মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বৃটেন: বৃটিশ মন্ত্রী

মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে বৃটেন: বৃটিশ মন্ত্রী

বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত সরকারি-বেসরকারি ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন ইউরোপের সর্ববৃহৎ কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এন্ড্রু স্টিফেনসন।

স্টিফেনসন বলেন, "এ ব্যাপারে ‘হিউম্যান রাইটস নিষেধাজ্ঞা’ নামের একটি নতুন বিষয় বৃটেনের আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। পার্লামেন্টের আগামী আইন প্রণয়ন সেশনে এই বিল উত্থাপন করা হবে।"

বৃটিশ বাংলাদেশি কমিউনিটি অ্যালায়েন্সের উদ্যোগে ১০ই মার্চ হাউজ অব কমন্সের কমিটি রুমে এই সেমিনার আয়োজন করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন এই শিরোনামে কনজারভেটিভ পার্টির এমপি ক্রিস্টিয়ান ওয়্যাকফর্ড এর সভাপতিত্বে সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা বার্ণলীর সাবেক কাউন্সিলর মোজাক্কির আলীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সেক্রেটারি ফয়জুন নূর।

সংগঠনের প্রেসিডেন্ট আফজাল জামি সৈয়দ আলী সেমিনারের থিম পেপার উপস্থাপন করে বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আকস্মিকভাবে ঘটে না। সামাজিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এগুলোর অনুমোদন করার জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিস্থিতিগুলো প্রস্তুত করা হয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থানের সময় রাষ্ট্রকাঠামোকে এ কাজে ব্যবহার করা হয় এবং তার প্রধান উদাহরণ হলো বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার।

সেমিনারে অন্যান্য আলোচকের মধ্যে কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির ডাটা সাইন্সের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. ইমতিয়াজ খান তার বক্তব্যে দেখান কিভাবে সোশ্যাল মিডিয়াতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো সামাজিক বলয়ে গ্রহণযোগ্য ও আলোচনার বিষয়ে পরিণত করা হয়।

হাউজ অব লর্ডস এর মেম্বার লর্ড কুরবান তার বক্তব্যে বলেন, দুই দশক আগে তিনি যখন বার্মায় যান তখনই তিনি মুসলিমবিরোধী উস্কানি এবং উত্তেজনা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য দেখে এসেছেন। সেগুলো নিয়ে তখন কেউ কোনো কথা বলেনি, মাথা ঘামায়নি। তার পরিণতি হল আজকের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি, ভয়াবহ গণহত্যা এবং জাতিগত নিধন অভিযান। ১৯২০-৩০ সালের দিকে নাৎসিদের ব্যাপারে ইউরোপের ভূমিকাও এরকমই ছিলো। তখনও তারা বুঝতে পারেনি দু’বছর পরে কি ঘটতে যাচ্ছে।

তাহরীক-ই-কাশ্মীরের ইউকে প্রেসিডেন্ট ফাহিম কায়ানি তুলে ধরেন গত সাত মাস ধরে কিভাবে মধ্যযুগীয় কায়দায় ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের ওপর অবরোধ আরোপ করা হয়েছে। পনের হাজার কাশ্মীরি তরুণ ভারতের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি আছে। যেখানে তাদের পিতামাতা জানেন না তাদের অবস্থান। তারা জীবিত আছে, নাকি মারা গেছে বা তাদের স্বাস্থ্যের অবস্থা কি এ বিষয়ে পরিবারের কাউকেই কিছু জানানো হয়নি।

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লন্ডন মিডিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল সৈয়দ মামনুন মুর্শেদ আরএসএস এর রাজনৈতিক আদর্শ তুলে ধরে বলেন, নরেন্দ্র মোদি এই সংগঠনের একজন আজীবন সদস্য এবং সাম্প্রতিক নাগরিকত্ব আইন সেটা এই গণহত্যার মানসিকতার ভেতর দিয়েই তৈরি করা হয়েছে। সাম্প্রতিককালে দিল্লিতে মুসলিম এবং তাদের সম্পদের ওপর জাতীয়বাদী হামলাও এই মানসিক কাঠামোর ফল।

