ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা

কিশোর আর কাজল এখনো মুক্তির অপেক্ষায়

কিশোর আর কাজল এখনো মুক্তির অপেক্ষায়

গত মে মাসে গ্রেপ্তার হওয়া কার্টুনিষ্ট কিশোরকে মানবিক কারণে মুক্তি দেয়ার আহবান জানিয়েছে জাতিসংঘ। কিশোর এখনো কারাগারে৷ সাংবাদিক কাজল সব মামলায় জামিন পেলেও এখনো মুক্তি পাননি।

গত ৫ মে রাতে কার্টুনিষ্ট আহমেদ কবির কিশোর এবং লেখক মুশতাক আহমেদসহ তিনজনকে আটক করে র‌্যাব। তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা হয়। মামলায় আসামি করা হয় ১১ জনকে। আটক কেউই এখনো মুক্তি পাননি। তাদের বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী প্রচার এবং শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যাপারে অবমাননাকর কাজেরও অভিযোগ আনা হয়েছে। আর এইসব অভিযোগের ভিত্তি হিসেবে "লাইফ ইন দ্য টাইম অব করোনা” শিরোনামে কিশোরের একটি সিরিজ কার্টুনকে মামলায় যুক্ত করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে করোনা চিকিৎসা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারেরও অভিযোগ আনা হয়েছে।

কিশোরের ভাই আহসান কবির বলেন , "তার জামিনের জন্য আমরা উচ্চ আদালত পর্যন্ত গিয়েছি, কিন্তু জামিন হয়নি। এ পর্যন্ত ছয়বার পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন দিতে সময় নিলেও প্রতিবেদন দেয়নি।” আর মামলার সাথে যে কার্টুন আলামত হিসবে জমা দেয়া হয়েছে তা-ও কিশোরের আঁকা নয়।'' কার্টুনটা কার আঁকা তা যাচাই করে দেখতে আদালত সময় নিচ্ছে বলে জানান তিনি।

তিনি জানান, কিশোর এখন কাশিমপুর কারা হাসপাতালে আছেন। উচ্চ ডায়াবেটিসে ভুগছেন। তিনি এক কানে শুনতে পান না। চোখে কম দেখেন, চশমা দেয়া হয়েছে। আহসান কবির বলেন, " আমার ভাই কোনো অপরাধ করেননি। আমরা তার মুক্তি চাই।”

জতিসংঘ বিষেশজ্ঞরা বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘রাজনৈতিক বিদ্রূপ বা কার্টুনের মাধ্যমে সরকারের নীতির সমালোচনা করা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক অধিকারের আওতায় অনুমোদিত। এ ধরনের কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা উচিত নয়।''

তারা উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, "প্রচলিত আইনের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অসঙ্গতি রয়েছে এবং এটি ব্যবহার করে কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে।”

এদিকে ফটো সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজল সব মামলায় জামিন পেয়েছেন। বৃহস্পতিবার তাকে সর্বশেষ দুই মামলায় জামিন দেয় হাইকোর্ট। এর আগে ২৪ নভেম্বর তিনি আরেকটি মামলায় জামিন পান। তার বিরুদ্ধে এই তিনটি মামলাই ডিজিটাল আইনে একই ঘটনায় করা হয়েছে।

গত ১১ মার্চ ঢাকার চকবাজার এলাকা থেকে নিখোঁজ হন কাজল। নিখোঁজ হওয়ার একদিন আগে ১০ মার্চ ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় কাজলসহ ৩২ জনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে মামলা করেন সরকার দলীয় সংসদ সদস্য সাইফুজ্জামান শিখর। কামরাঙ্গীরচর ও হাজারীবাগ থানায়ও কাজলের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যের পক্ষেই মামলা করা হয়। কাজলের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ওই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার করেছেন। নিখোঁজ হওয়ার ৫৩ দিন পর বেনাপোল সীমান্ত থেকে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে কারাগারে পাঠায়। ৩ মে থেকে তিনি কারাগারে আছেন।

কাজলের ছেলে মনোরম পলক জানান," তিনি কেরানীগঞ্জে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন। সব মামলায় জামিন পাওয়ার পরও বৃহস্পতিবার তিনি ছাড়া পাননি। কারা কর্তৃপক্ষ বলেছে তারা জামিন আদেশের কাগজ পাননি।” যদি আর কোনো ঝামেলা না হয়, সব কিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে রবি বা সোমবার কাজল ছাড়া পেতে পারেন বলে মনে করেন মনোরম পলক।

যুক্তরাজ্যের মানবাধিকার প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের (২০২০ সাল) প্রথম ছয় মাসে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকারের উদ্যোগের সমালোচনা করায় ৩৮ জন সাংবাদিক এবং স্বাস্থ্য খাতে জড়িত পেশাজীবীসহ চার শতাধিক ব্যক্তিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক করা হয়েছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সাবেক সাধারণ সম্পাদক, মানবাধিকার কর্মী নূর খান বলেন, এদেশে লুটেরা, কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজদের কোনো সমস্যা হয় না। দুই-একজন আটক হলেও তারা আবার ছাড়া পেয়ে যান। কিন্তু মুক্ত চিন্তা, স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করলে জেলে যেতে হয়। দিনের পর দিন কারাগারে থাকতে হয়। এটা দু:খজনক।”

বিশেষ করে এই করোনার সময় যারা চিকিৎসার অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনের অপপ্রয়োগ হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এই আইনের অপপ্রয়োগ থেকে সাংবাদিক, শিক্ষক, সমাজকর্মী, এমনকি নারী শিক্ষকও রেহাই পাননি বলেও উল্লেখ করেন নূর খান।

আর মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, "রাষ্ট্র অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে। সমালোচনা বা বিরোধী মত সহ্য করতে পারছে না। মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশের পথ সংকুচিত হয়ে গেছে। পরিস্থিতির কারণে সংবাদমাধ্যমসহ সব খানেই আমরা এক ধরনের স্ব-আরোপিত সেন্সরশিপও দেখতে পাচ্ছি।”

তিনি মনে করেন, " সরকার আমলানির্ভর এবং আমলা নিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়েছে। আর আমলারা মুক্ত চিন্তার বিরুদ্ধে কাজ করেন। সমালোচনাকে নিতে পারেন না। ফলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। মুক্তচিন্তা, স্বাধীন মত প্রকাশ হুমকির মুখে পড়ে গেছে।”