়েরের প্রথম সাফল্যের একটি ছিল, ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে করা এক মিথ্যা দাবি ফাঁস করা। উত্তেজনাপূর্ণ ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে ফ্লাড লাইট সংক্রান্ত ওই প্রতিবেদনে একটি ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু ছবিটি ছিল স্পেন-মরোক্কো সীমান্ত এলাকার এবং সেটি ২০০৬ সালে স্প্যানিশ এক আলোকচিত্রি তুলেছিলেন। অল্ট নিউজের প্রতিবেদনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হয়।

এরপর এই দুই সাংবাদিক অসংখ্য ভুয়া দাবি এবং মিথ্যা সংবাদ, যেগুলো সাধারণত বিজেপি সদস্য বা তাদের সমর্থকরা শেয়ার করেছে তা উন্মোচন করেন। যার ফলে গত পাঁচ বছরে তারা অনবরত অনলাইন ট্রোল, এমনকি মামলার শিকার হয়েছেন।

এদিকে জুবায়েরের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।