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব শামসুল আলম লিটন বাংলাদেশ ব্রডকাস্ট সাংবাদিক এবং সিভিল রাইট অ্যাক্টিভিস্টদের কর্মক্ষেত্রে আতঙ্কের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে টর্চার সেল এবং আদালত ও রাজপথে নৈরাজ্যের মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশের আইনি অধিকার পুরোপুরি কেড়ে নেয়া হয়েছে। ফ্যাসিবাদের উত্থান শুধু বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার জন্যই নয় বিশ্বের অন্যান্য অংশেও এর নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। এছাড়া উদার গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ হলে বিভিন্ন অগণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান আঞ্চলিক অঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ভারত ও বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কমনওয়েলথ ও জাতিসংঘের এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা জরুরি।

শ্যাডো মিনিস্টার আফজাল খান এমপি, স্যাডো মিনিস্টার কেইট হলার্ন এমপি, লর্ড কোরবান হোসেইন, কনজারভেটিভ পার্টির সর্বকনিষ্ঠ এমপি সারা ব্রিটক্লিফ, লেবার পার্টির বাঙালি বংশোদ্ভূত এমপি আফসানা বেগম, সাবেক এমপি গ্রাহাম জন্স, কান্ট্রি কাউন্সিলর পিটার ব্রিটক্লিফ, কনজারভেটিভ গ্রুপ লিডার কাউন্সিলর এন্ড্রু নিউহাউস সেমিনারে বক্তব্য রাখেন।

বক্তারা বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে বিশ্ববাসী উদ্বিগ্ন এবং এরকম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো বিশেষ করে যখন এগুলো ঘটে সরকার এবং আদালতের মাধ্যমে বানানো আইনকে অপব্যবহার করে, তখন মানবাধিকারের বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ থাকে। কারণ এ জাতীয় কাঠামোগুলোর ভেতর দিয়ে এ রকম চিন্তা এবং মানসিকতার প্রযোজনায় এই পৃথিবীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বড় ঘটনাগুলো ঘটে।

সেমিনারের প্রধান বক্তব্য আসে ইউরোপের সর্ববৃহৎ কনস্ট্রাকশন প্রজেক্ট এর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এন্ড্রু স্টিফেনসন এর ঘোষণায়।

তিনি বলেন, বৃটিশ মন্ত্রী পরিষদ এই মূহুর্তে একটি নীতি পর্যালোচনা করছে, যার মাধ্যমে হাউস অব কমন্সের আসন্ন আইন প্রণয়ন সেশনে একটি নতুন বিল উত্থাপন করা হবে। যার মাধ্যমে ‘হিউম্যান রাইটস নিষেধাজ্ঞা’ নামের একটি নতুন বিষয় বৃটেনের আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সরকার বা সরকারের বাইরের ব্যক্তিবর্গ- যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের আনুষ্ঠানিক- উপানুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কাঠামোগুলোর সাথে সম্পৃক্ত, তাদেরকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

যারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো ঘটায় বা ঘটাতে সহায়তা করে তাদের চিহ্নিত করে আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় নিয়ে আসার জন্য বৃটিশ বাংলাদেশী কমিউনিটি অ্যালায়েন্স দীর্ঘদিন ধরে একটি আইনী কাঠামোর সুপারিশ করে আসছে। প্রস্তাবিত আইনের আওতায় সুনির্দিষ্ট ব্যক্তিবর্গের ওপর আন্তর্জাতিক ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা এবং জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর কাঠামোর অধীনে পৃথিবীর কোথাও কর্মে নিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে। মন্ত্রী বলেন, এটা করা গেলে এটি হবে একটি অসাধারণ অর্জন।

সেমিনারে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া জামিন না পাওয়ায় গভীর উদ্বেগ জানানো হয় এবং বৃদ্ধ বয়সে উন্নত চিকিৎসার অভাবে তার প্রতি অমানবিক আচরণের প্রতিবাদ জানানো হয়। চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে উল্লেখ করে বলা হয়, তার জীবন নিয়ে এখন তার চিকিৎসকরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

সেমিনারে অন্যান্যের মধ্যে, সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার শোয়েব মুকিত, সাংবাদিক অলিউল্লাহ নোমান, সাংবাদিক আহসানুল আম্বিয়া শোভন ও যুক্তরাজ্যে বৃটিশ বাংলাদেশ কমিউনিটির বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ সেমিনারে অংশ নেন।

এছাড়া অতিথি হিসেবে অংশ নেন, ভারতীয় বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল ও কাশ্মীর ইস্যুতে নির্যাতনের প্রতিবাদকারী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিবৃন্দ। ট্রেজারার আবিদুল ইসলাম আরজু সেমিনারে অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানান।