বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

মোটরসাইকেলে নিষেধাজ্ঞাকে কীভাবে দেখছেন সাংবাদিকরা?

মোটরসাইকেলে নিষেধাজ্ঞাকে কীভাবে দেখছেন সাংবাদিকরা?

ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর (জাস্ট নিউজ) : ঢাকার একটি অনলাইন সংবাদ মাধ্যমের ফটোসাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান আগে কয়েকটি জাতীয় নির্বাচন কাভার করেছেন, ছবি তুলেছেন। কিন্তু এবার তিনি বুঝতে পারছেন না, কতটা ভালোভাবে নির্বাচনটি তিনি কাভার করতে পারবেন।

তিনি বলছেন, “একজন ফটোসাংবাদিক হিসাবে আমাদের অনেক স্থানে দ্রুত যেতে হয়, ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলতে হয়। মোটরসাইকেল নিয়ে যত সহজে, ছোটখাট অলিগলিতে যেতে পারি, গাড়ি নিয়ে সেটা কখনোই সম্ভব না।”

“হয়তো আমি যেতে যেতেই ঘটনা শেষ হয়ে যাবে। তাই ফটোসাংবাদিকদের ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে না পারলে কাজে খুব সমস্যা হবে।”

তার মতো চিন্তায় পড়েছেন বাংলাদেশের আরো অনেক সাংবাদিক ও সাধারণ মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী।

কারণ বাংলাদেশে নির্বাচনের সময় টানা তিনদিন মোটরসাইকেল ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচন কমিশন এক ঘোষণায় জানিয়েছে, ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাত থেকে শুরু করে দিবাগত মধ্যরাত পর্যন্ত বেবি ট্যাক্সি বা অটোরিকশা, ট্যাক্সি ক্যাব, মাইক্রোবাস, জিপ, পিকআপ, কার, বাস, ট্রাক, টেম্পো, ইজিবাইক বা স্থানীয় পর্যায়ের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে।

তবে মোটরসাইকেলের ওপর খড়গ পড়ছে আরো বেশি। নির্বাচনের আগে পরে, অর্থাৎ ২৮ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখ মধ্যরাত ১২টা থেকে ১লা জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ থাকছে। এমনকী সাংবাদিকরাও বিশেষ কোনো ছাড় পাবেন না।

যদিও প্রার্থী বা তাদের এজেন্ট, সাংবাদিক, পর্যবেক্ষকদের মতো পেশাদারি কাজে অন্য যানবাহনের জন্য বিশেষ স্টিকার দেয়া হবে কমিশনের পক্ষ থেকে, কিন্তু মোটারসাইকেল এই স্টিকার পাবে না।

সংকটে সাংবাদিকরা
নির্বাচন কমিশনের এই নিষেধাজ্ঞায় সবচেয়ে সমস্যায় পড়তে চলেছেন মাঠ পর্যায়ে কর্মরত সাংবাদিকরা।

পেশাগত কাজে ঢাকা এবং বাইরের শহর গুলোয় মাঠ পর্যায়ের সাংবাদিকদের বেশিরভাগই খবর সংগ্রহের কাজে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন। ফলে নির্বাচনের সময় এই বাহনটি ব্যবহারের সুযোগ না পেলে তা তাদের কাজ বড় ধরণের সমস্যা তৈরি করবে বলেই সাংবাদিকরা আশঙ্কা করছেন।

এর আগের নির্বাচনগুলোর সময় মোটরসাইকেলের জন্য কমিশনের পক্ষ থেকে অনুমতিসূচক স্টিকার বরাদ্দ করা হলেও, এবার নির্বাচন কমিশন জানিয়ে দিয়েছে যে, মোটরসাইকেলের জন্য কোন স্টিকার দেয়া হবে না।

রাজশাহীর সাংবাদিক আনোয়ার আলী বলছেন, “মোটরসাইকেলে করে যেকোনো ঘটনাস্থলে আমরা দ্রুত যাতায়াত করতে পারি। কোনো খবর পেলে দ্রুত ছুটে যেতে পারি।”

“কিন্তু তিনদিন ধরে এই বাহনটি বন্ধ রাখা হলে আমাদের গতি নিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। তখন কোনো ঘটনার খবর জানা গেলে সঙ্গে সঙ্গে হয়তো সেখানে যেতো পারবো না। অন্যদের কথা শুনে লিখতে হবে।”

তিনি জানান, বরাবরই তারা নির্বাচনের সময় মোটরসাইকেল ব্যবহার করে আসছেন। এবারই প্রথমবারের মতো সাংবাদিকদের মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে এ ধরণের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।

ফলে অনেক স্থানের স্থানীয় সাংবাদিকরা কয়েকজন মিলে নির্বাচনের দিন গাড়ি ভাড়া করে দায়িত্ব পালনের পরিকল্পনা করছেন।

যেমন ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের সাংবাদিক আব্দুস সবুর বলছেন, “মোটরসাইকেল ব্যবহার করা যাবে না শুনে আমরা কয়েকজন সাংবাদিক মিলে গাড়ি ভাড়া করেছি। সেটায় করে একত্রে যাতায়াত করতে হবে।”

