বিবিসি বাংলার প্রতিবেদন

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা আছে?

নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কতটা আছে?

ঢাকা, ২৬ নভেম্বর (জাস্ট নিউজ) : নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের নানারকম প্রস্তুতি শুরু করেছে। কিন্তু এসব প্রস্তুতি নিতে গিয়ে আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ বেশ জোরেশোরেই উঠে আসছে।

যদিও আচরণবিধি অনুযায়ী, তফসিল ঘোষণার পর প্রতীক বরাদ্দের আগ পর্যন্ত একদিকে যেমন প্রচারণা নিষিদ্ধ, অন্যদিকে এসময় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা সিটি করপোরেশনের মেয়রদের নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারি সুবিধা ব্যবহারও নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবতা কী বলছে? আর নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সব দলের জন্য সমান সুযোগই বা কতটা তৈরি হচ্ছে?

নরসিংদী পৌরভবন। ভবনের একটি অডিটোরিয়ামে চলছে নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রস্তুতি সভা।

সভায় নৌকা মার্কার শ্লোগান দিয়ে একের পর এক নেতা-কর্মীরা আসছেন। বিকাল নাগাদ সভায় অংশ নিতে আসেন স্থানীয় সাংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম হিরু।

দেখা যায়, ব্যক্তিগত গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে অনুষ্ঠানস্থলে এসেছেন তিনি।

একটু অপেক্ষার পরই দেখা গেলো সদর থানার ওসি সভাকক্ষ থেকে বের হয়ে আসছেন।

সভা শেষে এ বিষয়ে কথা বলি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে। তিনি অবশ্য তার নির্বাচনী সভাকে কেন্দ্র করে কোনো আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করেন না।

তিনি বলেন, “ফ্ল্যাগ আমার মন্ত্রীত্বের একটা পরিচয়। কিন্তু গাড়িটা আমার ব্যক্তিগত। এখানে আমি অন্য কোনো বিশেষ সুবিধা নিচ্ছি না। এখানে আচরণবিধিও লংঘন হচ্ছে না।”

সভাস্থলে সদর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপস্থিতির বিষয়ে অবশ্য কোনো কিছু জানেন না বলেই দাবি করলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী।

“আমি উনাকে এখানে ডেকে আনি নাই। উনি কেন এসেছেন সেটা জানি না। কিন্তু একজন মন্ত্রীকে নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রের থাকে। তিনি হয়তো সে কাজেই এসেছেন। এতে কোনো ভুল নেই। আপনি কী দেখেছেন আমি পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেছি?”

যদিও বাস্তবতা হচ্ছে, পুলিশের ওসি সেই সভায় বেশ কিছুক্ষণ অবস্থান করেছেন। এমনকি সভা থেকে বের হওয়ার পরও সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায় তাকে।

নির্বাচনী বৈঠকে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার উপস্থিতি এবং পরে বৈঠককালীন পুরো সময় অনুষ্ঠানস্থলের বাইরে তার উপস্থিত থাকা নিয়ে কথা বলি নরসিংদী সদর মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সৈয়দুজ্জামানের সঙ্গে।

তিনি অবশ্য দাবি করলেন, অনুষ্ঠানস্থলে মন্ত্রীর উপস্থিত থাকার বিষয়ে তিনি কিছু জানতেন না।

“আমি মন্ত্রী সাহেবের জন্য আসিনি। আমি এসেছিলাম মেয়র সাহেবের কাছে একটা কাজে। মন্ত্রী মহোদয় যে এখানে আসবেন, আমি সেটা জানতাম না।”

স্থানীয় আওয়ামী লীগের এই সভায় অংশ নিতে প্রতিমন্ত্রীর গাড়িতে জাতীয় পতাকা এবং নেতা-কর্মীদের নির্বাচনী ম্লোগানে আচরণবিধি ভঙ্গ হচ্ছে কি-না, সে বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মধ্যে উৎসবের ভাবটা বেশ স্পষ্টই বোঝা গেলো।

যদিও এর আগে দুপুরে আমি যখন জেলা বিএনপি'র কার্যালয়ে যাই, তখন সেখানে উপস্থিত বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে এর বিপরীত চিত্রই দেখতে পেয়েছি।

নরসিংদী জেলার জাতীয়তাবাদী মহিলা দলের যুগ্ম সম্পাদক ফাতেমা ইয়াসমীন বলছিলেন, তারা এখনো নির্বাচনী প্রস্তুতি ঠিকমতো শুরুই করতে পারেননি।

