বিবিসির প্রতিবেদন

মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দমনপীড়ন

মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দমনপীড়ন

‘চিড়িয়াখানার পশুর সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয়, আমার সঙ্গে তেমন আচরণ করা হতো। স্থায়ীভাবে আমার চোখ বেঁধে রাখা হতো। শুধু খাবার সময় পিছন দিকে বেঁধে রাখা হাতের বাঁধন খুলে দেয়া হতো’।

শফিকুল ইসলাম কাজল। পরিচিত কাজল নামে। তিনি বাংলাদেশি একজন সাংবাদিক। বলেছেন, তাকে ৫৩ দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে আটকে রাখা হয়েছিল। সেখানে তার ওপর নির্যাতন করা হয়েছিল। ‘জিজ্ঞাসাবাদে নেয়ার আগে তারা আমাকে মাঝে মাঝে প্রহার করতো। কি বেদনার ছিল সেই কষ্ট তা বর্ণনা করতে পারবো না। যেসব রিপোর্ট লিখেছি, সে সম্পর্কে তারা জানতে চাইতো।

প্রচুর নির্যাতনের মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাকে। এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এখনও সংগ্রাম করছি।’

কাজলের এই বর্ণনা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করতে সক্ষম নয় বিবিসি। তবে ওই ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনা তিনি এই প্রথম শেয়ার করলেন। অজ্ঞাত স্থান থেকে ৫৪ বছর বয়সী কাজল বললেন, দেশে কোনো মানবাধিকার নেই। অব্যাহত আতঙ্কের মধ্যে বসবাস করছি।

রাজধানী ঢাকায় বিরোধী দল বিএনপির সদস্যদের সঙ্গে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর যে সময়ে সংঘর্ষ হয়েছে, কাজল আমাদের সঙ্গে সেই সময়কে বেছে নেন কথা বলার জন্য। আজ ১০ই ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস। এদিন সরকারবিরোধী গণপ্রতিবাদ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে জনগণকে রাজপথে নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। তাদের প্রধান দাবি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন। জীবনমানের খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন।

এর প্রেক্ষপটে বিরোধী দলীয় কর্মকর্তাদের আটক করেছে পুলিশ। সমালোচকরা এ ঘটনাকে বলছেন, ভিন্নমতাবলম্বীদের ‘ক্রাশ’ বা চুরমার করে দেয়ার সরাসরি এক উদ্যোগ হিসেবে। তবে স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে দমনপীড়নের অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছে বাংলাদেশ সরকার।

বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেন বলেছেন, প্রতিবাদ বিক্ষোভকারীরা বেআইনিভাবে সমবেত হচ্ছেন। তার সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে গলাটিপে ধরেছে এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। জোর দিয়ে বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারকে সমুন্নত রাখতে।

২০২০ সালের মার্চে নিখোঁজ হন কাজল। তখন এ ইস্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংগঠন। এক বিবৃতিতে তারা বলে, শফিকুল ইসলাম কাজলের মতো অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের টার্গেট করায় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়ার প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতির বিষয়ে মারাত্মক প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।

যেদিন কাজল নিখোঁজ হন, তার আগের দিন তিনি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছিলেন। এতে তিনি যৌনতায় পাচার বিষয়ক একটি চক্রের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। এই চক্রে জড়িত রাজনীতিকরাও। তার আইনজীবী বলেন, এর পর পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একজন সদস্য ওই রিপোর্টের কারণে কাজল ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা করেন। পরের দিন স্কুল থেকে ছেলেকে বাসায় নামিয়ে দেয়ার পর তিনি মোটর সাইকেল নিয়ে অফিস ত্যাগ করেন। কাজল বলেন, এ সময় আট থেকে দশ জন মানুষের একটি গ্রæপ তাকে অনুসরণ করছিল। তাকে একটি মিনিভ্যানে ধাক্কা দিয়ে ঢোকানো হয়। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় আন্ডারগ্রাউন্ডের একটি সেলে। কাজল বলেন, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় একটি চেয়ারে শক্ত করে বাঁধা হতো। তার ভাষায়, ‘তারা আমার কাছে জানতে চায় কেন আমি ওই কেলেঙ্কারি নিয়ে রিপোর্ট লিখেছি। এই অবস্থা পাঁচ থেকে ছয় ঘন্টা চলতো একটানা। এটা ছিল এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’।

এক বিবৃতিতে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিবিসিকে বলেছেন, হয়রানির জন্য কিছু মেয়ের ছবি ধারণ করে তা এডিট করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেন কাজল। এজন্য তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ওইসব মেয়ে শফিকুল ইসলাম কাজলের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের কাছে অভিযোগ করেন। তারপর নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী কাজলকে গ্রেপ্তার করে এবং আইন অনুযায়ী আদালতে তোলে পরের দিন’। তবে কাজলকে কমপক্ষে ৫০ দিন আন্ডারগ্রাউন্ডে আটকে রাখার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশের ভিতরে গোপন বন্দিখানা বিদ্যমান থাকার তথ্যপ্রমাণের কথা শুনেছে তারা। একই সঙ্গে তারা এসব অভিযোগ তদন্তের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছে। সেখানে যাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে, তাদের মুক্তি দাবি করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক পরিচালক মিনাক্ষী গাঙ্গুলি বলেন, ‘আমরা শুনেছি এসব আন্ডারগ্রাউন্ডে প্রাকৃতিক আলো নেই বললেই চলে। কিছু মানুষ বলেছেন, তারা অন্যদের ওপর নির্যাতনের শব্দ শুনতে পেয়েছেন। এটা খুবই হতাশাজনক’। তবে সরকার এমন বন্দিশালার কথা প্রত্যাখ্যান করেছে।

কাজল বলেন, একই স্থানে তাকে অন্য দুটি সেলে স্থানাস্তর করা হয়। এবারেরটা আন্ডারগ্রাউন্ডে ছিল না। তাকে ভারতের কাছাকাছি একটি মাঠের ভিতর ফেলে দেয়া হয়। তখনও তার চোখ বাঁধা ছিল। হাত বাঁধা ছিল। সেখান থেকে তাকে তুলে নেয় সীমান্ত বিষয়ক কর্মকর্তারা। তারা তাকে জেলে পাঠায়। সেই জেলে তাকে আটকে রাখা হয় আরও ২৩৭দিন। ১৩ বার আপিল করার পর তিনি জামিনে মুক্তি পান ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। জেলে থাকা অবস্থায় কাজলের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে মানহানির মামলা করা হয়। সমালোচকরা বলেন, এটা হলো একটি বিতর্কিত আইন। এর মধ্য দিয়ে অনলাইনে ভিন্ন মত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশেষ করে ফেসবুকে কোনো পোস্ট শেয়ার করা, সমালোচনাকে এক্ষেত্রে বিবেচনা করা হয়। ২০১৮ সালে এই আইনটি হওয়ার পর হাজার হাজার মানুষকে এর অধীনে অভিযুক্ত করা হয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, কাজলের এই নির্মমতা হলো সরকারের একটি কৌশল, যা তারা সরকারের সমালোচনাকে স্তব্ধ করতে নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ব্যবহার করছে। বাংলাদেশি মানবাধিকার গ্রুপগুলোর মতে, ২০০৯ সাল থেকে নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা প্রায় ৬০০ মানুষকে গুম করেছে। ২০২২ সালের আগস্টে জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন ৭২ জন। তারা এখনও নিখোঁজ। তবে এসব সংখ্যাকে উড়িয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন। তিনি দাবি করেছেন, জাতিসংঘ এসব তথ্য সংগ্রহ করেছে এমন কোনো মহল থেকে, যারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তিনি স্থানীয় গ্রুপগুলোকে অভিযুক্ত করেছেন, যারা এসব সংখ্যাকে ‘বাড়িয়ে বলছে’ এবং ‘তথ্য বিক্রীত করছে’।

কিন্তু যেসব পরিবার তাদের নিখোঁজ সদস্যদের জন্য এখনও অপেক্ষায় আছেন, তারা বলছেন, এসব তথ্য একেবারেই বাস্তব। বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের একজন সংগঠক সাজিদুল ইসলাম সুমন। তাকে সর্বশেষ ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে দেখা গেছে। তারপর তাকে আর দেখা যায়নি। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের অল্প কয়েক সপ্তাহ আগে ক্ষমতাসীন সরকার থেকে ভীতি প্রদর্শনের আতঙ্কে ছিলেন তিনি। ফলে তিনি অস্থায়ীভিত্তিতে পরিবারের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে দূরে সরে থাকতেন। পরিবারের সদস্যরা একদিন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থকে জানতে পারেন, সাজিদুলকে ঘেরাও করে ধরা হয়েছে, হান্ডকাফ পরানো হয়েছে, চোখ বেঁধে ফেলা হয়েছে। এটা করেছে র‌্যাব। এরপর তারা তাকে একটি বাসে জোর করে উঠিয়ে নেয়। সাজিদুলের বোন সানজিদা তাকে মাত্র কয়েকদিন আগে দেখেছেন। তখন পরিবারের সদস্যদের, বিশেষ করে তার এক বছর বয়সী মেয়ে আরওয়াকে দেখতে তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন।

ভাইয়ের সঙ্গে শেষ আলিঙ্গনের কথা স্মরণ করে সানজিদা বলেন, ‘সেটা ছিল ডিসেম্বর মাস। বেশ ঠাণ্ডা ছিল। তাই বাইরে পরার জন্য তাকে একটি হালকা নীল হুডি দেয়া হয়। সেটাই শেষ জিনিস আমি তাকে দিয়েছি। জানি না সে তা পরতে পেরেছে কিনা’।

সেই আরওয়ার বয়স এখন ১০ বছর। প্রতিক্ষণ তার পিতার ছবি সানজিদাকে দেখায় সে। কাচের ফ্রেমের ওপর পিতার ছবিতে চুমু খায়। জানতে চায়, তার পিতা কবে ফিরবেন। সানজিদা এখন মায়ের ডাক নামে একটি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন। এটি হলো ভাই, স্বামী, ছেলে, পিতাকে জোর করে গুম করে দেয়া মানুষদের সংগঠন। অনেক পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়েছেন। ব্যক্তিগত বেদনার সঙ্গে তারা দারিদ্র্যতার সঙ্গে লড়াই করছেন।

সানজিদা সহ অন্যরা বলেন, তারা সপ্তাহান্তে ঢাকার রাজপথে সরকার বিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেবেন। কারণ, তারা ন্যায়বিচার চাইছেন। সানজিদা ও অন্যদের আত্মীয়স্বজন বলছেন, পুলিশ স্টেশনে তাদের প্রিয়জন নিখোঁজের মামলা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনী জড়িত থাকার অভিযোগ বাদ না দেয়ায় তারা অভিযোগ ফিরিয়ে দিয়েছে।

তার মা’র বয়স এখন সত্তরের কোটায়। তিনি অসুস্থ। তিনি এখনও তার সন্তান নিখোঁজের বিষয়ে মামলা করতে প্রতি সপ্তাহে পুলিশ স্টেশনে যান।

তা সত্ত্বেও পরিবরটি আশা ছেড়ে দিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। বলেন, তার কি হয়েছে তা না জানা পর্যন্ত আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না, তিনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন’।

(লেখক বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক করেসপন্ডেন্ট। অনলাইন বিবিসি থেকে অনুবাদ)