ভাষার বিবর্তনে হতাশ হওয়ার কিছু নেই

ভাষার বিবর্তনে হতাশ হওয়ার কিছু নেই

বাংলা ভাষার অগ্রগতি, বাংলা ভাষার প্রাপ্তি বা বাংলা ভাষার অর্জন নিয়ে কথা বলতে গেলে আমরা বারবার বাহান্নর কথা বলছি। কারণ হলো বাহান্নর উপ্ত বীজ দিয়েই আমাদের স্বাধীনতা। এখন ভাষা থেকে যে বীজের উৎপত্তি, যে গাছ হলো এবং পরবর্তীতে যে ফল ধরল- এটা একাত্তরের ফল। একটা জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, তার জীবনযাপন, বসবাস, জীবনযাত্রার কলাকৌশল- সবকিছুতে ভাষার প্রভাব পড়ে। ভাষার ভিতরে তিন ধরনের জিনিস থাকে। ধ্বনি, রূপ এবং বাক্য সংগঠন। এই তিনটি তো এত বছরে একরকম থাকতে পারে না। মূলটা মূলের জায়গাতেই আছে, বিবর্তনে আমরা এতদূর চলে এসেছি। বিবর্তন অবশ্যই হতে পারে এবং হয়। তার জন্য হতাশ হওয়ার কিছু নেই।

এখনকার তরুণ প্রজন্মের লেখা প্রসঙ্গে সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি নিয়ে সোজা করে কিছু বলা যাবে না। সবার তো নিজের মনের মধ্যে একটা ভাষার পরিমাপক থাকে। সেটা দিয়ে সবসময় যুগের সঙ্গে মেলানো যায় না। পরিবর্তন এসেছে। প্রযুক্তির কারণেও অনেক কিছুতে পরিবর্তন এসেছে যা বাহান্নতে কেউ ভাবেনি, আমরা যারা একাত্তরের প্রজন্ম তারাও ভাবতে পারিনি। তরুণ প্রজন্ম এই প্রযুক্তিকে গ্রহণ করেছে। আমি নিজে থাকি দেশ থেকে অনেক দূরে, প্রযুক্তির সুবাদে আমি দূরে থেকেও বাংলাদেশে থাকতে পারি। প্রযুক্তি না থাকলে আমার মতো একজন কবি বৈশ্বিক পরিমন্ডল থেকে যা আহরণ করছি তা কিন্তু বাংলা ভাষার মূল খনিতে দিতে পারতাম না। কাজেই প্রযুক্তির সঙ্গে তরুণদের যে যোগসূত্রতা, ওদের যে অনলাইন পত্রিকা, ওদের যে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, এতে আমি খুবই আশাবাদী। এমনকি কবিতার তো অসাধারণ পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করেছি। কবিতা জীবনমুখী হয়েছে বলা যাবে না, তবে আধুনিকতা এসেছে। পুরো বিশ্ব তো এখন চোখের পর্দার মধ্যে। এই পর্দা দেখে ভাষাও তার সঙ্গে এগোচ্ছে। আমি তরুণ প্রজন্মের প্রতি ভীষণভাবে আকর্ষিত। আমাদের সন্তানরাই আগামী। আমার অবস্থান থেকে তাদেরকে পরিমাপ করলে হবে না বরং ওদের সঙ্গে ছুটলেই ওদেরকে বুঝতে পারব।

এ জন্য তরুণদের পরামর্শ দেওয়া নয়, তরুণদের কাছ থেকে আমি উল্টো পরামর্শ নিই। আমি শুনি ওরা কী বলে। ওরা কীভাবে একটা বিষয়ের মধ্যে প্রবেশ করে। তাকে কী করে সঞ্চালন করে। ভাষাটার মধ্যে কোথায় ওজন দেয়। ভাষা তো স্পঞ্জের মতো। যা দেবে তাই শুষে নেবে। এ জন্য একটা সময় নিজেকেই ভাবতে হয় আমি কী দিচ্ছি। নিজের জন্যই আমি তরুণদের লেখা পড়ি। তাদের কাছে যাই। অন্যদিকে নিজের দায়িত্ববোধ থেকে আমি আমার চর্চাটা করে যাই। কবিতা লিখতে প্রচুর পড়তে হয়, প্রচুর কবিতা শুনতে হয়। আমার তো সেই সুুযোগ আছে। আমি অনেক বড় বড় কবিদের সঙ্গে বিলেতে কাজ করি। একসঙ্গে মঞ্চে দাঁড়াই। বাংলা ভাষার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে দাঁড়াই এটা আমার অনেক বড় স্পর্ধা। বাংলাদেশে থাকলে হয়তো আমি আরও গুরুত্ব পেতাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে আমার মতো বাংলাদেশের খুব কম কবি-সাহিত্যিক আছেন। কাজেই আমি যে বাংলা ভাষার জন্য কাজ করছি, আমি যে বিলাসী কবি, ৩০ বছর বাইরে থাকা সত্ত্বেও ভিতরে যে এত বাংলা গেড়ে বসে আছে, তাকে যে প্রতিনিয়ত এক ধরনের অনুবাদ করে চলেছি ইংরেজিতে, এটা তো আমার বাংলাদেশেরই অর্জন। আমি মঞ্চে পরিবেশন করছি কবিতা, দ্বিভাষিক কবিতা, ইংরেজির মধ্যে দিয়ে বাংলা, বাংলার মধ্যে হঠাৎ ইংরেজি অথবা শুধু ইংরেজি। কিন্তু বাংলাদেশের একাত্তর, ফাল্গুন, গোলাপজল, কৃষ্ণচূড়া এগুলো ঠিকই আসছে সেই ইংরেজির মধ্যে। সুন্দর একটা কাপড়ে আমরা প্রত্যেকেই এক একটা আঁশ। আমরা যার যার মতো ওই কাপড়ে আঁশের মতো আছি। উল্টো দিকে তখন ফুটে উঠছে ছবিটা।

দুটো ভাষা শিল্পিতভাবে ব্যবহার করার জন্য আমাকে কিছু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে হয়েছে। যে ভাষা আমার নয় সেটা ব্যবহার করতে শেখা আমার জন্য একটু কঠিন ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিন এর সঙ্গে থাকা, শিক্ষকতার সঙ্গেও আছি, সব মিলে এখন মনে হয় দুটো ভাষায় সমান পারঙ্গম না হলেও দুটো ভাষাই কাজে লাগছে খুব।

লেখক: কবি ও সাহিত্যিক। অনুলেখক: শামীম আহমেদ।