আবুজার গিফারিকে মহানবীর সাত উপদেশ

আবুজার গিফারিকে মহানবীর সাত উপদেশ

মহানবী সা: তাঁর প্রিয় সাহাবিদের নানা প্রয়োজনীয় বিষয়ে উপদেশ দিতেন। মুসনাদ আহমদে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সা: হজরত আবুজার গিফারি রা:- কে সাতটি উপদেশ দেন। হজরত আবুজার গিফারি রা: বলেন, আমার বন্ধু তথা মহানবী সা: আমাকে সাতটি বিষয়ের নির্দেশ দিয়েছেন। তা হলো-

১. নিঃস্বদের ভালোবাসবে : হজরত আবুজার গিফারি রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে আদেশ করেছেন আমি যেন নিঃস্ব, দরিদ্র, ও অসহায়দের ভালোবাসি, তাদের কাছে যাই, তাদের সাথে মিশি, তাদের সাহায্য সহযোগিতা করি। সাহাবায়ে কিরামের প্রশংসায় আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আহার্যের প্রতি আসক্তি সত্ত্বেও তারা অভাবগ্রস্ত, ইয়াতিম ও বন্দীকে অন্নদান করে।’ (সূরা আল ইনসান-৮) মহানবী সা: বলেছেন, ‘আল্লাহর ইবাদত করো, অভাবীকে অন্ন দাও, সালাম প্রচার করো।

অতঃপর নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করো।’ (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ, মিশকাত হাদিস নং-১৯০৫) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘দান সদকা আল্লøাহর ক্রোধ দূর করে দেয় এবং খারাপ মৃত্যু থেকে রক্ষা করে। (তিরমিজি) মহানবী সা: বলেছেন, ‘যে মুসলমান বস্ত্রহীন মুসলমানকে বস্ত্র পরিধান করাবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ কাপড় পরিধান করবেন। যে ব্যক্তি ক্ষুধার্ত মুসলমানকে অন্নদান করে, আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। যে ব্যক্তি কোনো তৃষ্ণার্ত মুমিনকে পানি পান করাবে। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতে বিশুদ্ধ পানি পান করাবেন।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি)

২. নিচের দিকে তাকাবে, উপরের দিকে নয় : হজরত আবুজার গিফারি রা: বলেন, মহানবী সা: আমাকে বলেছেন, আমি যেন আমার নিচের দিকে অর্থাৎ আমার থেকে যারা অর্থনৈতিক, প্রভাব-প্রতিপত্তি ইত্যাদি দিক দিয়ে নিচে আমি যেন তাদের দিকে তাকাই। সম্পদে, মান-সম্মানে, ক্ষমায়, প্রভাব-প্রতিপত্তিতে যারা আমার উপরে তাদের দিকে যেন না তাকাই। কেননা, উপরের স্তরের লোকদের দিকে তাকালে মনে খারাপ লাগবে। কিন্তু নিম্নস্তরের লোকদের দিকে তাকালে মনে প্রশান্তি আসবে। তখন মনে হবে আমার চেয়ে অসহায়, দুর্বল, দরিদ্র ও নিম্নস্তরের লোকও আছে। আল্লাহ তাদের চেয়ে আমাকে যে ভালো রেখেছেন তার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া।

৩. আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে : হজরত আবুজার গিফারি রা: বলেন, মহানবী সা: আমাকে আদেশ করেছেন, আমি দূরে থাকলেও যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখি। কেননা, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা কবিরা গুনাহ। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়দের সম্পর্কে সতর্ক হও। অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা ছিন্ন করো না।’ (সূরা নিসা-১) মহানবী সা: বলেছেন, ‘রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (সহিহ বুখারি, মুসলিম) আরো ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি ও আখিরাতের প্রতি ঈমান রাখে, সে যেন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা রক্ষা করে।’ (সহিহ বুখারি, আবু দাউদ, তিরমিজি)

৪. কারো কাছে কোনো কিছু চাইবে না : মহানবী সা: হজরত আবুজার গিফারি রা:-কে বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কারো কাছে কোনো কিছু চাইবে না। এমনকি জুতার ফিতাও কারো কাছে চাইবে না। সূরা ফাতিহায় আমরা বলি- আমরা আপনারই ইবাদত করি এবং আপনার কাছেই সাহায্য চাই। মুমিনের আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে কোনো কিছু চাওয়া উচিত নয়।’

৫. সদা হক ও ন্যায় কথা বলবে : মহানবী সা: হজরত আবুজার গিফারি রা:-কে বলেছেন, ‘তিক্ত হলেও সদা সত্য কথা বলবে।’ সত্যের বিপরীত হলো মিথ্যা। মিথ্যা হলো সব পাপের মূল। তাই সত্য ও হক অনুযায়ী আমল করতে হবে; মিথ্যা ও বাতিল পরিহার করতে হবে।

৬. নিন্দুকের নিন্দাকে ভয় করবে না : মুমিন আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে, শরয়ি শাস্তি প্রয়োগের ব্যাপারে, শত্রুর সাথে যুদ্ধের ব্যাপারে, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজে বাধাদান ইত্যাদির ব্যাপারে কোনো অপশক্তির চোখ রাঙানি বা কোনো নিন্দুকের নিন্দার ভয় করো না। বরং অসীম সাহস ও বীরত্বের সাথে শরয়ি বিধিবিধান বাস্তবায়ন করে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের মধ্য থেকে যে ব্যক্তি স্বীয় ধর্ম হতে বিচ্যুত হবে, (এতে ইসলামের কোনো ক্ষতি নেই, কেননা) দ্রুতই তাদের স্থলে এমন এক সম্প্রদায় সৃষ্টি করবেন যাদেরকে আল্লাহ ভালোবাসবেন এবং তারাও আল্লাহকে ভালোবাসবে। তারা মুমিনদের প্রতি হবে কোমল, আর কাফিরদের প্রতি হবে বজ্রকঠোর। তারা আল্লাহর পথে জিহাদ করবে, আর তারা কোনো নিন্দুকের নিন্দার পরোয়া করবে না। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ, তা তিনি যাকে ইচ্ছা প্রদান করেন; বস্তুত আল্লাহ প্রাচুর্য দানকারী, মহাজ্ঞানী।’ (সূরা আল মায়েদা-৫৪)

এ আয়াতে ঈমানদারকে চারটি গুণের কথা বলা হয়েছে। চতুর্থ গুণটি হলো- মহান আল্লাহর আনুগত্য ও হুকুম পালনের ব্যাপারে কোনো তিরস্কারকারীর তিরস্কারকে ভয় ও পরোয়া করো না। এ গুণটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ গুণ। কেননা, সমাজে যখন কোনো পাপের প্রচলন ব্যাপক হয়ে যায়, তখন তার বিরুদ্ধে এ গুণ ছাড়া নেকির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এবং আল্লাহর বিধানের আনুগত্য করা সম্ভব নয়। সমাজে কত শত মানুষ আছে যারা পাপাচার, আল্লাহদ্রোহিতা এবং সামাজিক অশ্লীলতা থেকে বাঁচতে চেষ্টা করে; কিন্তু নিন্দুকের নিন্দা ও তিরস্কারের মোকাবেলা করার মতো ক্ষমতা তাদের নেই। ফলে পাপের গণ্ডি থেকে বের হতে পারে না এবং হক ও বাতিলের মাঝে পার্থক্য করতে পারে না। তাই আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘যাদের মধ্যে এ চারটি গুণ বিদ্যমান আছে তাদের প্রতি রয়েছে আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ।’

৭. বেশি বেশি ‘লাহাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’ এ দোয়া পড়বে : মহানবী সা: আবুজার গিফারি রা:-কে বলেছেন, ‘তুমি একটি দোয়া বেশি বেশি করে পড়বে। তা হলো- লাহাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ। কেননা, তা আল্লাহর আরশের নিচে খনিতুল্য। মহানবী সা: আরো বলেন, ‘দোয়া হচ্ছে ইবাদত (আবু দাউদ)।’ আল্লাহ তায়ালা আরো ইরশাদ করেন, ‘আমাকে ডাকো আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেবো।’ (সূরা আল মুমিন-৬০)

হজরত আবু মুসা আশয়ারী রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আমরা রাসূল সা:-এর সাথে এক সফরে ছিলাম। তখন সাহাবায়ে কিরাম জোরে জোরে তাকবির পড়ছিলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘রহম করো তোমরা এমন প্রভুকে ডাকছ, না যিনি বধির ও অনুপস্থিত। বরং তোমাদের প্রভু সব কিছু শুনেন এবং সবাইকে দেখেন, তিনি তোমাদের সাথে আছেন এবং শাহরগের চেয়েও অতি নিকটে। হজরত আবু মুসা আশয়ারী রা: বলেন, আমি পেছনে ছিলাম। আমি মনে মনে পড়ছিলাম লাহাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।

রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, ‘হে আবদুুল্লাহ ইবনে কায়স (আবু আশয়ারীর নাম) আমি কি তোমাকে জান্নাতের খনি মধ্য থেকে একটি খনির কথা বলব? আমি বললাম, হ্যাঁ! বলুন, রাসূল সা: বলেন, ‘তাহলো লাহাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ।’ (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। হজরত আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: আমাকে বলেছেন, ‘তুমি বেশি বেশি করে লাহাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহ পড়ো। কেননা, তা জান্নাতের খনি।’ (তিরমিজি)

প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী।