যুক্তরাষ্ট্রে যা সাংবাদিকতা বাংলাদেশে তা ক্রাইম: ফরেন প্রেসকে মুশফিকুল ফজল আনসারী

যুক্তরাষ্ট্রে যা সাংবাদিকতা বাংলাদেশে তা ক্রাইম: ফরেন প্রেসকে মুশফিকুল ফজল আনসারী

মুক্ত সাংবাদিকতার জন্যই ৫ বছর ধরে নির্বাসিত জীবন যাপন করতে হচ্ছে সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীকে। বাংলাদেশে মানবাধিকারের চরম লংঘন ও গণতন্ত্র হরণের চিত্র বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে তুলে ধরে হয়েছেন আলোচিত। পড়তে হয়েছে ক্ষমতাসীনদের রোষানলে। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে তার প্রকাশিত অনলাইন সংবাদ মাধ্যম জাস্ট নিউজ বিডি। তবে মুক্ত সাংবাদিকতাকে ব্রত হিসাবে নেয়া এই সাংবাদিক মোটেও দমে যাননি। বরং পেশাদারিত্বের ছাপ রেখেছেন বিশ্বমঞ্চে। জাতিসংঘ, হোয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এমনকি পেন্টাগনেও বাংলাদেশের সৎ ও সাহসি সাংবাদিকতাকে করেছেন সমুজ্জ্বল।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক খ্যাতনামা মিডিয়া আউটলেট 'ফরেন প্রেস' বাংলাদেশী সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারীর সাক্ষাতকারভিত্তিক একটি প্রতিবেদেন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ছাড়াও এতে উঠে এসেছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, চ্যালেঞ্জ এবং হুমকিসহ নানান দিক।

জাস্ট নিউজ পাঠকদের জন্য সাগর রায়হানের করা প্রতিবেদনটির বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হল:

বাংলাদেশি সাংবাদিক এবং জাস্ট নিউজ বিডি সম্পাদক মুশফিকুল ফজল দায়িত্ব পালন করছেন হোয়াইট হাউস করসপন্ডেন্ট হিসেবে। একিসঙ্গে জাতিসংঘ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং পেন্টাগনের সংবাদ কভারেও রয়েছে তার পেশাদারিত্বের ছাপ। তিনি সদ্য চালু হওয়া নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক টিভি নেটওয়ার্ক 'নিউজ কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক' এর প্রধান সম্পাদক।

মুশফিকের প্রতিবেদনে মূলত প্রাধান্য পায় যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ এশিয়ায় দেশটির প্রভাব এবং বিশেষত বাংলাদেশ প্রসঙ্গ।গণমাধ্যমের স্বাধীনতার স্বপক্ষে মুশফিক এক সোচ্চার কণ্ঠ। ওয়াশিংটন ভিত্তিক অলাভজনক অধিকার সংস্থা 'রাইট টু ফ্রিডম' এর অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।

সাংবাদিকতার জন্যই নির্বাসিত হতে হয়েছে মুশফিককে। বৃটেনে রাজনৈতিক আশ্রয়ও ছিলেন তিনি। সেসময়ে ওয়ার্ক এক্সপিরিয়েন্স রিপোর্টার হিসাবে কাজ করছেন দ্য টাইমস ও সানডে টাইমস পত্রিকায়।

চরমভাবে মানবাধিকার লংঘন ইস্যুতে জাতিসংঘের নিয়মিত ব্রিফ্রিংয়ে বিভিন্ন সময় প্রশ্ন করা এবং তা নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করার কারণে সরকারের রোষানলে পড়তে হয় সাংবাদিক মুশফিককে। বন্ধ হয়ে যায় তার দেশে ফিরায় ফেরা এবং ঢাকা থেকে প্রকাশিত নিউজ পোর্টালটি বন্ধ করে দেয় সরকার।

মুশফিক একাধারে 'ইউনাইটেড নেশনস করসপন্ডেন্ট এসোসিয়েশন, ওয়াশিংটন ন্যাশনাল প্রেসক্লাব এবং বাংলাদেশ প্রেস ক্লাবের সদস্য।

ফরেন প্রেস: টুইটার আপনার সরব উপস্থিতি দেখা যায়। একজন সাংবাদিক হিসেবে সোশ্যাল মিডিয়ার আগের যুগ এবং পরের যুগের তফাতটা কীভাবে দেখেন?

মুশফিক: এ পরিবর্তনটা আসলে উপভোগ করার মতোই একটা কিছু। যখন আমি বাংলাদেশের প্রাচীনতম একটি দৈনিক পত্রিকার কূটনৈতিক প্রতিবেদক ছিলাম, তখন আমি পাঠকদের কাছ থেকে মাঝে মাঝে ফোন কল পেতাম। কখনও কখনও আমার পাঠকরা ঘটনা সম্পর্কে আরও জানতে চাইতেন কিংবা বিশেষ ঘটনাগুলো নিয়ে প্রতিবেদন করার অনুরোধ করতেন। অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে, আমি আমার পাঠক এবং সমালোচকদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত আদান প্রদানের সুযোগ পেতাম। সোশ্যাল মিডিয়া যখন আমাদের ডেস্কটপে এবং পরে সেলফোনে এসে যুক্ত হল, তখন দৃশ্যপটটা সম্পূর্ণ বদলে গেল। পাঠকদের সাথে আমার মতবিনিময়ের বিষয়টা একটা নতুন মাত্রা পায় তখন।

এ জায়গায় কিছুটা অস্পষ্টতা এবং বিশৃঙ্খলা থাকলেও এটি আমার এবং পাঠকদের মধ্যে সত্যিকারের সেতুবন্ধন তৈরি করেছে। পাঠকরা আমাকে সোশ্যাল মিডিয়া সচেতন হতে সাহায্য করেছে কারণ ফেসবুক এবং টুইটারে আমার অনেক ফলোয়ার রয়েছে।

ফরেন প্রেস: সংবাদ উৎসগুলোর বৈচিত্র্যময়তার তালিকা আজকাল ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। আপনি পাঠকদের কীভাবে খবরের মধ্যে বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি পেতে পরামর্শ দিবেন?

মুশফিক: অসংখ্য উৎস থেকে যে দৃষ্টিভঙ্গিগুলি পাঠকরা পাচ্ছে আমি তাদেরকে সেক্ষেত্রে সমালোচকের দৃষ্টি উন্মুক্ত রাখতে বলব। একজন পাঠক হিসাবে আমি দুটি দৃশ্যপট সামনে রাখতে চাই।

প্রথমত, আমি কিছু সুনির্দিষ্ট তথ্যের সন্ধান করতে পারি এবং আমি মনে করি পাঠকরা বিশ্বাসযোগ্য উৎসগুলো উপর নির্ভর করতে পারেন যা তারা নিয়মিত অনুসরণ করেন।

দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে, আমি পাঠকদের অনুরোধ করব অন্যান্য উৎসের দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে দেখার জন্য যা তারা নিয়মিত তদন্ত করে দেখেননা। গুরুত্বপূর্ণ কোন উপলক্ষ্যে, পাঠকদের সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে একাধিক সূত্র পরীক্ষা করা উচিত।

ফরেন প্রেস: একজন সাংবাদিক হিসাবে বাংলাদেশে ও যুক্তরাষ্ট্রে সাংবাদিকতার মূল পার্থক্যগুলো কি কি?

মুশফিক: বাংলাদেশে গণমাধ্যমের প্রাণবন্ত বিকাশ শুরু হয়েছে চলতি সহস্রাব্দের গোড়া থেকে। সেনাবাহিনী দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয়ার আগ মিডিয়া মিডিয়া সরকারকে জবাবদিহিতার আওতায় রাখতে খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল। আগাগোড়াই সরকারের সরকারের সমালোচনা করার সুযোগ ছিল। একদশক আগে যখন থেকে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী দেশ চালানো শুরু করল তখন থেকে মিডিয়া গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে শুরু করে। আমার মনে পড়ে আমার সহকর্মী সাংবাদিক-দম্পতি সাগর সারোয়ার এবং মেহেরুন রুনিকে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোর রাতে নিজেদের বাসাতে নির্মমভাবে খুন করা হয়। নয় বছর পেরুলেও এখনো বিচার নিশ্চিত করা যায়নি। আমি তাদের ব্যক্তিগতভাবে চিনি।

অনেক সাংবাদিক শুধু মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য হয় কারাগারে নতুবা অন্য দেশে নির্বাসিত জীবন যাপন করছে।মুক্তগণমাধ্যম ইনডেক্সের সাম্প্রতিক সূচক অনুসারে বাংলাদেশ এখন একটি নতুন ধরনের ফ্যাসিবাদী সরকার দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। দেশটির অবস্থান যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের পিছনে। সূচক অনুসারে দেশটির অবস্থান এখন ১৫২।

যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে আমি একটা কথা বলতে পারি।আর তা হল আমি এখানে সাংবাদিকতার প্রকৃত স্বাধীনতা উপভোগ করি। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্ট হাউসে চলে যেতে পারি এবং তাকে ভয়হীনভাবে প্রশ্ন করতে পারি। এর বিপরীতে যদি বাংলাদেশের কথা বলি তবে বলতে হয় সেখানে হয় আমাকে জেলে রাখা হবে অথবা রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো আমাকে চিরতরে গুম করে দেবে।

ফরেন প্রেস: কাজের ক্ষেত্রে যে কাজে প্রচুর সময়ের লাগে এবং চূড়ান্ত সময়সীমা বেধে দেয়া হয় সেক্ষেত্রে চাপের বিষয়টি কীভাবে সামাল দেন?

মুশফিক: কখনও কখনও বিষয়টি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। আমার পাঠকদের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন টাইমজোন। যদি আমি দেরিতে খবর ছাপাই দেখা যাবে সে মুহূর্তে অন্যরা সম্ভবত ভুল তথ্য দিয়ে বসে আছে। সুতরাং, নির্ধারিত সময়সীমার উপরে একটু বেশী চাপ থাকে। সাংবাদিকতার যে আবেগ সেটা অটুট রেখে অতিরিক্ত কাজ করে হলেও যেনো সময় মতো কাজ শেষ করা যায়।

ফরেন প্রেস: আপনি কি যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত বিদেশী সংবাদদাতাদের সামাজিক সংস্কৃতি সম্পর্কে একটু বলবেন? এটা কি সহায়ক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ? নাকি খুবই প্রতিযোগিতামূলক?

মুশফিক: বিদেশী প্রেস কর্পসে আমরা বিভিন্ন স্থান, জাতি এবং অবস্থান থেকে এসে একত্রিত হয়েছি। বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিষয়টিও ভিন্ন রকমের। আমাদের কাজ বন্ধুত্বের পরিবেশ তৈরি করে দেয়। কখনও কখনও তা একে অপরের উপর নির্ভরশীল করে তুলে। যদি আমি কোন তথ্য সংগ্রহ করতে না পারি তখন অন্য সহকর্মী আমাকে তা দিয়ে সহযােগিতা করেন।এটা সত্য যে আমরা সবাই সেরা তখ্যটা পেতে লড়াই করি, নিজের প্রশ্নের উত্তর পেতে চাই বা বিশেষ প্রতিবেদনের করার চেষ্টা করি। আমরা সবাই এখানে সাংবাদিকতা চর্চার স্বাধীনতা উপভোগ করি। আমাদের সহকর্মীরা একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

ফরেন প্রেস: দেশের প্রতি যেসকল বিদেশী সংবাদদাতাদের নাড়ির টান তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়- সে বিষয়ে আপনার কি পরামর্শ?

মুশফিক: মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য যদি কারো দেশে যেতে কোনো ধরনের বাধা না থাকে তাহলে বলব বছরে একবার পরিবারকে সময় দিন। যদি দেশের কর্তৃপক্ষ আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে দেখা করার ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে দাড়ায় , যেমনটা আমার সাথে ঘটেছে, আমি মনে করি সেক্ষেত্রে সেরা কাজ হবে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়মিত সংযুক্ত থাকা। যাইহোক, এটা হয়তো খুব বেশী কষ্ট লাঘব করে দিবে তেমনটা না।

ফরেন প্রেস: এই মুহূর্তে মুক্ত সংবাদমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে আপনি কোন বিষয়টিকে দেখছেন?

মুশফিক: মুক্ত সংবাদমাধ্যমের ওপর ব্যাপক চাপ প্রয়োগের বিষয়টি হল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। রাষ্ট্রীয় কতৃপক্ষ চায়না জনগণ তথ্য জানুক এবং অবাধে কাজ করতে দিতেও চায় না। তার উপরে, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলি ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াতে ব্যস্ত থাকে। ভুল তথ্যের ব্যাপক প্রচার একটি মারাত্মক হুমকি।

ফরেন প্রেস: কোন্ কাজটির মাধ্যমে একজন মুক্ত সংবাদমাধ্যমকে সহযোগিতা করতেপারে?

মুশফিক: সংবাদের বিষয়বস্তুকে মূল্যবান বিষয় হিসাবে বিবেচনা করুন; আপনি হয়তো প্রতিদিন দেখছেননা না অথচ আপনার জীবনে এর একটি শক্তিশালী প্রভাব থাকতে পারে। সক্রিয় পাঠক হিসাবে সব সময় আপডেটেট থাকুন। গণতন্ত্রকে সচল রাখতে যেসকল প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করছে তাদের পাশে থাকুন, সমর্থন করুন।

কেবি/