এক বছরে ৩৮ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা

এক বছরে ৩৮ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা

এক বছরে ৩৮ জন সাংবাদিক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা, গ্রেফতার, রিমান্ড ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। দেশের সাংবাদিক ও সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিবাদের মুখে ২০১৮ সালে পাশকৃত বিতর্কিত এই আইনের অপব্যবহারে বয়োজ্যেষ্ঠ সম্পাদক, কলামিস্ট থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের সংবাদ কর্মী পর্যন্ত কেউ রক্ষা পাননি। গ্রেফতার হয়ে এখনো জেলে আছেন অন্তত ৫ জন। পাশের সময় প্রধানমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী বলেছিলেন যে এ আইনটি সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রয়োগের জন্য নয়। এ অপব্যবহার হবে না বলেও আস্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু পাশের পর থেকে এ পর্যন্ত নিপীড়নমূলক এ আইনটির সবচেয়ে বড় শিকার হয়েছেন সংবাদকর্মীরা। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজে’র মনিটরিং সেলে দেশের প্রধান প্রধান সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণায় এ চিত্র পাওয়া গেছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় ৩৮ জন ছাড়াও মানহানিসহ অন্যান্য মামলায় হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন ৫৮ জন সংবাদিক ও সংবাদকর্মী। এ বছর হামলার শিকার হয়েছেন ৯০ জন সাংবাদিক।

বিএফইউজে’র গবেষণা সেলের তথ্য ও পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে- ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি ও অক্টোবর মাসে সর্বোচ্চ ৭ জন করে ১৪ জন সাংবাদিক ডিজিটাল মামলায় আসামী হয়েছেন। সেপ্টেম্বরে ৬ জন এবং জুলাই ও ডিসেম্বর মাসে ৫ জন করে সাংবাদিক এই আইনের শিকার হয়েছেন। জানুয়ারি, মার্চ ও আগস্টে ২ জন করে ৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়। ১ জন করে সাংবাদিক ডিজিটাল মামলার জালে জড়িয়েছেন মে, জুন ও নভেম্বর মাসে। প্রধান ৫টি জাতীয় দৈনিক ও শীর্ষস্থানীয় অনলাইন নিউজপোর্টালে প্রকাশিত এবং বিএফইউজে’র আর্কাইভে সংরক্ষিত সংবাদ ক্লিপিংস এর ভিত্তিতে এ চিত্র উঠে এসেছে। এর বাইরেও ডিজিটাল আইনের শিকার সাংবাদিক থেকে থাকতে পারেন ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খুলনার সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাট্রিবিউনের প্রতিনিধি হেদায়েত হোসেনের গ্রেফতার ও রিমান্ড দিয়ে শুরু হয় ২০১৯ সালের প্রথম মাস। একই মামলায় আসামী হয়ে দীর্ঘদিন ফেরারী জীবন কাটান খুলনা প্রেস ক্লাবের সহসভাপতি ও মানবজমিন প্রতিনিধি রাশিদুল ইসলাম। ফেব্রুয়ারি মাসে ডিজিটল আইনে গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন ২জন। যুগান্তরের ৫ সাংবাদিক একসঙ্গে ডিজিটাল মামলার আসামী হন। এর মধ্যে আবু জাফর ও আজহারুল হক গ্রেফতার হয়ে জেল খেটেছেন। অন্য আসামীরা হচ্ছেন মোঃ হুমায়ুন কবীর, শামীম খান ও মেহেদী হাসান। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় ইউএনওর নেতৃত্বে যুগান্তরের মোহাম্মদ সেলিম উদ্দিন গ্রেফতার করা হয় একই আইনে। মার্চে বগুড়ার শেরপুরে দেশনিউজ কন্ঠের সাংবাদিক আবদুর রাজ্জাককে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার করা হয়।

মে মাসে ময়মনসিংহ লাইভ ডটকমের সাংবাদিক আবদুল কাইউমকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। জুনে মাসিক বান্দরবানের সম্পাদক ও প্রকাশক মোজাম্মেল হক লিটনকে একই আইনে গ্রেফতার করে পুলিশ । জুলাইতে ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ক্যাম্পাস লাইভ২৪ ডটকমের প্রধান সম্পাদক আজহার মাহমুদের বিরুদ্ধে দিনাজপুরে ডিজিটাল আইনে হয়রানিমূলক মামলা হয়। একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে কমেন্ট করায় এ মাসে দৈনিক সমকালের সাংবাদিক ও সাব এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি জাকির হোসেন ইমনের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেন এক আইনজীবী। একই মাসে দৈনিক আমাদের বরিশাল-এর সম্পাদক প্রকাশক মো. রফিকুল ইসলাম ও গৌরনদী প্রতিনিধি মোল্লা ফারুক হাসানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলা করে গ্রেফতার ও হয়রানি করা হয়।

আগস্টে খুলনা প্রেস ক্লাবের সভাপতির মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রথম সময়ের সম্পাদক শাহীন রহমান। তিনি এখনও জেলে রয়েছেন। এ মাসে যুগান্তরের চাপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি ও যমুনা টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার মনোয়ার হোসেন জুয়েলের বিরুদ্ধে মামলা হয়।

সেপ্টেম্বরে ডিজিটাল আইনের মামলায় চাঞ্চল্যকর নিপীড়নের ঘটনা ঘটে কক্সবাজারের সাংবাদিক ফরিদুল মোস্তফার ক্ষেত্রে। টেকনাফের ওসির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ করায় ডিজিটাল আইনে মামলা দিয়ে ঢাকা থেকে ধরে নিয়ে তার ওপর বর্বর কায়দায় নির্যাতন চালানো হয়। একটি চোখ উপড়ে ফেলাসহ প্রায় পঙ্গু করে দেওয়া হয় তাকে। এ মাসে দ্বিতীয় দফা জেল খাটেন দি নিউনেশন পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ও কলামিস্ট এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেন। এ মাসেই দৈনিক জনতার সম্পাদক আহসান উল্লাহ, প্রকাশক ছৈয়দ আনোয়ার ও সিনিয়র রিপোর্টার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় আসামী হয়ে হয়রানির মুখে পড়েন।

অক্টোবরে সাতক্ষীরায় দৈনিক পত্রদূত সম্পাদক লায়লা পারভিন সেজুঁতি ও দৈনিক কালের চিত্রের সম্পাদক আবু আহমেদসহ ৬ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়। এ মাসেই ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার হন খুলনা প্রেস ক্লাবের সাবেক সেক্রেটারি ও সিনিয়র সাংবাদিক মুনির উদ্দিন। ফেসবুকের একটি স্ট্যাটাসের কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। নভেম্বরে অনলাইন জাগো টিভির সম্পাদক মুনতাসির, সংবাদকর্মী সবুজ ও শাওনকে গ্রেফতার করা হয় ডিজিটাল আইনের মামলায়।

বিদায়ী বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকে একই আইনে গ্রেফতার ও ৩দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। মামলায় আরও আসামী করা হয় বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী ও বার্তা সম্পাদক সাদাত হোসাইনকে। এ মাসেই দৈনিক সমকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি ও পত্রিকার সিলেটে কর্মরত স্টাফ রিপোর্টার মুকিত রহমানির বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়।
সূত্র : প্রেস বিজ্ঞপ্তি

এমজে/