ইসি-ঐক্যফ্রন্ট বৈঠকে উত্তেজনা, সিইসি’কে সতর্ক করলেন ঐক্যফ্রন্ট নেতা

‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ’

‘মাইন্ড ইয়োর ল্যাঙ্গুয়েজ’

ঢাকা, ৫ নভেম্বর (জাস্ট নিউজ) : বৈঠকটি তফসিলসহ বিভিন্ন ইস্যুতে হলেও রাজনীতিবিদদের নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে একহাত নিলেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। সিইসিকে সতর্ক করলেন বেশ কড়া ভাষায়। সব খবর ছাপিয়ে বৈঠকে উত্তেজনার বিষয়টি এখন আলোচনা হচ্ছে মুখে মুখে। 

সোমবার বিকালে আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে এ ঘটনা ঘটে।

ঐক্যফ্রন্ট ও নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে, প্রতিনিধিদলের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনারদের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের ঘটনা ঘটেছে।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) আহবান জানিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

সূত্র জানায়, নির্বাচন কমিশন ও রাজনৈতিক দলের প্রতি মানুষের আস্থা আছে কি না, এ নিয়েই দুপক্ষের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। তবে বৈঠকের পরে নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় নয়, ভেতরে গলার আওয়াজ এমনই ছিল।

জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জাসদের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম রবের নেতৃত্বে প্রতিনিধিদলের অপর সদস্যরা ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা বরকতউল্লা বুলু, গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ ও সুলতান মনসুর।

অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে বৈঠকে নেতৃত্ব দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা। এ সময় অপর চার কমিশনার মাহবুব তালুকদার, রফিকুল ইসলাম, কবিতা খানম, শাহাদত হোসেন চৌধুরী ও কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ উপস্থিত ছিলেন।

তফসিল পেছানোর দাবিতে এর আগেও একবার ইসিতে চিঠি দিয়েছিলেন ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন।

কমিশন গতকাল জানিয়েছে ৮ নভেম্বর তফসিল হবে। ৪ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি থাকলেও কমিশন রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা মাথায় রেখে তফসিল ঘোষণার তারিখ ৪ দিন পিছিয়ে দেয়। অবশ্য আজকের বৈঠকের পর তফসিল ঘোষণার তারিখ আবার পেছানো হবে কি না, সে ব্যাপারে কমিশনের তরফ থেকে প্রতিনিধিদলকে আশ্বস্ত করা হয়নি।

বৈঠকে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার না করার দাবি জানানো হয়। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনার শাহাদাত হোসেন বলেন, ইভিএম মেশিন না দেখেই মন্তব্য করা হচ্ছে। ইভিএমে কারচুপি করা সম্ভব না। তিনি ঐক্যফ্রন্টের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘প্রয়োজনে আপনারা টেকনিক্যাল লোকদের দিয়ে যাচাই করেন।’

এ পর্যায়ে মান্না বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলছি ইভিএমে ম্যানুপুলেট (কারসাজি) করা সম্ভব।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এখনে নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনাস্থা জানাতে আসিনি। যদিও জনগণের আপনাদের ওপর আস্থা নেই।’

এ সময় কমিশনার শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিও তো জনগণের আস্থা নেই।’

মান্নার বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা বলেন, আপনারা বড় বড় কথা বলেন...

সিইসির বক্তব্য শেষ করতে না দিয়েই মান্না বলেন, ‘মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ।’

এরপর প্রতিনিধিদলের আরেক সদস্য সুলতান মনসুর বলেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দেখা গেছে এক দলের নেতা আরেক জেলায় জেলে। এভাবে চলতে পারে না। তিনি ইসিকে সতর্ক করে বলেন, ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন আর করা যাবে না। ২০১৯ সালেও আপনারা দেশে থাকবেন, সেটা বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন করবেন।

বৈঠকে কী হয়েছিল জানতে চাইলে মান্না বলেন, “আমি এই নির্বাচন কমিশনকে খুব অসহিষ্ণু দেখেছি। খানিকটা ভদ্রতা বোধের অভাব রয়েছে।

“ইভিএম মেশিনটি ম্যানিপুলেট করা যায়, এটা আমি চ্যালেঞ্জ করেছি; এটা আমি দেখিয়ে দেব। এই পর্যায়ে সিইসি বলেছেন- এরকম বড় বড় কথা অনেকেই বলতে পারেন। তখন আমি বলেছি- মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ… তখন কথা একটু হয়েছে।”

