মুমিন হৃদয়ে জান্নাতি সমীরণ বয়ে আনে রমজান

মুমিন হৃদয়ে জান্নাতি সমীরণ বয়ে আনে রমজান

মুমিনের হৃদয়ে সুপ্ত শীতল সুবাতাস বইয়ে দিতে ইবাদতের বসন্তকাল এসেছে। রহমতের বর্ষায় সমস্ত পাপ পঙ্কিলতা ধুয়ে দিতে, মুক্ত ও পবিত্র জীবনের পথে ডাকতে এসেছে রমজান।

বসন্তে যেমন সুসজ্জিত হয় প্রকৃতি; তেমনি রমজানেও সুসজ্জিত হয় মুমিন হৃদয়। সতেজ সবুজ ছোট্ট ছোট্ট কিশলয় যেমন উঁকি দেয়, তেমনই মুসলিম হৃদয় গুলোতেও চেতনে অবচেতনে ইবাদতের তামান্না উঁকি দেয়। তাইতো এ মাসে মসজিদগুলো অন্যান্য মাসের তুলনায় অধিক প্রাণবন্ত হয়ে উঠে। যদিও কোভিড-১৯ মহামারির জন্য এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন।

সেহরিতে একে অপরকে ডেকে দেওয়া, সেহরি শেষে দলে দলে স্নিগ্ধ ঠান্ডা পরিবেশে মসজিদের দিকে চলা, আজান হলেই মসজিদে ছুটে যেতে দিলের বায়না, ইফতার শেষে হুড়োহুড়ি করে মসজিদে যাওয়া, অধীর আগ্রহ নিয়ে তারাবিতে অংশ নেওয়া, সুমধুর কন্ঠে লম্বা সময় হৃদয় জুড়ানো তেলাওয়াত শোনা, নামাজ শেষে মুনাজাতে দিলের আকুতি মিশিয়ে আল্লাহ’র সঙ্গে কিছু চাওয়া পাওয়ার কথা বলা, কখনো অতীতের করা অন্যায়গুলোর কথা ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়া ইত্যাদি প্রত্যেকটির জন্য মুমিন হৃদয়ের গহীনে লুকিয়ে থাকে প্রচন্ড আবেগ, আনন্দ, খুশি, ভালোবাসা আর রূহের শীতলতা। মুমিন হৃদয় তা উপলব্ধি করতে পারে, অনুভব করতে পারে কিন্তু ভাষার সে শক্তি নেই যে, এসব অনুভূতি শব্দে প্রকাশ করবে!

বান্দার এ হালত আল্লাহকে বড়ই খুশি করে। তাইতো তিনি রমজান শুরুই করেন সুসংবাদ দিয়ে। রমজানের প্রথম রাতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে আদর মাখা ডাক আসে- ‘কে আছো কল্যাণপ্রার্থী? এগিয়ে এসো। আর হে অকল্যাণের পথিক? এবার থামো।’ (আল হাদীস)

সুসংবাদ আসে ‘যে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমান ও বিশ্বাস নিয়ে সওয়াবের আশায় রমজানে রোজা রাখে, তার অতীতের সমস্ত গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয়। (আল হাদীস)

সুসংবাদের সাথে উপহারও আসে! হ্যাঁ। এবার আল্লাহ্ বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ তোমাদের জন্য রোজা ফরজ করা হয়েছে; যেভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ফরজ করা হয়েছিলো। যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পারো। (আল কোরআন)

এখানে রোজাকে বান্দাদের জন্য ফরজ করা হয়েছে বলার পাশাপাশি একটি সুসংবাদও দেওয়া আছে। তা হলো- মুত্তাকী হওয়ার সুসংবাদ। আল্লাহ’র কথা সবসময় স্মরণপূর্বক সব গুনাহ থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি আল্লাহ’র ভয় ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তার প্রত্যেকটি আদেশ নিষেধ মেনে চলার সর্বোচ্চ চেষ্টাকারী ব্যক্তিকে বলা হয় মুত্তাকী।

ইসলাম যেগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেয়; সেগুলোর মধ্যে মুত্তাকী হওয়া অন্যতম। মুত্তাকী বা তাকওয়া অর্জনকারী হওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়। রমজান এই কঠিন কাজটি হাসিলে আমাদের সাহায্য করে। রমজান আমাদের মুত্তাকী বা তাকওয়া অর্জনকারী হতে সাহায্য করে। তাই নিঃসন্দেহে রমজানকে বান্দার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে অনেক বড় একটি উপহারও বলা যায়।

কারোনা পরিস্থিতির জন্য এ বছরের রযজান যদিও ভিন্নরকম; কিছুটা বিষণ্ণ, কিছুটা বেদনাগ্রস্থ, কিছুটা জৌলুসহীন। তবুও আবেদন হারায়নি রমজান। রহমতের বারিবাহী রমজান কীভাবে মুসলিম হৃদয় থেকে আবেদন হারায়! তাইতো প্রায় প্রত্যেকটি ঘর মসজিদে পরিণত হয়েছে পাশাপাশি রবের ঘর বান্দাহদের জন্য খুলে দেওয়ার অশ্রুভেজা আবেদন আরও বেড়ে গেছে।

রমজান সুসংবাদ আর ফজিলতপূর্ণ একটি মাস। এ মাসে বান্দার প্রত্যেকটি আমলের সওয়াবকে ৭০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এ মাসেই নাজিল হয়েছে মানবজাতীর হেদায়েতের পথপ্রদর্শক মানবজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার মহাগ্রন্থ আল কোরআন। কোরআন নাজিলের মাস হিসেবে এ মাসের রয়েছে আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা।

‘রমজান মাসে আকাশের দরজা খুলে দেওয়া হয়। জাহান্নামের দরজা বন্ধ করা হয়। দুষ্ট শয়তানকে বন্দি করা হয়। আর এ মাসে এমন একটি রাত আছে যার মর্যাদা হাজার মাস অপেক্ষা বেশি।’ (নাসাঈ)

‘রমজান আগমনের সাথে সাথেই বেহেশতের দরজা খুলে দেওয়া হয়।’ (মেশকাত)

‘রোযা কেয়ামতের দিন বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে।’ (মুসনাদে আহমদ)

রমজানের বিশেষ আমলগুলোর মধ্যে অন্যতম সেহরি, ইফতার, ইতিকাফ ইত্যাদি প্রত্যেকটিই ফজিলতে পরিপূর্ণ। রাসুলুল্লাহ (স.) বলেছেন, তোমরা সেহরি খাও কারণ এতে বরকত আছে। সেহরি ইহুদী ও মুসলিমদের রোজার মধ্যে পার্থক্যকারী।

আর ইফতারের ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ইফতারের সময় অনেক মানুষকে আল্লাহ্ জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেন।

দোয়া কবুল হওয়ার সময়গুলোর মধ্যে ইফতারের পূর্বমুহূর্ত অন্যতম। এছাড়াও ইফতারপূর্ব মুহূর্তে ইফতার নিয়ে অপেক্ষমান থাকাটাও আল্লাহর কাছে অনেক পছন্দনীয়।

তাড়াতাড়ি ইফতারের বিশেষ ফজিলত হিসেবে হাদীসে এসেছে, যতদিন মুসলিমরা সময়ের সাথে সাথে ইফতার করবে ততদিন কল্যাণের উপর থাকবে।

রমজানের শেষ দশকে রয়েছে লাইলাতুল ক্বদর; যা অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি রাত। পবিত্র কোরআনে হাজার মাসের চাইতেও উত্তম বলা হয়েছে এ রাতকে। অর্থাৎ হাজার মাস ইবাদত অপেক্ষা এই একটি রাতের ইবাদত অধিক মূল্যবান। আর বিশেষ বৈশিষ্ট‌্যমন্ডিত ইবাদত ইতিকাফ লাইলাতুল ক্বদর অর্জনের অন্যতম সুনিশ্চিত পন্থা।

এত গেলো শরয়ী ফজিলতের কথা; পূর্ণ একমাস সিয়াম সাধনার রয়েছে দারুণ শারীরিক উপকারিতাও। এজন্যই হয়তো রোজা বিষয়ে অধ্যয়ন করতে গিয়ে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির মুখপাত্র অধ্যাপক মোরপান্ড। রমজানের শারীরিক উপকারিতা সমূহের মধ্য থেকে সামান্য কিছু সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

** যেকোনো কিছুকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করার জন্য সুপরিচিত ছিলেন ক্যামব্রিজের ফার্মাকোলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লেথার জিম। তিনি রোজাদার ব্যাক্তিদের খাদ্যনালীর লালা (স্টমাক সিক্রেশন) নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। এতে তিনি আবিস্কার করেন রোজার মাধ্যমে ফুড পার্টিকেলস সেপটিক সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে। আশ্চর্য হয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন ‘পাকস্থলির সমস্যা দূরীকরণে রোজা একটি গ্যারান্টিযুক্ত ওষুধ।’

** হজম শক্তির উপর রয়েছে রোজার প্রভাব। বলা হয় মানুষের লিভার যদি কথা বলতে পারতো তবে সে সর্বপ্রথম বলতো ‘আমাকে বিশ্রাম দাও’। রোজা রাখার ফলে লিভার অনেকটা বিশ্রাম পায়। ফলে লিভার রক্তে হিমোগ্লোবিন সৃষ্টির কাজে মনোযোগী হতে পারে। রোযার মাধ্যমে গলা ও স্পর্শকাতর খাদ্যনালী বিশ্রাম পায়। পাকস্থলির উপর পড়ে রোজার কল্যাণকর প্রভাব। রোযাদার ব্যাক্তির পাকস্থলি থেকে বের হওয়া লালা দারুণ ভারসাম্য খুঁজে পায় ফলে অন্যান্য ক্ষুধার্থ সময়ের মতো এসিডিটি তৈরি হয় না।

** ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের দৈনিক জং পত্রিকায় একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিলো। সেখানে বলা হয় জার্মানি, আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক পাকিস্তানের লাহোর, করাচি ও ফয়সালাবাদের রোজাদারদের উপর গবেষণা করেছেন। এ গবেষণার যে ফলাফল বের হয়েছে তা হলো – রোজার মাধ্যমে মানুষ নাক, কান, গলা, পাকস্থলি, লিভার ও মস্তিস্কের রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে।

** ২০১৬ সালে জাপানের একজন ডাক্তার ইউসেনোরি ওহসূমি নোবেল প্রাইজ পান অটোফেজি সিস্টেম আবিস্কারের জন্য। অটোফেজি বা আত্মভক্ষণ পদ্ধতি শুনতে ভয়ংকর হলেও এটি মানবদেহের জন্য বিশেষ উপকারী একটি ব্যবস্থা। মানবদেহের সুস্থ কোষগুলো অন্য অসুস্থ, মৃত, বিষাক্ত কোষগুলোকে খেয়ে ফেলে। এতে বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারসহ অনেক রোগ থেকে মুক্ত থাকে দেহ। রোজা পালনের মাধ্যমে এই সিস্টেমকে সক্রিয় করা যায়।

** সম্প্রতি আরও একটি গবেষণায় উঠে এসেছে রোজাদারের শরীরে উচ্চমাত্রার আই জি এফ-১ হরমোন তৈরি হ্রাস পায় ফলে স্টমাক ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সারসহ প্রায় দশ রকমের ক্যান্সার থেকে মানবদেহ মুক্ত থাকতে পারে।

** রক্ত উৎপাদন ও চলাচলের উপর রোজার কল্যাণকর প্রভাব রয়েছে। রয়েছে কোষের উপর এবং নার্ভ সিস্টেমের উপরও। সর্বোপরি রোজার কল্যাণকর প্রভাব রয়েছে পুরো মানবদেহের উপর।

এমন আরো অনেক উপকারিতা রয়েছে রোজার।

এতসব সুসংবাদ আর উপকারিতার পরও আরেকটি বিশেষ উপহার রেখেছেন আল্লাহ্। আল্লাহ বলেন, বান্দা আমার জন্য রোজা রাখে সুতরাং এর পুরস্কার আমিই দেবো।

ইসলাম রোজাকে একটি আবশ্যক ইবাদত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে এবং আদায়কারীর জন্য বড় বড় পুরস্কার ঘোষণা করেছে। তাই আসুন আমরা রমজানকে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করি। রমজানের দেয়া আত্মনিয়ন্ত্রণের শিক্ষাকে ধারণ করে পবিত্র জীবন গড়ি। দুর্যোগকালীণ এই মুহূর্তে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াই। আল্লাহ্ সকলকে তাওফিক দান করুন।

লেখক: শিক্ষক, মাদরাসাতুল কোরআন, ফেনী। কামিল, হাদীস (স্নাতকোত্তর) ফেনী আলিয়া কামিল মাদ্রাসা।

এমজে/