টকশো নিয়ন্ত্রণে আইন?

টকশো নিয়ন্ত্রণে আইন?

ঢাকা, ১৭ অক্টোবর (জাস্ট নিউজ) : মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সম্প্রচার আইন-২০১৮'র খসড়া নীতিগতভাবে অনুমোদিত হয়েছে৷ আইনের খসড়ায় টেলিভিশনের টক শো-তে মিথ্যা, অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য দিলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিচেনার প্রস্তাব করা হয়েছে৷

‘সম্প্রচার আইন ২০১৮' সম্পর্কে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, প্রস্তাবিত আইনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্র ও সকার প্রধানের ব্যাপারে বিকৃত ও বিভ্রান্তিমূলক তথ্য প্রকাশের দায়ে তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকার জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের কথা বলা হয়েছে৷ এছাড়া টক শো-তে মিথ্যা ও অসত্য তথ্য প্রচার করলে একই সাজার কথা বলা আছে এই আইনে৷

এই আইনে সম্প্রচার কমিশন, সম্প্রচার নীতিমালা, সম্প্রচার লাইসেন্স সবকিছুই রয়েছে৷ আইনের লঙ্ঘন হলে মোট ২টি ধারায় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে৷ ১৯ ধারায় লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে সাত বছরের কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা৷ আর ২৮ ধারায় তিন বছরের কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে৷ এই ধারা অনুযায়ী, ২৪ ধরনের অপরাধের মধ্যে টেলিভিশনে আলোচনা অনুষ্ঠানে (টক শো) মিথ্যা, অসত্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদানও রয়েছে৷

সম্প্রচার আইনের আওতায় রয়েছে প্রিন্ট, টেলিভিশন, রেডিও, অনলাইন৷ প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, ‘‘সম্প্রচার ও অনলাইন মাধ্যমে সরাসরি বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে দেশবিরোধী ও জনস্বার্থবিরোধী বক্তব্য প্রচার করা যাবে না৷ আলোচনা অনুষ্ঠানে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য বা উপাত্ত প্রচার করা যাবে না৷ দেশীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ভাবধারার পরিপন্থি অনুষ্ঠান বা বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না৷ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে এমন সামরিক, বেসামরিক ও সরকারি তথ্য প্রচার করা যাবে না৷ এছাড়া বিজ্ঞাপনে শিশুদের পরনিন্দা, বিবাদ ও কলহের দৃশ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে অংশগ্রহণের দৃশ্য দেখানো যাবে না৷ আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে উৎসাহ সৃষ্টি করতে পারে বা আইন-শৃঙ্খলা ভঙ্গের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি করতে পারে এমন অনুষ্ঠান বা বক্তব্যও প্রচার করা যাবে ন৷এসব বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করলেও সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে৷

সম্প্রচার কমিশন
গণমাধ্যম পরিচালনার জন্য গঠিত সম্প্রচার কমিশন গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্স প্রদান করবে৷ এছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কমিশনে অভিযোগ করে ফল পাওয়া যাবে৷ বাংলাদেশের ভূখন্ডের যে-কোনো প্রান্ত থেকে প্রিন্ট-অনলাইন-ইলেকট্রনিক মিডিয়া- রেডিওসহ যে-কেনো মাধ্যমের সম্প্রচার সংবাদ বলে গণ্য হবে৷ গণমাধ্যমগুলো পরিচালনার জন্য সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশন গঠন করা হবে৷

এই কমিশন গঠনে পাঁচ সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হবে৷ সার্চ কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগ দেবেন৷ কমিশনে একজন নারী কমিশনার রাখার বিষয়ে বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে৷ কমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিযুক্ত হতে সংশ্লিষ্ট পেশায় ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে৷ সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সম্প্রচার যন্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হবে এই কমিশনের প্রধান কাজ৷ লাইসেন্স প্রদানে কমিশনের একক কর্তৃত্ব থাকবে৷

লাইসেন্স প্রাপ্তির শর্তের ব্যত্যয় ঘটলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে৷ এই অপরাধগুলো জামিনযোগ্য এবং বিনা ওয়ারেন্টে কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না৷

গণমাধ্যম কর্মী আইন
মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলী) আইন-২০১৮'-এর খসড়ায় অনুমোদন দেয়া হয়েছে৷ এই আইনে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে কর্মরতদের ‘গণমাধ্যমকর্মী' হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে৷ ইংরেজিতে বলা হবে ‘মাস মিডিয়া এমপ্লয়িজ'৷

প্রস্তাবিত আইনে গণমাধ্যম কর্মীদের সাপ্তাহিক কর্মঘণ্টা হবে সর্বোচ্চ ৩৬ ঘণ্টা৷ এর বেশি হলে তাঁদের ওভারটাইম দিতে হবে৷ কর্মীরা বছরে ক্যাজুয়েল লিভ পাবেন ১৫ দিন৷ তাঁদের অর্জিত ছুটি জমা হবে ১০০ দিন৷ আগে তা ৬০ দিন ছিল৷ এছাড়া পূর্ণ বেতনে দুটি উৎসব ভাতা ও ১০ দিন উৎসব ছুটি পাবেন কর্মীরা৷ আইনে কর্মীদের ওয়েজ বোর্ড অনুসারে ন্যূনতম বেতন পরিশোধের পাশাপাশি তাঁদের প্রভিডেন্ট ফান্ডের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে৷ এই ফান্ডে কর্মীরা চাকরির এক বছরের মাথায় চাঁদা জমা দিতে পারবেন৷ মালিক পক্ষকেও ওই ফান্ডে সমহারে চাঁদা জমা দিতে হবে৷

