হিউম্যান রাইটস ওয়াচের বিবৃতি

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সমলোচকদের কণ্ঠরোধ করবে

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সমলোচকদের কণ্ঠরোধ করবে

ঢাকা, ২৫ সেপ্টেম্বর (জাস্ট নিউজ) : বাংলাদেশে নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কণ্ঠরোধ করবে সমালোচকদের। এমন মন্তব্য করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একটি বিবৃতি দিয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, দেশের সাংবাদিকদের জোরালো বিরোধিতা সত্ত্বেও গত সপ্তাহে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ পাস করেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। দেশে মুক্ত মত প্রকাশের ওপর এটি একটি বড় আঘাত।

ব্যাপক সমালোচিত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) পরিবর্তে সেখানে বসানো হয়েছে এই আইন। এতে রয়েছে আগের ওই আইনের সবচেয়ে সমস্যাযুক্ত বেশির ভাগ বিধান এবং এতে রয়েছে শান্তিপূর্ণ মত প্রকাশকে ক্রিমিনালাইজ করার অধিক পরিমাণে বিধান।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস বলেছেন, নতুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হলো নির্যাতনের একটি অস্ত্র এবং বাংলাদেশ মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক যেসব আইন মানতে বাধ্য তার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এতে কমপক্ষে ৫টি বিধান আছে, যা দিয়ে কথা বলা বা মত প্রকাশকে ক্রিমিনালাইজ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে এই আইনটি সমালোচকদের কণ্ঠকে দমন করার জন্য ব্যাপক অর্থে একটি লাইসেন্স।

এই আইনের বেশ কিছু ধারায় মুক্ত মত প্রকাশের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানদন্ডকে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এই আইনের ২১ নম্বর সেকশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধে অথবা স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতির জনকের মর্যাদার বিরুদ্ধে কোনো প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা ছড়িয়ে দিলে ১৪ বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রাখা হয়েছে। জাতিসংঘের একটি নিরপেক্ষ বিশেষজ্ঞ পরিষদ হলো ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কমিটি। এরা ইন্টারন্যাশনাল কোভ্যানেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর)-এর বিভিন্ন চুক্তি মেনে চলা হচ্ছে কিনা তা নজরদারি করে। এর একটি অংশ বাংলাদেশও।

ইউনাইটেড নেশনস হিউম্যান রাইটস কমিটি স্পষ্টভাবে আইনে উল্লেখ করেছে যে, একটি দেশ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতাকে সম্মান করতে বাধ্য। তাই ঐতিহাসিক কোনো ঘটনা নিয়ে মতামত প্রকাশকে শাস্তিযোগ্য করা অসঙ্গত।

২৫(ক) সেকশনে ‘আগ্রাসী ও ভীতিকর’ (অ্যাগ্রেসিভ অর ফ্রাইটেনিং) তথ্য প্রকাশ করার অপরাধে তিন বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রাখা হয়েছে। এই শব্দ দুটি সম্পর্কে আইনে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয় নি। মত প্রকাশকে সীমাবদ্ধতার যে আইন, সেখানে এটা পরিষ্কার করে বলা উচিত- কোন জাতীয় মত আইন লঙ্ঘন করবে। আইনের এই ওই অস্পষ্ট টার্মের ব্যবহার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি লঙ্ঘন করেছে। এই অস্পষ্টতার সঙ্গে কড়া বড় ধরনের শাস্তির বিধান একসঙ্গে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ বৃদ্ধি করবে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে অথবা অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে অথবা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে অথবা বিঘ্ন সৃষ্টি করে অথবা আইন শৃংখলা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটায় এমন তথ্য পোস্ট করার কারণে ১০ বছর পর্যন্ত জেলের বিধান রয়েছে ৩১ নম্বর সেকশনে। তবে সুস্পষ্টভাবে এতে বলা নেই যে, কোন জাতীয় বক্তব্য বা মত আইন লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হবে। ফলে এই ধারা ব্যবহার করে সরকার যে মত বা বক্তব্যকে পছন্দ করবে না, তাদের বিরুদ্ধে বিচারের সুযোগ পাবে। উপরন্ত সরকারের যেকোনো সমালোচনা অসন্তোষের জন্ম দিতে পারে এবং জনগণের প্রতিবাদের সম্ভাব্যতা থাকে। আইন শৃংখলার ব্যাঘাত ঘটায় শুধু এমন যুক্তির ভিত্তিতে কোনো সমালোচনাকারীকে শাস্তি দেয়া সরকারের উচিত হবে না।

যেসব বক্তব্য বা বিবৃতি বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ, ঘৃণা অথবা ক্ষোভ সৃষ্টি করে তা রাখা হয়েছে ৩১ নম্বর সেকশনে। যখন আন্তঃসম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা প্রতিরোধ করা গুরুত্বপূর্ণ, তখন তা করতে হয় সে উপায়ে যেখানে মত প্রকাশকে যতটা সম্ভব কম বিধিনিষেধের মধ্যে ফেলা হয়।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, যেখানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনভাবে সভা সমাবেশের মতো মানবাধিকার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেখানে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নামে জনগণের মধ্যে বিতর্ককে বিধিনিষেধ দিয়ে সীমাবদ্ধ করা যেতে পারে না। তাই এই আইনে ‘হেট স্পিস’ বা ঘৃণাপ্রসূত বক্তব্যের যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে খেয়ালখুশিমতো এবং আইনকে নিষ্পেষণমুলকভাবে প্রয়োগের পথ উন্মুক্ত হয়ে গেছে। আর তাতে জাতি এবং ধর্মীয় ইস্যুতে আলোচনায় এক অগ্রহণযোগ্য শীতলতা সৃষ্টি করেছে।

আইসিটি আইনের নিষ্পেষণমুলক ধারা ৫৭-এর মতোই এই আইনের ২৯ নম্বর সেকশন। এখানে অনলাইনে মানহানিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। আইসিটি ধারার মতো নয়, ২৯ নম্বর সেকশনে ওই সব ব্যক্তির ক্ষেত্রে মানহানির অভিযোগ সীমাবদ্ধ করা হয়েছে যারা দন্ডবিধির ক্রিমিনাল মানহানির পর্যায়ে পড়েন। মানহানিকে একটি সিভিল বিষয় হিসেবে দেখা উচিত। একে জেল দিয়ে শাস্তিযোগ্য ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে দেখা উচিত নয়।

ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন বক্তব্যের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ২৮ নম্বর সেকশনে। এখানেই আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ, যে মত অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে এবং এজন্য ফৌজদারি শাস্তির বিধান রাখা হয় তা পক্ষে সাফাই গাওয়া যায় না।

নতুন আইনে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এর বলে তারা অনলাইনের তথ্য প্রচারকে বন্ধ করতে পারবে অথবা তা প্রত্যাহার করার ক্ষমতা রাখে। তারা ওয়ারেন্টবিহিন তল্লাশি করতে পারবে এবং জিনিসপত্র জব্দ করতে পারবে।

বাংলাদেশের সাংবাদিকরা এ আইনের ৩২ নম্বর সেকশনের বিরোধিতা করে আসছেন। এ আইনে সরকার ব্যবহৃত কোনো কম্পিউটার অথবা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইসের গোপনীয় তথ্য (ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন) সংগ্রহ করা, হাতবদল করা বা সংরক্ষণ করার জন্য ১৪ বছর পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটা করা হলে কর্মকর্তারা অন্যায়ভাবে এর ব্যবহার করবেন।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/১১৪০ঘ.)