শাঁখের করাতে ট্রাম্প!

শাঁখের করাতে ট্রাম্প!

ওয়াশিংটন, সেপ্টেম্বর ৮ (জাস্ট নিউজ): বেকায়দায় পড়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সামনে গেলে যেমন বিপদ, পিছনে গেলেও ঠিক তাই! এ যেনো শাঁখের করাত দশা। একের পর এক বিতর্ক পিছু না ছাড়া ট্রাম্পের এখন গলার কাঁঠা হয়ে দাঁড়িয়েছে-বব উডওয়ার্ডের বই আর নিউইয়র্ক টাইমসে তার প্রশাসনের একজনের লেখা সম্পাদকীয়। এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে ট্রাম্পের গদি টিকে থাকা আর না থাকা নিয়ে।

ট্রাম্পের শনির দশায় সাম্প্রতিক সময়ের শেষ পেরেকটি টুকে দেয়া হলো শুক্রবার (৮.৯.২০১৮)। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে লন্ডনে মন্তব্য করে তদন্ত উস্কে দেওয়া প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাবেক সহকারী জর্জ প্যাপাডোপোলাসকে ১৪ দিনের কারাদণ্ড দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালত। তদন্ত সংস্থা এফবিআইকে মিথ্যা বলার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ওয়াশিংটন ডিসির একটি আদালত এই রায় দেয়।

২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপ তদন্তের সময় ট্রাম্পের প্রথম সহকারী হিসেবে আটক হন তিনি। আদালতে তিনি বলেন, তার পুরো জীবন ওঠানামায় ঘুরপাক খেয়েছে আর তিনি আশা করেন দ্বিতীয়বার সুযোগ পেলে জীবনে ছন্দ ফিরিয়ে আনবেন। প্যাপাডোপোলাস বলেন, এই তদন্তের একটি বৈশ্বিক প্রভাব রয়েছে আর সত্যটার গুরুত্ব রয়েছে।

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রচার শিবিরের সঙ্গে রুশ আঁতাত, অভিবাসন, একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্যের কারণে শুরু থেকেই কোণঠাসা ছিলেন ট্রাম্প। এত ঝড়ের পরও গদি আগলে রেখেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এর লেখা বইয়ে বেকায়দায় পড়েছেন তিনি।পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়া উডওয়ার্ড হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি টলিয়ে দিয়েছিলেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের গদি। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি সম্পর্কে তার অনুসন্ধানি প্রতিবেদনই নিক্সনকে বাধ্য করেছিল অভিসংশনের মুখে পদ থেকে সরে দাঁড়াতে।

বব উডওয়ার্ড এর বইয়ে রয়েছে বেশ কিছু বিস্ফোরক তথ্য।সেখানে প্রেসিডেন্টের প্রতি হোয়াইট হাউস কর্মকর্তাদের বিরাগভাজন হবার বিষয়টি একেবারে স্পষ্ট।

বইটিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস প্রেসিডেন্টের বুদ্ধিসুদ্ধিকে পঞ্চম বা ষষ্ঠ শ্রেণির পর্যায়ের মনে করেন। চিফ অব স্টাফ জন কেলির চোখে ‘নির্বোধ’ এই প্রেসিডেন্টের অধীনে হোয়াইট হাউস পরিণত হয়েছে এক ‘পাগলা শহরে’। নানান অপ্রেসিডেন্টসুলভ আচরণ দিয়ে ট্রাম্প এরই মধ্যে তার ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ অনেক কর্মকর্তাকে চটিয়েছেন। আইনমন্ত্রী জেফ সেশন্সকে অনবরত অপমান করা কিংবা জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ম্যাকমাস্টারের আচরণ নকল করাটা তার অভ্যাসের অংশ। তিনি এতটাই খেয়ালি যে, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বাতিলের মতো উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা জানালে, যখন তারই কর্মকর্তারা তার টেবিল থেকে সংশ্লিষ্ট নথিপত্র সরিয়ে ফেলেন, তখন তিনি তা টেরও পান না। যদিও এই ডোনাল্ড ট্রাম্পই ক্ষমতায় বসেছিলেন আমেরিকাকে আবারও ‘গ্রেট’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। অথচ ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কথা মুহুর্মুহু ঘোষণা করা ট্রাম্পকে তাঁরই কর্মকর্তারা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করছেন।

বব উডওয়ার্ডের বইয়ে এসব প্রসঙ্গ সবিস্তারে উঠে আসায় আলোচনা আর সমালোচনার ঝড় বইছে পুরো দেশ জুড়ে।

সমালোচনার মুখে গা বাঁচাতে ট্রাম্প ও তার প্রেসসচিব চিরাচরিত কায়দা অনুসরণ করে এ বইয়ের তথ্যগুলোকে ‘বানোয়াট’ বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। নিউইয়র্ক টাইমসে ৫ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি উপসম্পাদকীয় নিবন্ধ আবারো নতুন করে যেন আগুনে ঘি ঢাললো।

পত্রিকাটিতে নাম প্রকাশ না করে হোয়াইট হাউসেরই এক কর্মকর্তা, যিনি নিজেকে প্রশাসনের অভ্যন্তরে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তৎপর কর্মকর্তাদের একজন হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন, তিনি এক নিবন্ধে ট্রাম্পের ব্যবহারকে শুধু অস্বাভাবিকই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের জন্য ‘ক্ষতিকর’ বলে উল্লেখ করেন।

এ লেখা ছাপার পরই লেখককে শনাক্ত করতে নানা তৎপরতা শুরু করেছে হোয়াইট হাউস। কে লিখলো, কে ঘটালো এই কান্ড-এমন জল্পনা আর কল্পনায় উঠে এসেছে অনেকের নাম। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে সম্ভাব্য লেখক হিসেবে ১৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রেসিডেন্টের মেয়ে ইভানকা ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারড কুশনার এবং ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্পের নামও রয়েছে। রয়েছে হোয়াইট হাউসের উপদেষ্টা ড্যান ম্যাকগান, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক ড্যান কোটস, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ক্যালিঅ্যান কনওয়ে, চিফ অব স্টাফ জন কেলি, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান কার্স্টজেন নিলসেন, আইনমন্ত্রী জেফ সেশন্স, প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস, ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স ও জাতিসংঘের যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালির মতো নাম।

এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে এরই মধ্যে অবশ্য মাইক পেন্স ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও নিবন্ধের সঙ্গে নিজেদের সংশ্লিষ্টতা নেই বলে বিবৃতি দিয়েছেন।

ট্রাম্প সন্দেহ করছেন, নিবন্ধটি জাতীয় নিরাপত্তা কিংবা বিচার বিভাগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তা লিখেছেন। হোয়াইট হাউসের এক কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

এবার আসা যাক নিবন্ধনের আরেকটু গভীরে। কি এমন লেখা আছে তাতে? যার জন্য তদন্তের আহবান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট। নিবন্ধের সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান কিছু কর্মকর্তা জাতীয় স্বার্থে একাট্টা হয়েছেন। যুক্তরােষ্ট্রের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সে জন্য তারা হোয়াইট হাউসের অভ্যন্তরেই ট্রাম্পবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা চালাচ্ছেন। এবং এই তথ্য মানুষের সামনে নিয়ে আসার লক্ষ্যেই তাদেরই একজন এ নিবন্ধ প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছেন নিউইয়র্ক টাইমসে। পত্রিকাটি তাদের নীতিমালার বাইরে এসে শুধু গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে এ নিবন্ধ নাম ছাড়াই প্রকাশ করেছে।

লেখক কে? সে পরিচয় প্রকাশের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে পত্রিকাটিকে। কিন্তু তারা তাদের অবস্থানে অনড়।

এর আগের সপ্তাহে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আইনজীবী মাইকেল কোহেনের স্বীকারোক্তি এবং তার প্রচার শিবিরের সাবেক প্রধান পল ম্যানাফোর্টের আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের কোনঠাসা অবস্থাটা সহজেই আঁচ করা যাচ্ছে।

সে সময়ই প্রশ্ন উঠেছিল যে, মাইকেল কোহেন নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে দুই পর্নো তারকাকে যে অর্থ দিয়েছিলেন, তার নির্দেশদাতা হিসেবে ট্রাম্প বিচারের আওতায় আসবেন কিনা। সে সময় অপরাধটিকে গুরুতর বলা হলেও যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের ভোগ করা কিছু দায়মুক্তির রীতির কারণে ট্রাম্প বেচে যাবেন বলে অনেকে মত দিয়েছিলেন। একই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমার ক্ষমতা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
সর্বশেষ সিনেটের শুনানিতে ট্রাম্প মনোনীত সুপ্রিম কোর্টের নতুন বিচারপতি ব্রেট কাভানো প্রেসিডেন্টের ক্ষমার ক্ষমতা ও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হলে নিজে দায়িত্ব পালন করবেন কিনা এ ধরনের প্রশ্ন এড়িয়ে যান। এই এড়িয়ে যাওয়াটা তার বিব্রত হওয়ার পরিচায়ক। ব্রেট কাভানোকে মনে করা হয় ট্রাম্প ঘরানার। নিজের পিঠ বাঁচাতেই বিতর্কিত এ ব্যক্তিকে বিচারপতির মতো উচ্চ পদে মনোনয়ন দিয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু এই মনোনীত লোকও যদি তার বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যারা এখন সোচ্চার, তারাও ট্রাম্পের নিয়োগ করা।

সব বিষয় এখন অনেকখানি নির্ভর করছে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফলাফলের ওপর। কারণ ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতার হিসাবটি পাল্টে যেতে পারে। এদিকে রবার্ট ম্যুলারের তদন্তও যে লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তা অনেকটা স্পষ্ট। সে ক্ষেত্রে অভিসংশনের প্রস্তাব ওঠা ও তার টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।

সব মিলিয়ে দুঃসময়ের মুখে পড়েছেন ট্রাম্প।এবার কি পাড়বেন উতরে যেতে নাকি পা পিছলে গদি হারাতে হবে? উত্তরটা বলে দেবে সামনের দিনগুলো।

(জাস্ট নিউজ/জিএস/২২৫০ঘ)