আইনে বলা হয়েছে,গণমাধ্যমকর্মী ও মালিক পক্ষের মধ্যে সমস্যা সৃষ্টি হলে ‘এডিআর'-এর মাধ্যমে তা নিষ্পত্তি করতে হবে৷ মালিক পক্ষকে এই আইনের সব বিধান পালন করতে হবে৷ এর ব্যত্যয় হলে বা লঙ্ঘিত হলে সর্বনিম্ন ৫০ হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে৷

প্রতিক্রিয়া
স্যাটেলাইট টেলিভিশন গাজী টিভির এডিটর, কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স এবং টকশো ‘জি ডায়ালগ'-এর উপস্থাপক অঞ্জন রায় বলেন,‘‘কেউ যদি মিথ্যা তথ্য দেয়, সেটা অবশ্যই অপরাধ৷ কিন্তু যাঁরা টক শো-তে আসেন তাঁদের যদি এই ধরনের নৈতিকতা থাকে যে, তাঁরা মিথ্যা তথ্য দেবেন না, তাহলে এই ধরনের বিষয় সামনে আসতো না৷ এই আইনটি যদি প্রতিহিংসার জায়গা থেকে ব্যবহার করা হয়, তা হবে খুবই দুঃখজনক৷ এখন যেহেতু অনেক কিছুই হচ্ছে, সম্প্রচার নীতিমালা, ডিজিটাল আইন, এ কারণে বিষয়টি আইন পর্যায়ে সামনে এসেছে৷ কিন্তু আমার কথা হলো, আমরা যদি নৈতিক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, সেটি মনে হয় আইনের চেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হবে৷''

একাত্তর টেলিভিশনের টক শো একাত্তর জার্নালের উপস্থাপক এবং কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর মিথিলা ফারজানা মনে করেন এই প্রস্তবিত আইনে এক ধরনের কঠোরতা আছে৷ তিনি বলেন, ‘‘কখনো কখনো দেখা গেছে বক্তা বলছেন, তথ্য দিচ্ছেন, কিন্তু তাঁর কাছে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই৷ নিয়ন্ত্রণ না হলেও সেই তথ্যগুলো কিভাবে যাচাই-বাছাই হবে৷ কারণ, এটা তো একটা পাবলিক ফোরাম৷ তবে তথ্য সঠিক কী সঠিক নয় তা যাচাই-বাছাই কে করবেন? কমিশন যাচাই বাছাই করবে বলে শুনছি, তবে আসলে তা এখনো স্বচ্ছ নয়৷ সামনে নির্বাচন৷ এই সময়ে এই আইনটি মানুষের মধ্যে চিন্তা বা দুশ্চিন্তার জন্ম দেবে বলে আমার কাছে নিশ্চিতভাবেই মনে হয়৷''

এখানে উপস্থাপকের দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘‘এ ধরনের তথ্য নিয়ে উপস্থাপক হিসেবে আমি সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি, সংশয় প্রকাশ করতে পারি৷''

সাপ্তাহিক-এর সম্পাদক এবং বিভিন্ন টক শো-র নিয়মিত আলোচক গোলাম মোর্তোজা বলেন,‘‘যে কোনো প্রচারমাধ্যম যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো অসত্য তথ্য প্রচার করে, তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো ব্যবস্থা নেয়া৷ এটা সাধারণভাবে বলা যায়৷ কিন্তু বিভ্রান্তি ছড়ালে বা অসত্য তথ্য দিলে যে আইনের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে যে কোনো বক্তব্যকে, যে কোনো কথাকে এই আইনের মধ্যে ফেলে ব্যবস্থা নেয়া যায়৷ আমার কাছে যেটা সঠিক, সেটা আপনার কাছে সঠিক মনে না-ও হতে পারে৷ আপনি মনে করলেন আমি বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছি৷ তার ভিত্তিতে জেল-জরিমানার ব্যবস্থা করা৷ যেমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই৷ আপনি যদি আপনার মতো করে একটা লেখা লেখেন, মতামত দেন, তখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা মনে করতে পারেন, আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কাজ করলাম৷''

তিনি বলেন,‘‘আইনটি এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যাতে যে কোনো কথাকেই চাইলে আইনের মধ্যে ফেলা যায়৷ এখন আমার কথা হলো, কথা বলা বা বাক-স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য এত আইন-কানুন, নিয়ম না করে সরকার ঠিক করে দিলেই পারে, কোন কথা বলা যাবে, কোন কথা বলা যাবে না৷ এতে সরকারেরও পরিশ্রম কমে যায়৷ আমাদেরও আতঙ্ক কমে যায়৷''

নির্বাচনের আগে এই আইনের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,‘‘এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর সুনির্দিষ্ট করে দেয়া এখন কঠিন৷ কারণ, এটা আইনের ওই বিভ্রান্তিকর তথ্যের মধ্যে পড়ে যেতে পারে৷ আমি এই যে কথাটি বললাম, সেটা কোনো অসত্য তথ্য বা বিভ্রান্তি ছড়ানোর মধ্যে পড়ে কিনা, সেটা নিয়েও আমি চিন্তিত৷'' সূত্র: ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/১২১৮ঘ.)