তবে এভাবে গাড়িতে করে দুর্গম এলাকাগুলোয় যাতায়াত যেমন কঠিন, তেমনি কোন সহিংসতা বা অনিয়মের খবর পাওয়া গেলে বিভিন্ন কেন্দ্রে যাওয়াও সময়সাপেক্ষ হবে বলে তারা মনে করছেন।

চাঁদপুরের স্থানীয় সাংবাদিক আলম পলাশ বলছেন, “মোটরসাইকেল বন্ধ থাকলে আমাদের কাজে চরম সমস্যা হবে। এখানে অনেক আসনে সমস্যা হতে পারে।”

“হয়তো রাস্তাঘাট বন্ধ থাকবে, সহিংসতা হলে গাড়ি নিয়ে যাওয়াও ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আবার অনেক দুগর্ম স্থানে গাড়ি নিয়ে যাওয়াও যায় না। আমরা খুব চিন্তায় পড়েছি যে কিভাবে কাজ করবো।”

তিনি জানান, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন। তবে তাদের জানানো হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত ছাড়া এক্ষেত্রে তাদের কিছু করার নেই।

ঢাকার একটি অনলাইন পত্রিকার ফটোসাংবাদিক নাসিরুল ইসলাম বলছেন, “খবরটি শোনার পর থেকেই আমি খুব চিন্তায় আছি। কারণ আমরা একদিনে তিন চারটা অ্যাসাইনমেন্ট কাভার করি। অনেক স্থানে যেতে হয়।”

“কিন্তু মোটরসাইকেল ব্যবহার করতে না পারলে এই তিনদিনে হয়তো একটি অ্যাসাইনমেন্টের বাইরে আমি কাভার করতে পারবো না। ফলে এই তিনদিন ধরেই আমার চলাফেরা অনেক সীমিত হয়ে যাবে।”

তিনি জানান, একটি দুর্ঘটনার খবর শুনলে গাড়িতে করে সেখানে যেতে যেতেই হয়তো আর কোন ছবি তোলার মতো অবস্থা থাকবে না।'

ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষজন
টানা তিনদিন মোটরসাইকেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় ভোগান্তির আশঙ্কা করছেন শহর ও গ্রাম এলাকাগুলোর সাধারণ অনেক মানুষজন, যাদের পেশা বা ব্যক্তিগত কারণে মোটরসাইকেলে করে যাতায়াত করতে হয়।

ঝালকাঠির বাসিন্দা তৈমুর আলম বলছেন, “আমার পারিবারিক এবং ব্যবসার কাজে চলাফেরার জন্য পুরোপুরি মোটরসাইকেলের ওপর নির্ভরশীল। ব্যবসার কাজে আমাকে প্রতিদিনই শহরের বাইরে যেতে হয়।”

“নির্বাচনের দিন চালাতে পারবো না জানি। কিন্তু আগের পরের দুইদিন চালাতে নিষেধাজ্ঞা থাকা মানে অনেকটা আমার পা বেধে ঘরে বসে থাকার মতো হবে। কারণ বাইক ছাড়া তো আমি ব্যবহার কোন কাজেই যেতে পারবো না।”

তবে রাজশাহীর ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলছেন, যদিও তিনি সবসময়ে মোটরসাইকেলে করেই চলাফেরা করেন, তবে দেশের স্বার্থে কয়েকদিন কষ্ট করতে রাজি আছেন।

তিনি বলছেন, “তিনদিন মোটরসাইকেল বন্ধ থাকবে, তাতে একটু কষ্ট হলেও, দেশের স্বার্থে আমি সেটা ম্যানেজ করে নেবো।”

সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া

নির্বাচন কমিশনের এসব বিধিনিষেধে সাংবাদিকদের কাজে কতটা প্রভাব পড়বে?

ফেসবুকে বিবিসি নিউজ বাংলার পাতায় জানতে চাওয়া হলে এ বিষয়ে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।

আহসানুল হক সুমন মন্তব্য করেছেন, "আমি একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে মনে করি এটি আমাদের কাজে কিছুটা হলেও বিঘ্ন ঘটাবে। নির্বাচন কাভার করতে অনেক দুর্গম এলাকায় যেতে হয়, যেখানে গাড়িতে যাতায়াত করা সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে মোটরসাইকেল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাংবাদিকরা সংবাদ কাভার করবে কিভাবে ????"

তার জবাবে একজন মন্তব্য করেছেন, সেই জন্যই তো মোটরসাইকেল নিষেধ।

তবে মোহাম্মদ শরিফুজ্জামানের মত ভিন্ন। তিনি লিখেছেন, "আমি মনে করি না, এসব বিধিনিষেধ সংবাদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। যেহেতু দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছ, তাই সুষ্ঠু নির্বাচনী পরিবেশ বজায় রাখার জন্য কমিশনকে নানাধরনের পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে।"

আবদুল হালিম চৌধুরী লিখেছেন, "সাংবাদিকদের স্বাভাবিক কাজ অবশ্যই বাধাগ্রস্ত হবে। তবে আজকাল আবার সাংবাদিকের চেয়ে সাংঘাতিকের সংখ্যা বেশি। এটা বিবেচনায় নিলে ঠিকই আছে।" সূত্র: বিবিসি বাংলা।

(জাস্ট নিউজ/ডেস্ক/একে/১৮৪৮ঘ.)