গোলাম সারওয়ার ও অন্যান্য সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা, নির্যাতন বন্ধে কী ব্যবস্থা?

গোলাম সারওয়ার ও অন্যান্য সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা, নির্যাতন বন্ধে কী ব্যবস্থা?

তিনদিন নিখোঁজ থাকার পর চট্টগ্রামের একজন সাংবাদিক এমন সময়ে উদ্ধার পেলেন, যখন পরদিনই সোমবার জাতিসংঘ পালন করছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের দায়মুক্তি অবসানে একটি দিবস।

গোলাম সারওয়ারকে যখন সীতাকুণ্ডের একটি সেতুর নিচ থেকে অর্ধচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, তখন তিনি অসংলগ্নভাবে বলছিলেন, "আমারে মাইরেন না, আমি আর নিউজ করব না"।

আজকের সূর্যোদয় নামে একটি পত্রিকার চট্টগ্রাম ব্যুরোর নিজস্ব প্রতিবেদক গোলাম সারওয়ারকে কারা অপহরণ করে নিয়ে আটকে রেখেছিল সেটা এখনো পরিস্কার নয়।

তবে এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মি. সারওয়ার নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সেটা স্পষ্ট। আর কেন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সেটা তার ওই অসংলগ্ন কথাবার্তা থেকে ধারণা পাওয়া যায়।

তার এই বক্তব্য সম্বলিত ভিডিও এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। অনেকেই ফেসবুকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন।

মাত্রই ঘটে যাওয়া এই ঘটনা নিয়ে, গোলাম সারওয়ারের তরফে বা অন্য কোন তরফে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আসেনি থানায়। ফলে তিনি বিচার পাবেন কি না, সেটা বলার সময়ও আসেনি এখনো।

তবে এর আগে সংবাদ প্রকাশের জেরে নির্যাতনের শিকার হওয়া বহু সাংবিদক বিচার পাননি। কেউ কেউ বিচার হবে না এমন ধারণার বশবর্তী হয়ে বিচার চাইতেই যাননি।

অবশ্য সরকার এখন বলছে সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে 'গণমাধ্যম কর্মী আইন' নামে একটি আইন পাশের জন্য কাজ চলছে এখন।

সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে চলুন জেনে আসি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে হামলার শিকার হওয়া আরো কিছু সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা:

সাংবাদিক নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনা
নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া একটি জাতীয় দৈনিকের একজন প্রতিবেদক নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্যাতনের মুখে পড়েছিলেন তিনি। তিনি বলছিলেন, সাংবাদিক পরিচয় দেয়ার পরও তাকে মারধর করেছিল হামলাকারীরা।

"আমি যতবারই বলছিলাম আমি সাংবাদিক, আমাকে মেরো না। ওরা বলছিল, মার শালারে।"

ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৮ সালের ৫ই অগাস্ট। সেই থেকে, 'মব' দেখলে ভয় পান তিনি।

"এক সাথে ১০-১২ জন মানুষ দেখলেই মনে হয় যে আমাকে মারতে আসছে।"

হামলাকারীদের সবার মাথায় ছিল হেলমেট। হাতে লাঠি, রড আর কিরিচ। ওইদিনএই হামলায় আক্রান্ত হয়েছিলেন আরো অনেক সাংবাদিক। পরদিন পত্রিকায় ছাপা হওয়া এই হামলার ছবি ভাইরাল হয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে।

একই হামলার শিকার হওয়া ফটো সাংবাদিক সাজিদ হোসেন বিবিসিকে বলেন, "আমি দৌড় দিয়ে পালিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম যে ওরা আমাকে তেমন মারতে পারেনি। কিন্তু ২০ থেকে ৩০ কদম দৌড়ে গিয়ে থেমে যাওয়ার পর দেখলাম পিঠ আর পায়ে মারের দাগ ফুলে উঠেছে।"

এই ঘটনাটি দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এ নিয়ে কোন মামলা হয়নি, কারণ হিসেবে নির্যাতনের শিকারদের কেউ কেউ বলছিলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা থেকে তারা মামলা করতে যাওয়ার আগ্রহই পাননি।

