বাঙালির প্রেরণা তুমি নজরুল

বাঙালির প্রেরণা তুমি নজরুল

‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই। যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই...।’ কবির সেই আকাক্সক্ষাকে সম্মান করেই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবর দেওয়া হয়। আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্র মহাবিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ৭৭ বছর বয়সে ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে (বঙ্গববন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। কবির জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বসবাসের ব্যবস্থা করেন।

কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন চেতনা ও আদর্শে বাঙালির জীবনে চিরন্তন, বাংলাদেশের উত্থান-পতনময় সংগ্রামী ইতিহাসে অবিস্মরণীয়। নির্মম দারিদ্র্য থেকে আজীবন সংগ্রাম করেছেন শোষিত মানুষের মুক্তির জন্য। সোচ্চার ছিলেন সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে। তরুণদের কাছে তিনি বিদ্রোহের অনন্ত প্রতীক। বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে সপ্তম-অষ্টম-দশক পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন ও ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তার কবিতার মাধ্যমে মশাল জ্বেলেছিলেন। আবার প্রেম আর বিরহের এমন মর্মস্পর্শী কবিতা আর গানের প্লাবন এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে, যা তুলে দিয়েছে তার এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য। অসাম্প্রদায়িকতার বরপুত্র ও সাম্যবাদী চেতনার ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ ছিলেন তিনি।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও কাজী নজরুল একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা হিসেবে নিজের দক্ষতা, যোগ্যতা ও মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিণী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীতজগৎকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। ছোটবেলায় রুটির দোকানে কাজ করা, লেটোর দলে যোগদান, যৌবনে যুদ্ধযাত্রা, সাংবাদিকতা, রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতা সব মিলিয়ে বিচিত্র আর বর্ণাঢ্য ছিল তার জীবন। বাংলা কাব্যের ইতিহাসে ‘বিদ্রোহী’ এবং আধুনিক বাংলা গানের ‘বুলবুল’খ্যাত এ কবি বিশ ও ত্রিশের দশকে অবিভক্ত বাংলার, এমনকি উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক জগতের সবচেয়ে বর্ণাঢ্য ব্যক্তিত্ব। নজরুল তার কবিতা, গান, সাংবাদিকতা, রচনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, উপন্যাসসহ অন্যান্য লেখনী এবং রাজনৈতিক কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে পরাধীন ভারতে, বিশেষ করে অবিভক্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্য ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সোচ্চারকণ্ঠ ছিলেন। সে কারণে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তার লেখনী ধূমকেতুর মতো আঘাত হেনে জাগিয়ে দিয়েছিল ঘুমন্ত ভারতবাসীকে। গণবিদ্রোহ সৃষ্টিতে ইন্ধন জোগানোর অভিযোগে ইংরেজ সরকার তার একাধিক গ্রন্থ ও রচনা করেছে বাজেয়াপ্ত; তাকে নিক্ষেপ করেছে কারাগারে।

কারাগারেও চিরবিদ্রোহী ছিলেন কবি নজরুল, প্রতিবাদ করেছিলেন ব্রিটিশ সরকারের জেল-জুলুমের। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসক-শোষকদের ভিত্তিমূল কাঁপিয়ে দিয়েছিল তার আগুনঝরা কবিতা আর শেকল ভাঙার গান। ‘বিদ্রোহী’, ‘অগ্নি-বীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ফণি-মনসা’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘প্রলয় শিখা’র মতো কবিতার ঝঙ্কারে শুধু শোষক-শাসকের ভিত্তিমূলই কাঁপেনি, কেঁপে উঠেছিল সমগ্র বাংলাও। কারণ এমন কবিতা বাঙালি এর আগে কখনো শোনেনি। প্রেমের কবিতায়ও নিয়ে এলেন যেন নতুন জোয়ার। ধর্মান্ধতা, নারীর প্রতি বৈষম্য, সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষদের উপেক্ষা আর ধর্মীয় কূপম-ূকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন বিদ্রোহী কবি। তাই শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও আজও তিনি প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক। বাঙালির প্রেরণা।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল, বেতার কবির মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচারে করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচির মধ্যে ফজরের নামাজের পর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে কোরআনখানি; সকাল ৭টায় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জমায়েত হয়ে সোয়া ৭টায় উপাচার্যের নেতৃত্বে শোভাযাত্রা করে কবির সমাধিতে পুষ্পার্পণ এবং ফাতেহা পাঠ; পরে সমাধি প্রাঙ্গণে উপাচার্যের সভাপতিত্বে আলোচনাসভা হবে; সঙ্গে থাকবে কবিতা পাঠ ও কবির প্রিয় সংগীত।

এমজে/