পরে কমিশনের পক্ষ থেকে এ নিয়ে জোরালো কোনো উত্তর আসেনি দাবি করে মান্না বলেন, “সব কিছু মিলে ঠিক হয়ে গেছে। পরে সুলতান মোহাম্মদ মনসুর সাহেবকেও একজন নির্বাচন কমিশনার বলেছেন- আপনি মিথ্যা কথা বলছেন।“

সূত্র জানায়, এর আগে প্রতিনিধিদলের প্রধান আ স ম রব নির্বাচনে বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে সেনা মোতায়েনের দাবি জানালে নির্বাচন কমিশনার শাহাদত হোসেন চৌধুরী বলেন, সেনাবাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দেওয়া অসাংবিধানিক। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে সেনা মোতায়েন বিষয়ে কমিশনে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে দেখা গেছে অতীতের নির্বাচনগুলোতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। ভোটের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখে কমিশন সিদ্ধান্ত নেবে।

পরে এক গণমাধ্যমকে দেওয়া এক ব্রিফিংয়ে আ স ম রব বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আমাদের আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। আমাদের দাবিগুলোর মধ্যে কিছু বিষয়ে তারা কথা দিয়েছেন যে, এগুলো তারা রক্ষা করবেন। আর কয়েকটি বিষয়ে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি, তবে পরে জানাবেন বলেছেন।’

দাবিগুলোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রথম দাবি ছিল সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তফসিল ঘোষণা না করা। আমরা তাদের বলেছি, অতীতের বহু নির্বাচন হয়েছে বহুবার তফসিল পিছিয়েছে কিন্তু কোনো সমস্যা হয়নি। অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে নির্বাচন হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সংসদের মেয়াদ আছে। সুতরাং তফসিল পেছালে মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।’

আ স ম রব বলেন, ‘আমরা কমিশনকে বলেছি, পোলিং এজেন্টদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয় না। তারা কথা দিয়েছে এজেন্টদের প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা দেওয়া হবে। তারা রেজাল্ট শিট তৃণমূল পর্যায়ে বিতরণ করবে বলেও জানিয়েছে। আমাদের দাবি, ভোট গণনার আগে এজেন্টদের কাছ থেকে কোনো সই নেওয়া যাবে না। তারপর কমিশনকে আমরা বলেছি, আপনারা ২০১৯ সালেও বাংলাদেশে থাকবেন। সেটা বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচন করবেন।’ ইভিএম না দেওয়া ও সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দেওয়ার দাবির বিষয়ে নির্বাচন কমিশন পরে তাদের সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানান আ স ম রব। তিনি বলেন, ‘আলোচনায় মনে হয়েছে, তফসিল পেছানোর দাবিটি তারা বিবেচনায় নিয়েছেন।’

নির্বাচন কমিশনের বিষয়ে ঐক্যফ্রন্টের আস্থা আছে কি না, জানতে চাইলে আ স ম রব বলেন, তাদের বিষয়ে কী কী বিষয়ে আপত্তি আছে, তা তাদের বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন বিষয়ে আগের দাবির বিষয়ে জানতে চাইলে পাশ থেকে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘সেই দাবি আমাদের এখনো আছে।’

এর পরে ইসির সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ তাঁদের ব্রিফিংয়ে বলেন, ঐক্যফ্রন্ট দাবি জানিয়েছে ৭ তারিখে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাদের যে সংলাপ আছে, সেখানে কী হয় না-হয়, সেদিকে ইসি যেন লক্ষ রাখে। আর সংলাপ শেষ না হওয়া পর্যন্ত যেন তফসিল ঘোষণা করা না হয়। তিনি বলেন, ‘সেনা মোতায়েনের বিষয়ে আমরা বলেছি, তফসিলের পর এ নিয়ে আলোচনা হবে। ঐক্যফ্রন্ট ইভিএম ব্যবহার না করার প্রস্তাব দিয়েছে, আমরা বলেছি সীমিত পরিসরে ব্যবহার করা হবে।’

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আগামী ৮ নভেম্বর আমাদের তফসিল ঘোষণার প্রস্তুতি আছে, তবে এ বিষয়ে ওই দিন সকাল ১০টায় ইসির সভায় সিদ্ধান্ত হবে। এতে ৭ নভেম্বরের সংলাপের বিষয়টি প্রতিফলিত হতে পারে।’

এদিকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিও তফসিল পেছানোর দাবি জানিয়ে একটি চিঠি নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়েছে। এতে স্বাক্ষর করেছেন সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন।

(জাস্ট নিউজ/এমআই/২০০২ঘ.)