আমানতের গুরুত্ব ও খিয়ানতের ভয়াবহতা

আমানতের গুরুত্ব ও খিয়ানতের ভয়াবহতা

‘আমানত’ শব্দটি আরবি ‘আমনুন’ মূল ধাতু থেকে নির্গত হয়েছে। যার অর্থ ভরসা করা, আস্থা রাখা। অর্থাৎ কাউকে বিশ্বাস করে তার কাছে কোনো কিছু গচ্ছিত রাখাকে আমানত বলে। আমানত রক্ষা করা অপরিহার্য দায়িত্ব।

পবিত্র কুরআন ও হাদিসে আমানতের খিয়ানত না করার কথা বারবার পড়েছি। আমানতের খিয়ানতকারী সম্পর্কে কঠিন হুঁশিয়ারির বর্ণনাও পেয়েছি। আমাদের মাঝেও আমানত নিয়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হয়। যেমন আমাদের মাঝ থেকে কেউ কারো কাছে কিছু একটা রাখল অথবা কোনো কিছু বলল, তখন বস্তুটি রেখে বা বলেই সাথে সাথে জানিয়ে দেয় এটা তোমার কাছে আমানত হিসেবে রাখলাম। আমরাও কথা দিয়ে দিই যে, তোমার আমানত আমি গ্রহণ করলাম। কিন্তু একবারও ভেবে দেখি না যে, সে যা আমার কাছে রেখেছে তা কী আদৌ আমানত হবে কি-না। একবারও ভেবে দেখি না, অন্যের রাখা সব কিছুই গোপন রাখা আমানত গ্রহীতার জন্য ফরজ কি না?

আমানত রাখার সময় ভেবেচিন্তে রাখা : আমানত হলো, সাধারণত কারো কাছে কোনো হালাল উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পদ গচ্ছিত রাখা। এখানে একটি বিষয় ভালোভাবে লক্ষ রাখতে হবে যে, তা যেন অবৈধভাবে উপার্জিত না হয়। যেমনÑ চুরি, ডাকাতি, ছিনিয়ে আনা সম্পদ আমানত রাখলে তা আমানত হিসেবে হবে না; বরং তার মূল মালিকের খোঁজ পাওয়ার সাথে সাথেই তাকে অবগত করতে হবে এবং তার অর্থ-সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যদি আমানত গ্রহীতা সব জেনেও মূল মালিকের কাছে বিষটি গোপন রাখে তবে চোর, ডাকাত ও ছিনতাইকারী চুরি, ডাকাতি ও ছিনতাই করে যে গোনাহের কাজ করল, যার কাছে গচ্ছিত সেও সত্যকে গোপন রেখে ততটুকুই গোনাহের কাজ করল। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘মানুষ যখন কোনো অন্যায়কারীকে দেখেও অন্যায় থেকে তার হাতকে প্রতিরোধ করবে না, অতিসত্বর আল্লাহ তাদের সবার ওপর ব্যাপক আজাব নাজিল করবেন’ (তিরমিজি ও আবু দাউদ)।

কোন কোন বস্তু আমানত হিসেবে হবে : আমানত শুধু ধনসম্পদ নয়, বরং ব্যাপকার্থে যেকোনো জিনিস গচ্ছিত রাখাকেই আমানত বলে। ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি-বাকরি, সরকারি-বেসরকারি দাফতরিক কার্যক্রম, শিক্ষকতা, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক দায়িত্ব, মজুরি ইত্যাদি সবই আমানতের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ মানুষের সুস্থ বিবেক, হাত-পা, চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ঠোঁট ইত্যাদি প্রত্যেকটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই অপরের কাছে আমানতস্বরূপ। পক্ষান্তরে নিজের কাছেও আমানতস্বরূপ। এগুলোর ব্যবহার প্রসঙ্গে বিচার দিবসে জিজ্ঞেস করা হবে। আল্লøাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘চোখের খিয়ানত এবং অন্তর যা গোপন রাখে তা তিনি জানেন’ (সূরা আল মুমিন-১৯)।

অনুরূপভাবে, শরিয়তের ফরজ কাজ, সতিত্বের হিফাজত, ফরজ গোসল, নামাজ, জাকাত, রোজা, হজ ইত্যাদিও আমানত। এ কারণে বেশির ভাগ মনীষী বলেন, দ্বীনের যাবতীয় কর্তব্য আমানতের অন্তর্ভুক্ত (তাফসিরে কুরতুবি, ১৪তম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৭৯)।

আমানতের খেয়ানত : আমানতের খিয়ানত না করার মধ্যে অন্যতম আরেকটি বিষয় হলো, অন্যের কোনো গোপন কথা কারো কাছে আমানত রাখলে, তা প্রকাশ করে খিয়ানত না করা। তবে, গোপন বিষয়টি প্রকাশের মাঝে যদি ওই ব্যক্তির ইহ ও পরকালীন সফলতা থাকে, তাহলে তার কল্যাণ কামনায় তা প্রকাশ করা ও তাকে সদুপদেশ দেয়া। রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘একজন মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের হক হলোÑ একজন পরামর্শ চাইলে অপরজন পরামর্শ দেবে এবং তার মঙ্গল কামনা করবে’ (আল আদাবুল মুফরাদ-৯২৫)।

বর্ণিত আছে, হজরত আলী রা:-এর খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর একদা রাতের বেলা বাতির আলোতে রাষ্ট্রীয় কাজ করছিলেন। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি বিশেষ প্রয়োজনে তার কাছে এলেন। আলী রা: বাতি নিভিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দিলেন, এতক্ষণ আমি সরকারি কাজ করছিলাম। তাই সরকারি তেল ব্যবহার করেছি। এখন তো ব্যক্তিগত কাজ করছি। সরকারি বাতি ব্যবহার করা আমানতের খিয়ানত হবে।

দায়দায়িত্ব অর্পণের ক্ষেত্রে যোগ্য, কর্মদক্ষ এবং আমানতদার ব্যক্তিকে নির্বাচিত করা উচিত। অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেয়া কিয়ামতের লক্ষণ। এ মর্মে নবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘যখন আমানত নষ্ট করা হবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষায় থাকো’। জিজ্ঞেস করা হলো, আমানত কীভাবে নষ্ট করা হবে? তিনি বললেন, ‘অযোগ্য ব্যক্তির হাতে দায়িত্ব অর্পণ করা আমানত নষ্টকরণের শামিল। আর এমনটি করা হলে বুঝবে কিয়ামত সন্নিকটে’ (বুখারি-৫৯)

একটি দেশ বা জাতির উন্নতি বা অবনতির পেছনে আমানতদারির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আমানতদারিতা এমন এক মহৎ গুণ যার ওপর জাতির উন্নতি ও সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। দেশ বা জাতির জন্য বিভিন্ন পদে দায়িত্বশীল ব্যক্তি যদি সে তার কাছে গচ্ছিত রাখা গোপন তথ্য অন্যের কাছে পাচার করে দেয় তবে সে দেশ বা জাতিকে সহজেই কাবু করা সম্ভব হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা কুরআনুল কারিমে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ তার প্রাপকদের কাছে পৌঁছে দাও’ (সূরা আন নিসা-৫৮)।

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তোমাদের ওপর ন্যস্ত আমানতের খিয়ানত করো না। অথচ তোমরা এর গুরুত্ব জানো’ (সূরা আনফাল-২৭)।

আমানতের খিয়ানত করা কবিরা গুনাহ ও মুনাফিকের আলামত, আর আমানত রক্ষা করা ঈমানদারের আলামত। হাদিসে এসেছে রাসূল সা: বলেছেন, ‘যার মধ্যে আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই, আর যে অঙ্গীকার রক্ষা করে না, তার দ্বীন নেই’ (সুনানে বায়হাকি, শুয়াবুল ঈমান, মিশকাত)।

হাদিসে মুনাফিকির পরিচয় এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, হজরত আবদুুল্লাহ বিন আমর রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, চারটি স্বভাব যার মধ্যে থাকে সে সুস্পষ্ট মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ স্বভাবগুলোর কোনো একটি থাকে, তা ত্যাগ না করা পর্যন্ত তার মধ্যে মুনাফিকির একটি স্বভাব থেকে যায়। আর তা হলো, তার কাছে কেউ কোনো আমানত রাখলে তার খিয়ানত করে। সে কথা বললে মিথ্যা বলে। ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে এবং ঝগড়া করলে গালমন্দ করে। (বুখারি, মুসলিম, আহমাদ)

রাসূল সা: বলেছেন, ‘মুমিনের মধ্যে আর যত দোষই থাক, খিয়ানত তথা বিশ্বাসঘাতকতা ও মিথ্যাচার থাকতে পারে না’ (মুসনাদে আহমাদ)।

হজরত আবু হুরায়রা রা: বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমরা খিয়ানত করো না, কেননা খিয়ানত কতই না শাস্তি ও তিরস্কারযোগ্য অপরাধ’ (আবু দাউদ ও তিরমিজি)।

মহানবী সা: আরো বলেন, ‘তোমার সাথে চারটি জিনিস থাকলে পৃথিবীর সব হারিয়ে ফেললেও তুমি ক্ষতিগ্রস্ত হবে নাÑ ১. আমানতের হিফাজত; ২. সত্যবাদিতা; ৩. উত্তম চরিত্র ও ৪. পবিত্র রিজিক (আল মুসতাদরাক লিল হাকিম-৭৯৮৯)।

লেখক : সদস্য, বাংলাদেশ নবীন লেখক ফোরাম