ঝিনাইদহের স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক ও যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান নির্যাতনের শিকার হন ২০০৮ সালে। ২০০৮ সালে তাকে ও তার সহকর্মী ক্যামেরাপার্সনকে মারধর করা হয়েছিল এবং ক্যামেরা ভাংচুর করা হয়েছিল। হামলার কারণ, জাতীয় নির্বাচনে জয়ী দলের সমর্থকেরা পরাজিত দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ভাংচুর করার সময় সেই ঘটনার কিছু ভিডিও ধারণ করে ফেলেছিলেন তারা।

মি. রহমানও জানান, তিনি মামলা করতে যাননি অতীতে বিচার না পাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে।

একই জেলার আরেক টেলিভিশন সাংবাদিক আব্দুর রহমান মিল্টনের উপর হামলা হয় ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগ মুহূর্তে।

তাকে আগে থেকেই সতর্ক করা হচ্ছিল সংবাদ সংগ্রহের ব্যাপারে।

হামলার শিকার হওয়ার পর মামলা করতে গেলে প্রথমে মামলা নিতেই অস্বীকৃতি জানায় পুলিশ। পরে স্থানীয় সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি জানানোর পর অবশ্য মামলা নেয়া হয়। কিন্তু এখনো তার বিচার হয়নি।

বিচার হয় না সাংবাদিক হত্যার
সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা সংস্থা 'দ্য কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্ট' বা সিপিজের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত আটাশ বছরে ২২ জন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে।

আর এই সময়ে বিশ্ব জুড়ে ১৩৮৭ জন সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

এ বছর সিপিজের প্রকাশ করা ইমপুনিটি ইনডেক্স বা দায়মুক্তি সূচকে বারোটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দশম।

সাংবাদিক হত্যার বিচার না হওয়ার ইস্যু নিয়ে তৈরি এই ইনডেক্স।

এই তালিকায় থাকা অন্য দেশগুলো হচ্ছে: সোমালিয়া, সিরিয়া, ইরাক. দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্তান, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স, ব্রাজিল, পাকিস্তান, রাশিয়া এবং ভারত।

সিপিজে বলছে, দুর্নীতি, দুর্বল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, তদন্তে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব থাকার কারণে সাংবাদিক হত্যার বিচার হয় না এবং হত্যাকারীরা দায়মুক্তি পায়। এছাড়া আইনি বাধাও সাংবাদিক হত্যার বিচারে ভূমিকা রাখে বলে সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়।

ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিচার ব্যবস্থা এতো বেশি জটিল এবং দীর্ঘ মেয়াদি যে, সাংবাদিক নয় বরং কোন হত্যাকাণ্ডের বিচারই বলতে গেলে হয়না।

বাংলাদেশে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত যেসব হত্যাকাণ্ড হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি মাত্র হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হয়েছে।

ফরিদপুরের সাংবাদিক গৌতম দাশ হত্যার বিচার হয়েছে। কিন্তু সাংবাদিক মানিক সাহা হত্যার বিচার হলেও তার পরিবার সেটি মেনে নেয়নি।

এছাড়া সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ঘটনার উল্লেখ করে ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে এ পর্যন্ত ৭৬ বার তারিখ পড়লেও এখনো প্রতিবেদন জমা হয়নি।

একতার অভাব:
ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, সাংবাদিকরা এখনো নানা ধরণের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত। তাদের মধ্যে একতা নেই। বরং বিভাজন আছে।

তিনি মনে করেন, বিভাজন বাদ দিয়ে তাদের দাবি পূরণের ক্ষেত্রে, বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে, বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এবিষয়ে তাদের সচেতন হওয়া উচিত বলে তিনি জানান।

তবে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কিছুটা দায়বদ্ধতা রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

সাংবাদিক সুরক্ষা আইন
তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোঃ মুরাদ হাসান বলেন, দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শুধু সাংবাদিক নয় বরং প্রতিটি মানুষের সুরক্ষার নিশ্চিত করা হয়।

"কোন মানুষের প্রতি অবিচার, অনাচার, নির্যাতন করলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।"

তবে সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং দাবি পূরণের লক্ষ্যে গণমাধ্যম কর্মী আইন নামে একটি আইন পাস হতে যাচ্ছে বলে জানান তথ্য প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আইনটি বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ের রয়েছে। শেষ ধাপের কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

তথ্য মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় এটি নিয়ে কাজ করছে, জানান তথ্য প্রতিমন্ত্রী। সূত্র : বিবিসি