“আমরা তো এখনো প্রস্তুতি নিতে পারছি না। বারবার পুলিশ আসে। গ্রেফতারও করে। দলীয় কার্যালয়ের বাইরে এলাকায় কোনো উঠান বৈঠকও করা যায় না।”

জেলা বিএনপি'র সভাপতি খায়রুল কবির খোকন বলছিলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটছে।

“আওয়ামী লীগ এখানে মিছিল মিটিং করছে, সভা করছে। তারা সব করতে পারবে, কিন্তু আমরা কিছু পারবো না এটা তো হতে পারে না। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তো এখানে একেবারেই নেই। আমরা তো 'নোহোয়্যার' বলতে গেলে। ঘরোয়া বৈঠকেও আমরা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছি। তো এই পরিবেশে নির্বাচন করা তো অত্যন্ত কঠিন।”

নরসিংদীর পর ঢাকার বিভিন্ন স্থানও ঘুরে দেখি আমি। অনেক এলাকাতেই দেখেছি নির্বাচনী ব্যানার-ফেস্টুন ঝুলতে।

নির্বাচন কমিশন থেকে ১৮ নভেম্বরের মধ্যে এসব পোস্টার সংশ্লিষ্টদের তুলে ফেলার নির্দেশনা দেয়া হলেও অনেক ক্ষেত্রে তা মানা হচ্ছে না।

কিন্তু নির্বাচন কমিশন তার দায়িত্ব কতটুকু পালন করছে? নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের আচরণবিধি লংঘনের অভিযোগ নিয়েই বা নির্বাচন কমিশন কী করছে?

বিশেষ করে নির্বাচন পূর্ব সময়ে নরসিংদীতে স্থানীয় সাংসদ ও প্রতিমন্ত্রীর নির্বাচনী কার্যক্রম কতটা আচরণ বিধি সম্মত সে বিষয়ে আমি কথা বলি নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদের সঙ্গে।

তিনি বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী বা অন্য কোনো ভিআইপি ব্যক্তি তাদের মনোনয়নপত্র দাখিল না করেন কিংবা দল থেকে মনোনয়ন না পাবেন ততক্ষণ তো তিনি প্রার্থী না। যখন প্রার্থী ঘোষণা হয়ে যাবে তখন কিন্তু তিনি ফ্ল্যাগ বা সরকারি গাড়ি কিংবা অন্য কোনো সুবিধা ব্যবহার করতে পারবেন না।”

যদিও সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন বলছেন, তফসিল ঘোষণার পর থেকেই রাজনৈতিক দল কিংবা সম্ভাব্য প্রার্থীরা আচরণবিধির আওতায় চলে আসেন।

এই সময় থেকেই আচরণবিধি কার্যকর বলেই প্রচার-প্রচারণা, শোডাউন ইত্যাদি নিষিদ্ধ এবং এই সময়ে নির্বাচনী বৈঠকেও কেউ মন্ত্রীত্বের ফ্ল্যাগ বা অন্য কোনো সরকারি সুবিধা নিতে পারেন না।

তফসিল ঘোষণার পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় দলীয় নেতা-কর্মী এমনকি সম্ভাব্য প্রার্থীদের গ্রেফতার কিংবা হয়রানির অভিযোগ নিয়ে দফায় দফায় নির্বাচন কমিশনের শরণাপন্ন হয়েছেন বিএনপিসহ ঐক্যফ্রন্টের প্রতিনিধিরা।

প্রশাসনে রদবদলের দাবি নিয়েও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা নির্বাচন কমিশনকে লিখিতভাবে দিয়েছেন তারা। মূলত: নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নেই এমন উপলব্ধি থেকেই এসব অভিযোগ করা হলেও নির্বাচন কমিশন বলছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যেন থাকে সেজন্য সকল ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে।

“আমরা তো আইন-শৃংখলা রক্ষা বাহিনীকে নির্দেশনা দিয়েছি কাউকে অযথা হয়রানি না করার জন্য। আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দৃশ্যমাণ করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টাই নিচ্ছি। আচরণবিধি ভঙ্গ হলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদেরও আইনের প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে,'' বলেন মি. আহমদ।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, নিরপেক্ষ নির্বাচনী পরিবেশের জন্য ইলেকশন কমিশনের নির্দেশনা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করছে না বলেই মনে করছেন বিএনপি নেতারা।

এমনকি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের আন্তরিকতা নিয়েও যথেষ্ট সন্দেহ দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে।

এমন অবস্থায় সব দলকে আস্থায় নিয়ে সবার জন্য নির্বাচনে সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে নির্বাচন কমিশনকে বড় ধরনের পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হবেই বলেই মনে করা হচ্ছে। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

(জাস্ট নিউজ/একে/২৩৪৯ঘ.)