মাহে রমজান: তাকওয়া ও তাজকিয়াহ

মাহে রমজান: তাকওয়া ও তাজকিয়াহ

ইসলামের অন্যতম ও জীবন ঘনিষ্ঠ অতীব গুরুত্বপূর্ণ দু’টি আলোচ্য বিষয় হল তাকওয়া ও তাজকিয়াহ। উভয়ের ভাবার্থ কাছাকাছি হলেও রয়েছে সূক্ষ্ম পার্থক্য। ‘তাকওয়া’ এর বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘পরহেজগারীতা’। আর ‘তাজকিয়াহ’ এর প্রতিশব্দ হল ‘আত্মশুদ্ধি’। মাহে রমজান উভয়টি অর্জনের চমৎকার মৌসুম। পরহেজগারীতা অর্জনের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়।

পবিত্র মাহে রমজানে উম্মতে মুহাম্মদীর উপর ফরজ হওয়া প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরয করা হয়েছে, যেরূপ ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর, যেন তোমরা যেন তাকওয়া অর্জন করতে পারো” (সুরা বাকারা ২:১৮৩)।

কুরআনিক শব্দ ‘তাকওয়া’ এর বাংলা নানান অর্থ পাওয়া যায়। যেমন : বাঁচা, আত্মরক্ষা করা, নিষ্কৃতি লাভ করা, ভয় করা, বিরত থাকা, রক্ষা করা, পরহেজগারী ইত্যাদি। অর্থাৎ আল্লাহর ভয় ও তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখাই ‘তাকওয়া’। হযরত উবাই ইবনে কাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু কে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ‘তাকওয়া’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, হে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাবন, মাঝখানে সরু পথ। এমতাবস্থায় কিভাবে চলতে হবে? হযরত ওমর বলেন, গায়ে যেন কাঁটা না লাগে, সাবধানে পথ অতিক্রম করতে হবে। হযরত উবাই ইবনে কাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বললেন, এটাই তাকওয়া।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আল্লাহর কাছে তোমাদের কুরবানীর গোস্ত, রক্ত কিছুই পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তাকওয়া” (সূরা –হজ্জ ৩৭)। তিনি আরো বলেন, “পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি তার পালনকর্তার সামনে দণ্ডায়মান হওয়াকে ভয় করেছে এবং খেয়াল-খুশী থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে, তার ঠিকানা হবে জান্নাত” (সূরা নাজিয়াত ৪০-৪১)।

ইসলামী শব্দ ‘তাজকিয়াহ’ বাংলা অর্থ হল নিজের সংশোধন করা, নিজেকে খাঁটি করা, পরিশুদ্ধ করা ইত্যাদি। তবে এর প্রসিদ্ধ ও বহুল প্রচলিত বাংলা অর্থ ‘আত্মশুদ্ধি’। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাতসয্যসহ নীতিহীনতা, অহংকার, হিংসা-বিদ্বেষ, পরধন ও সম্মানের মোহ দূরীভূত করতঃ একত্ববাদের আকিদা-বিশ্বাস, নৈতিকতা, বিনয়-নম্রতা, দুনিয়াবিমুখতা ও অমুখাপেক্ষিতা, আল্লাহর মহব্বত, বদান্যতা ও মহানুভবতার গুণ দ্বারা হৃদয় কে সুশোভিত করাই আত্মশুদ্ধি।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যে নিজেকে শুদ্ধ করে, সেই সফলকাম হয়। এবং যে নিজেকে কলুষিত করে, সে ব্যর্থ মনোরথ হয়” (সূরা শামস ৯-১০)। তিনি আরো বলেন, “হে পরওয়ারদেগার, তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুন যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দিবেন। এবং তদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী হেকমতওয়ালা” (সূরা বাকারা ১২৯)।

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “জেনে রাখো, শরীরের মধ্যে একটি গোশতের টুকরা রয়েছে, তা যখন ঠিক হয়ে যায়, পুরো শরীর তখন ঠিক হয়ে যায়। আর তা যখন খারাপ হয়ে যায়, পুরো শরীর তখন খারাপ হয়ে যায়। জেনে রাখো, সে গোশতের টুকরাটি হলো কলব” (বুখারি শরিফ)। হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী বলেন, “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-আকৃতি এবং তোমাদের ধন-সম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না, বরং তিনি দৃষ্টিপাত করেন শুধু তোমাদের কলব ও আমলের প্রতি” (মুসলিম শরীফ)। হযরত আবু উমামা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবীজী এরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’আলা সব আমলের মধ্যে শুধু সেই আমলটুকুই কবুল করেন, যা এখলাসের সাথে শুধু তার সন্তুষ্টির জন্যই করা হয়” (নাসাঈ শরীফ)।

মাহে রমজান মাস, যে মাসের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হল তাকওয়া ও তাজকিয়াহ অর্জন করা। আর এ মাসে তুলনামূলক ভালো দ্বীনি পরিবেশ থাকার কারণে কাজদ্বয় করাও সম্ভব ও সহজ। আসুন, আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকসহ সকল অবস্থায় সব সময় পরহেজগারীতা ও আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে সচেষ্ট হই।

এমজে/