সিটি নির্বাচনে যেসব ছবি তোলার কারণে কোপানো হয় সাংবাদিক সুমনকে

সিটি নির্বাচনে যেসব ছবি তোলার কারণে কোপানো হয় সাংবাদিক সুমনকে

ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের দিন ক্ষমতাসীন দলের ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন খোকনের অ্যাকশন টিমের প্রকাশ্য অস্ত্র পাহারায় বড় আকারের ‘বিশেষ লাগেজ’ ভোটকেন্দ্রে নেয়ার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করতেই সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন নৃশংস হামলার শিকার হন। রামদাধারী ৭/৮ জন দুর্বৃত্ত আগামী নিউজ অনলাইন পোর্টালের ক্রাইম রিপোর্টার সুমনকে ঘিরে নৃশংসভাবে কোপাতে থাকে। তাদের কোপানো শেষ হতেই এগিয়ে আসে অ্যাকশন টিমের অন্য গ্রুপ-তারা ক্রিকেট স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে রক্তাক্ত সুমনের দেহখানা নীরব নিথর বানিয়ে বীরদর্পে চলে যায়।

টানা ১০ মিনিট ধরে নৃশংস এ দুর্বৃত্তপনার জঘন্যতম ঘটনাটি ঘটে মোহাম্মদপুরের জাফরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় ভোট কেন্দ্রের মাত্র কয়েক গজের মধ্যে। ভোট কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে পুরো ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেও নিরীহ সাংবাদিককে রক্ষায় কোনো ভূমিকা রাখেননি। বরং সাংবাদিককে কোপানো শেষে দুর্বৃত্তদের সঙ্গে মিলেমিশেই পুলিশ ও আনসার সদস্যরা ভোটকেন্দ্রের দিকে চলে যায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ মনোনীত কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন খোকন। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী লালন-পালন, জবর-দখল, বেপরোয়া চাঁদাবাজিসহ নানারকম দুর্বৃত্তপনার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালানোর গোটা সময় একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা কেউ নির্বিঘ্নে প্রচার-প্রচারণা পর্যন্ত চালাতে পারেননি। ভোটের দিনও বেশিরভাগ কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কোনো এজেন্ট পর্যন্ত ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নিজের প্রচার-প্রচারণাসহ ভোটের কাজে আলাদা আলাদা গ্রুপ ছিল মোহাম্মদ হোসেন খোকনের। তার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর গ্রুপের নাম ছিল অ্যাকশন টিম। লাল রঙের পেশাক পরনের এ অ্যাকশন টিম সাজানো হয় স্থানীয় ও বহিরাগত সন্ত্রাসী অস্ত্রবাজদের নিয়ে, এদের বেশিরভাগই ভাড়াটে কিলার হিসেবে চিহ্নিত। অ্যাকশন টিমের ৪০/৪৫ জন সদস্যের সকলেই সর্বদা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত থাকতো।

ঘটনার সময় বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মোহাম্মদ হোসেন খোকনের নির্বাচনী কার্যালয়ের দিক থেকে বৃহৎ আকারের একটি লাগেজ নিয়ে অ্যাকশন টিমের লাল পোশাকধারীরা জাফরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের দিকে যেতে থাকে। ওই সময় ভোটকেন্দ্র এলাকায় গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে, মোহাম্মদ হোসেন খোকনের পক্ষে সিল মারা লাগেজ বোঝাই ব্যালট ভোটকেন্দ্রে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। বলতে বলতেই কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র গোঁজা ও প্রকাশ্যে রামদা উচিয়ে ৩০/৩৫ জনের একটি দল জাফরাবাদ উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রের কাছে পৌঁছে যায়। তারা কড়া পাহারায় লাগেজটি নিয়ে ভোটকেন্দ্রের গেটের দিকে যেতে থাকাবস্থায়ই রাস্তার বিপরীত পাশে অবস্থানকারী সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন তার মোবাইল ফোনে একের পর এক ছবি তুলতে থাকেন। কিন্তু বিধি বাম। ছবি তোলার দৃশ্যটি অ্যাকশন টিমের এক সদস্য দেখে ফেলাতেই ওই সাংবাদিকের উপর ভয়াবহ বিপদ নেমে আসে।

জনাকীর্ণ রাস্তায় ধর ধর শব্দে রামদাধারী দৌড়ে এসে সাংবাদিক সুমনকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে রক্তাক্ত করার জঘন্যতায় মেতে উঠে। তাদের কোপানো শেষে রাস্তায় পড়ে থাকা সুমনের মৃত্যু নিশ্চিত করতেই ছুটে আসে ক্রিকেটের স্ট্যাম্পধারী আরেকটি গ্রুপ। তারাও কয়েক মিনিট ধরে শেয়াল কুকুরের মতো নির্মমভাবে পিটিয়ে সুমনের নীরব নিথর দেহটি রাস্তার ধারে লাথি মেরে ফেলে রেখে যায়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ সময় কাউন্সিলর প্রার্থী মোহাম্মদ হোসেন খোকন নিজেও জাফরাবাদ কেন্দ্রেই উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিকের উপর হামলা চালানো লাগেজ বহনকারী দুর্বৃত্তরা কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকেই তাকে বিস্তারিত জানায় এবং তিনি দ্রুতগতিতে পরিস্থিতি ধামাচাপা দেয়ার উদ্যোগ নেন। ফলে কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পর্যন্ত ঘটনাস্থলের দিকে আর এগিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি-তারা ব্যস্ত ছিলেন মোহাম্মদ হোসেন খোকনের ব্রিফিং শোনার কাজে।

গুরুতর আহত সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান সুমন এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) ও ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। তাকে হত্যা চেষ্টার ঘটনার প্রতিবাদে সাংবাদিকরা প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ নানা আন্দোলন কর্মসূচি শুরু করলেও পুলিশ এখন পর্যন্ত হামলাকারী দুর্বৃত্তদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি।