পেশাগত নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশের সাংবাদিকরা

পেশাগত নিরাপত্তাহীনতায় বাংলাদেশের সাংবাদিকরা

ঢাকা, ১৪ আগস্ট (জাস্ট নিউজ) : পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা যেন বেড়েই চলেছে বাংলাদেশে৷ আর সে কারণে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকরা ভুগছেন নিরাপত্তাহীনতায়৷

সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে হওয়া ছাত্র আন্দোলনের সময় সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা বাংলাদেশে সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি আবারো আলোচনায় টেবিলে নিয়ে এসেছে৷

সপ্তাহব্যাপী চলা এ ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ৪০ জনেরও অধিক সংবাদকর্মী আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বাকস্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা ইউকে ভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘আর্টিকেল ১৯'৷ সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, আহত ৪০ জন সংবাদকর্মীর মধ্যে ২২ জন ফটো সাংবাদিক ও চারজন নারী সাংবাদিক আছেন৷

ছাত্র আন্দোলনের সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে আহত হওয়া দ্য ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিক সুস্মিতা পৃথা ‘আর্টিকেল ১৯'-কে জানান, তিনি ফুটওভার ব্রিজ থেকে একটি মিছিলের ছবি তুলতে গেলে মিছিলে আংশগ্রহণকারীদের কয়েকজন অস্ত্র হাতে তাকে ধাওয়া করে৷ শুধু তা-ই নয়, তারা তাকে আটকে রেখে মিছিলের ছবিগুলো মুছে ফেলতে বাধ্য করে৷ অস্ত্রধারীরা এ সময় তাকে অশ্লীল ভাষায় গালমন্দ করাসহ শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করে বলেও জানান পৃথা৷

গত মার্চ মাসে বরিশালের পুরাতন বিউটি হলের সামনে ডিবি পুলিশের এক অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন স্থানীয় সাংবাদিক সুমন হাসান৷ অভিযানের বিষয়ে পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে বাকবিতণ্ডা হয়৷ এক পর্যায়ে পুলিশ তাকে নির্যাতন করা শুরু করে৷ বেধড়ক মারধরের পর তার অণ্ডকোষ চেপে ধরা হয়৷ তখন তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন৷ পরে ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়ার পর জ্ঞান ফিরে এলে আবারো নির্যাতন করা হয় তাকে৷

এর আগে সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে স্থানীয় সাংবাদিক আব্দুল হাকিম শিমুল ছবি তোলার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান৷

গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আরো হুমকির মুখে পড়েছে এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনভাবে কাজ করার পথ ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে৷ রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর ২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে বালাদেশের অবস্থান ১৪৬তম৷ প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবস্থান ১৩৮তম ও নেপালেন অবস্থান ১০৬তম৷ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার অবস্থান যথাক্রমে ১৩৯ ও ১৩১তম৷ অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নীচে রয়েছে বাংলাদেশ৷ সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ ধীরে ধীরে কমে আসছে৷ গণমাধ্যম নিয়ে কাজ করা প্যারিসভিত্তিক এ সংস্থাটি বলছে, ২০১২ সালে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থান ছিল ১২৯৷ পরে ২০১৩ সালে দেশটির অবস্থান নেমে দাঁড়ায় ১৪৪তম অবস্থানে৷ আর ২০১৫ ও ২০১৬ সালে দেশটির অবস্থান ছিল যথাক্রমে ১৪৬ ও ১৪৪তম৷ একই কথা বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ফ্রিডম হাউস৷ সংস্থাটির ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিতে বর্তমানে বাংলাদেশের গণমাধ্যম ‘আংশিক স্বাধীনতা' ভোগ করছে বলে জানানো হয়৷

জনগণের জন্য নিয়োজিত এই পেশাজীবীদের উপর কেন হামলা হয় এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘সাপ্তাহিক'-এর সম্পাদক গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘‘বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলা নতুন কোনো ঘটনা নয়৷’’ তার কথায়, ‘‘সরকার কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা, জনগণের কোনো দাবি-দাওয়া বা সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গড়ে ওঠা আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে নয়, বরং পুলিশ ও দলীয় কর্মীদের দ্বারা দমন-পীড়নের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে চায়৷ পেশাগতভাবেই সাংবাদিকরা এসব দমন-নিপীড়নের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরেন৷ সরকার যা চাপা দিতে চায়, সাংবাদিকরা তা প্রকাশ করে দেন৷ এতে ক্ষিপ্ত হয় সরকার৷” সাংবাদিকদের এ পেশাগত আচরণের কারণেই পুলিশ কিংবা দলীয় কর্মীরা সাংবাদিকদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের উপর হামলা চালায় বলে মন্তব্য করেন গোলাম মোর্তোজা৷

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারি অধ্যাপক খ. আলী আর রাজী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অপকর্ম যেন কখনো প্রকাশিত না হয় সে পথটি নিশ্চিত করতেই সাংবাদিকদের উপর হামলা হয়৷ বাংলাদেশে সাংবাদিকদের উপর হামলার ইতিহাস নতুন নয়৷ এক্ষেত্রে নতুন বিষয়টি হলো যে, সাংবাদিকদের উপর হামলার ঘটনা বাড়ছে৷” কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে সাংবাদিকতার নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো নাগরিক সাংবাদিকতা৷ সাংবাদিকতার বহুমুখী এ বিস্তারের ফলে সাংবাদিকরা রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের ক্ষমতার অপব্যবহারকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে আগের চেয়ে অনেক বেশি৷ ফলে সাংবাদিকদের উপর হামলার সংখ্যাও বাড়ছে৷” তিনি বলেন, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকের কাজ হলো ক্ষমতার অপব্যবহারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা৷ কিন্তু যখনই এ কাজটি তাঁরা করতে চাইছেন, তখনই আক্রান্ত হচ্ছেন৷

সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা যখন হুমকির মুখে পড়ে, তখন মূলত তথ্যের অবাধ প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়৷ তাদের পেশাগত নিরাপত্তার বিষয়টি তাই সারা বিশ্বেই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়৷ বাংলাদেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে – এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম মোর্তোজা বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি মূলত রাষ্ট্রের চলমান রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত৷ একটি সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়েই সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি৷

তবে আইনগত নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি বাংলাদেশে সাংবাদিকতা চর্চায়ও পরিবর্তন আনা জরুরি বলে মনে করেন আর রাজী৷ তিনি বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের শক্তি অর্জন করতে হবে জনগণের কাছ থেকে৷ বাংলাদেশের সাংবাদিকতা অনেকটাই রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর হাতে বন্দি হয়ে গেছে, জনগণের সাথে তাদের সম্পৃক্ততা ধীরে ধীরে কমে আসছে৷ সাংবাদিকতা যদি সাধারণ মানুষের নিবর্তনের চিত্র তুলে ধরতে না পারে, তাহলে জনগণ তাদের কথা বলবে না৷ পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা তখন দূর্বল হয়ে পড়বে, হুমকির মুখে পড়বে এ পেশাটি৷ সূত্র: ডয়চে ভেলে।

(জাস্ট নিউজ/একে/২০৫৭ঘ.)