সরকারি চাকুরিতে কোটা কি রাখতেই হবে?

সরকারি চাকুরিতে কোটা কি রাখতেই হবে?

ঢাকা, ১৮ জুলাই (জাস্ট নিউজ) : সরকারি চাকুরিতে কোটা ব্যবস্থায় সংস্কার প্রশ্নে বাংলাদেশে এখন যে তীব্র বিতর্ক চলছে, সেখানে এটি বহাল রাখার পক্ষে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাই সরকারের তরফ থেকে বার বার বলা হচ্ছে।

কিন্তু সংবিধানে আসলে এরকম কোটা রাখার পক্ষে কী বলা হয়েছে? আর যে উদ্দেশ্যে এই কোটা চালু করা হয়েছিল, সেই লক্ষ্যই বা কতটা অর্জিত হয়েছে?

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে, “প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ-লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।”

কিন্তু সেখানেই আবার বলা আছে, এই অনুচ্ছেদটি 'নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশ যাহাতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ করিতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাঁহাদের অনুকূলে বিশেষ বিধান-প্রণয়ন করা হইতে রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।”

বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য নানা ধরনের সরকারি চাকুরিতে যে কোটা রেখেছে, সেসব মূলত সংবিধানের এই বিধান বলেই করা।

কিন্তু এর মানে কি তাহলে সরকারি চাকুরিতে কোটা রাখতেই হবে?

সরকারের অবস্থানের সঙ্গে একমত নন সংবিধান বিশেষজ্ঞ, সাবেক আমলা এবং গবেষকরা।

আইনজীবী শাহদীন মালিক এর আগে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী অনগ্রসর গোষ্ঠীগুলোর জন্য সরকারকে বিশেষ ব্যবস্থা রাখতেই হবে। “তবে সেটা কিভাবে রাখা হবে, কার জন্য কতটুকু রাখা হবে, তা পুরোপুরি সরকারের বিষয়।”

হাফিজউদ্দীন খান বাংলাদেশ সরকারের অবসরপ্রাপ্ত আমলা। পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করেছেন।

তাঁর মতে, “সংবিধানে যেটা বলা আছে, সেটা হচ্ছে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু সেই বিশেষ ব্যবস্থা সরকারি চাকুরিতে কোটা সংরক্ষণই হতে হবে তা নয়।”

কার জন্য, কী উদ্দেশ্যে
বাংলাদেশে সরকারি চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের মোট ৫৬ শতাংশ কোটা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা। এই কোটায় মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের জন্য সংরক্ষিত আছে ৩০ শতাংশ পদ। এরপর ১০ শতাংশ আছে নারীদের জন্য। প্রতিটি জেলার জন্য আছে ১০ শতাংশ কোটা। ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীগুলোর জন্য পাঁচ শতাংশ। আর প্রতিবন্ধীদের জন্য এক শতাংশ।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক মুক্তিযোদ্ধা কোটাকে ঘিরে। আন্দোলনকারীরা মূলত এই কোটাই কমিয়ে আনার দাবি তুলেছেন।

বাংলাদেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এবং তালিকা নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকেই বিভিন্ন সরকারের আমলে নানা বিতর্ক হয়েছে। বার বার এই তালিকা সংশোধন করা হয়েছে, এই তালিকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।

সর্বশেষ সরকারি হিসেবে বাংলাদেশে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা এক লাখ আশি হাজারের মতো।

কিন্তু এই মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের বংশধরদের জন্য কেন তিরিশ শতাংশ কোটা রাখতে হবে, সেটা নিয়েই আন্দোলনকারীরা প্রশ্ন তুলেছেন।

তাদের দাবির যৌক্তিকতার সঙ্গে একমত অবসরপ্রাপ্ত আমলা এবং সাবেক উপদেষ্টা হাফিজউদ্দীন খান।

“ধরে নিলাম বাংলাদেশে তিন লাখ মুক্তিযোদ্ধা। তো তারা মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ? মুক্তিযোদ্ধা, তাদের সন্তান, নাতি-নাতনি পরিবারসহ যদি ১৬ লাখও হয়, তারপরও তারা দেশের মোট জনসংখ্যার এক শতাংশ। বহু বছর ধরেই মুক্তিযোদ্ধা কোটায় যথেষ্ট লোক পাওয়া যাচ্ছে না। কাজেই সেটাকে অন্য জায়গা থেকে এনে পূরণ করতে হয়। যেখানে যথেষ্ট প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না, সেখানে কোটা চালু রাখার কোন যৌক্তিকতা তো আমি খুঁজে পাচ্ছি না।“

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা রাখার পেছনে সরকারের একটা উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের অবদানের জন্য স্বীকৃতি এবং প্রতিদান দেয়া। সেই সঙ্গে দেশ পুনর্গঠনে তাদের কাজে লাগানো। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য কতটা সফল হয়েছে তা নিয়ে সন্দিহান অনেকে।

৭৩ এর ব্যাচ

হাফিজউদ্দীন খান বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্র সন্মান দেবে, এতে তো আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু যেসব মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারি চাকুরিতে নেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে যোগ্য এবং দক্ষ লোক যেমন ছিলেন, তেমনি অনেক অযোগ্য লোকও ছিলেন।”

এক্ষেত্রে তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেন বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণীর সরকারি পদে ১৯৭৩ সালে যে ব্যাচটিকে নেয়া হয়েছিল সেটির কথা।

“৭৩ সালের যে ব্যাচটির কথা আমরা বলি, যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চাকরি দেয়া হয়েছিল, তাদের অনেকে তো ছিলেন একেবারেই অযোগ্য। তাদের মধ্যে অনেক ভালো অফিসারও ছিলেন, যাদের অনেকে আমার সঙ্গে কাজ করেছে।”

“মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মান করেন, তাতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু তাদেরকে তো পেতে হবে। পাওয়া তো যাচ্ছে না। আমার যেটা আশংকা, যেটা আরও অনেকেই বলেন, এই ব্যবস্থা চালু থাকায় আসলে নতুন নতুন মুক্তিযোদ্ধা 'পয়দা' হচ্ছেন। ১৯৭২ সালে আমি নিজের চোখে এই ঘটনা দেখেছি, যেখানে ভূয়ো মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট জোগাড় করে চাকুরি করেছে। এরকম ঘটনা তো অনেক আছে।”

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকুরিতে এত বেশি সংখ্যায় পদ সংরক্ষণের পেছনে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে বলেও মনে করা হয়। বর্তমান সরকার তাদেরকে 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের' সরকার বলে বর্ণনা করে এবং সরকারী প্রশাসনে মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের নেয়া হলে সেটি প্রশাসনে তাদের মতাদর্শের কর্তৃত্ব বজায় রাখবে বলে মনে করে।

উন্নয়ন গবেষক ড: হোসেন জিল্লুর রহমান মনে করেন, এরকম চিন্তা-ভাবনা যদি এর পেছনে কাজ করে থাকে, সেটা মারাত্মক ভুল।

“মুক্তিযুদ্ধের সনদপ্রাপ্তরাই কেবল দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছে, তা তো নয়। দেশের বাকী মানুষকে তো তাহলে বাদ দিয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, উন্নতি, এখানে তো সব মানুষই অবদান রেখেছেন। সরকার যদি এরকম একটা চিন্তা লালন করে, আমি মনে করবো তার মধ্যে মারাত্মক ভুল আছে।”

কোটায় অগ্রগতি কতটা
স্বাধীনতার পর গত ৪৬ বছরে যেসব অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য সরকারি চাকুরিতে কোটা রাখা হয়েছিল, তারা এ থেকে কতটা উপকৃত হয়েছেন? এসব অনগ্রসর গোষ্ঠী কতটা উন্নতির সুযোগ পেয়েছে?

বাংলাদেশ আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্বকারী একটি সংগঠন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং মনে করেন, এ থেকে তারা যথেষ্ট উপকৃত হয়েছেন।

“এই কোটার ফলে আদিবাসী-পাহাড়ি মানুষের সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে, বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছুটা অগ্রাধিকার পায়। এই কোটা না থাকলে যেটা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়তো।”

তবে আদিবাসীদের জন্য যে পাঁচ শতাংশ কোটার কথা বলা হচ্ছে, সেই কোটা অনেক সময়েই পূরণ হয় না, জানালেন সঞ্জীব দ্রং।

“আমরা সেভাবে স্টাডি করিনি। কিন্তু আমাদের ছেলেরা কিছু কাজ করেছে। তাতে দেখা যায় যে, আদিবাসীদের জন্য যে কোটা আছে, বিশেষ করে সরকারি চাকুরিতে, সেটা কখনোই পূরণ হয়নি। গারোদের মধ্য থেকে প্রশাসনে অল্প কিছু লোক চাকরি করছে। পুলিশে আছে মাত্র দুজন। কিন্তু ছোট ছোট আদিবাসী সম্প্রদায় যারা আছে, হাজং, কুচ, বা খুমী, পাংখোই বা ম্রো, সরকারের প্রথম শ্রেনীর চাকুরিতে হয়তো এদের একজনও নেই। কাজেই এই কোটা কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে কিন্তু এর ফল সেভাবে মিলছে না।”

পিছিয়ে পড়া জনপদ
আদিবাসী কোটার মতই বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলার জন্য আছে পাঁচ শতাংশ কোটা। যার উদ্দেশ্য প্রতিটি এলাকার মানুষ যেন সরকারি চাকুরিতে সমান সুযোগ পান।

কিন্তু এই জেলা কোটা রাখার প্রয়োজন কতটা এখন আছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন ড: হোসেন জিল্লুর রহমান।

“একসময় অনেক জেলা ছিল, যেসব জেলাকে আমরা পিছিয়ে পড়া জনপদ বলতাম। আমাদের সার্বিক অর্থনীতির পরিবর্তনের ধারায় এখন কিন্তু সেখানে কিন্তু এখন অনেক উন্নয়ন ঘটেছে। কিন্তু আগের কোটা ব্যবস্থাই এখন রয়ে গেছে।”

এই জেলা কোটার সুযোগ সেই জেলার প্রকৃত বাসিন্দারা কতটা পাচ্ছেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।

“কুড়িগ্রামে হয়তো কারও বাবা বা দাদার আদি বাড়ি ছিল, কিন্তু সে নিজে এখন ঢাকার বাসিন্দা। তাকে কিন্তু এখন আর পিছিয়ে পড়া বলা যাবে না। কিন্তু সে কুড়িগ্রামের কোটার সুযোগটা নিতে চাইছে। এর অপব্যবহার চলছে।”

হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, মেধার লালন এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে সহায়তা, এই দুটির মধ্যে একটা ভারসাম্য আসলে খুঁজে পেতে হবে। -বিবিসি

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/২২১৪ঘ.)