ভূয়া নির্বাচনে সরকার সমর্থক ভূয়া নির্বাচনী পর্যবেক্ষক

ভূয়া নির্বাচনে সরকার সমর্থক ভূয়া নির্বাচনী পর্যবেক্ষক

সদ্য অনুষ্ঠিত সরকার নিয়ন্ত্রিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকদের নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। অনেক বিদেশি পর্যবেক্ষকরা আসতে পারেননি। ভিসা জটিলতা না সরকারের সহায়তা না করা, বিতর্ক হয়েছে বিস্তর।

• একটির মহাসচিব, আরেকটির নির্বাহী পরিচালক একই ব্যক্তি
• একটির অফিস ও ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি
• আরেকটির চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা আ. লীগ এমপি
• নীতিমালা অনুযায়ী যা থাকা যায় না
• টাকা আসে নগদে ও বিকাশে
• নামের আগে ‘সার্ক’ থাকলেও, ‘সার্ক’-এর সঙ্গে সম্পর্ক নেই

এবারের নির্বাচনে দেশি ৮১টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ২৫ হাজার ৯০০ জন এবং ওআইসি ও কমনওয়েলথ থেকে আমন্ত্রিত ও অন্যান্য বিদেশি পর্যবেক্ষক ৩৮ জন, কূটনৈতিক বা বিদেশি মিশনের কর্মকর্তা ৬৪ জন এবং বাংলাদেশে দূতাবাস বা হাইকমিশন বা বিদেশি সংস্থায় কর্মরত বাংলাদেশি ৬১ জন নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী আলোচিত দুটি সংস্থা ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ এবং ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’।

এই দুটি সংস্থা গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, “একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অতীতের চেয়ে অনেকাংশে ভালো, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে।”

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, “সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ৫ হাজার ৭৬৫ জন সদস্য নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন।”

বিদেশি পর্যবেক্ষকেরা তিনটি দলে ভাগ হয়ে রাজধানীর ২৪টি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছেন। এছাড়াও, ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম দেশের ২১৪টি আসনের ১৭ হাজার ১৬৫টি কেন্দ্র পর্যবেক্ষণ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন কানাডার লেবার মার্কেট প্ল্যানিংয়ের সিনিয়র অ্যানালাইসিস তানিয়া ডন ফস্টার, মানবাধিকার কর্মী চ্যালি ডন ফস্টার, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী হাকিমুল্লাহ মুসলিম, নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য নাজির মিয়া, নেপালের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মাদীন আলী, কলকাতা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সাংবাদিক কমল ভট্টাচার্য, কলকাতা জজকোর্টের আইনজীবী ড. গৌতম ঘোষ এবং শ্রীলঙ্কার সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের বিশেষ প্রতিনিধি এহসান ইকবাল।

কানাডা থেকে আসা পর্যবেক্ষক তানিয়া ডন ফস্টার নির্বাচনের দিন বলেছিলেন, “...এখানকার নির্বাচনের পরিবেশ কানাডার মতই।” (প্রথম আলো, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৮)

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ এবং ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’-এর কার্যক্রম সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়েছে দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের পক্ষ থেকে।

সংস্থা দুটির নাম আগে শোনা যায়নি। দেশের অন্য কোনো পর্যবেক্ষকরাও তাদের বিষয়ে জানেন না। এই সংস্থা দুটি এর আগে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন বা স্থানীয় সরকার পর্যায়ের কোনো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে দেখা যায়নি।

গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নৌকার প্রতিকৃতি তুলে দিচ্ছেন আবেদ আলী (ডান থেকে দ্বিতীয়)। সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পেজে ছবিটি গত ২২ নভেম্বর প্রকাশ করা হয়।

খোঁজ করতে গিয়ে ‘ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’-এর কার্যালয় ও ওয়েবসাইট পাওয়া যায়নি। তাদের কার্যক্রম সম্পর্কেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর নাম অনুযায়ী ধারণা করা যায় আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক সংস্থা। মাওলানা মোহাম্মদ আবেদ আলী নামক একজন ব্যক্তিই দুটি সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তিনি একটির মহাসচিব এবং অন্যটির নির্বাহী পরিচালক।

অনুসন্ধান করতে গিয়ে ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইটের (https://sarchumanrights.org/) সন্ধান পাওয়া গেল। ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, সংস্থাটি সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ-ভিত্তিক। ‘সার্ক’-এর সঙ্গে সংস্থাটির কোনো সম্পর্ক ওয়েবসাইটের তথ্যে নেই। ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় তাদের একজন করে প্রতিনিধির নাম ও ছবি ওয়েবসাইটে দেওয়া রয়েছে। অফিসের ঠিকানা বা প্রতিনিধিদের ফোন নম্বরও ডেইলি স্টার অনলাইনকে দিতে পারেননি সংস্থার মহাসচিব আবেদ আলী।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা হিসেব রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির একাধিক এমপি। ‘তারা প্রয়োজন অনুযায়ী অর্থ সহায়তাও দিয়ে থাকেন’ দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের প্রশ্নের উত্তরে এ তথ্য জানিয়েছেন মহাসচিব আবিদ আলী।

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ নীতিমালার ৪.৩ ধারায় লেখা রয়েছে, “’নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সহিত সরাসরি জড়িত ছিলেন বা আছেন কিংবা নিবন্ধন লাভের জন্য আবেদনকৃত সময়ের মধ্যে কোন নির্বাচনের প্রার্থী হইতে আগ্রহী এইরূপ কোন ব্যক্তি যদি পর্যবেক্ষণের জন্য আবেদনকারী কোন সংস্থার প্রধান নির্বাহী কিংবা পরিচালনা পর্ষদের বা ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য হইয়া থাকেন, তাহা হইলে উহা যে নামেই অভিহিত হউক না কেন উক্ত সংস্থাকে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে নিবন্ধন করা হইবে না।”

কিন্তু, তারা নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষক হিসেবে নিবন্ধন পেয়েছেন নির্বাচন কমিশন থেকে। রাজনীতিবিদদের চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা রেখে কী করে নিবন্ধন পেলো ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন?’- দ্য ডেইলি স্টার অনলাইনের এই প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সচিব বলেন, “এদের ব্যাপারে এতো বিস্তারিত আমার জানা নেই।”

ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে, সংস্থাটির চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর উপজেলা) আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। উপদেষ্টা হিসেবে রয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য মো. রুহুল আমিন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি শিকদার মকবুল হক, সাবেক মন্ত্রী নাজিম উদ্দিন আল আজাদ, চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম, পার্বত্য খাগড়াছড়ি আসনে জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. সোলায়মান আলম শেঠ।

সংস্থাটির সভাপতি হিসেবে রয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি ও মানিকগঞ্জ দরবার শরীফের খলিফা মো. আব্দুস সালাম এবং মহাসচিব হিসেবে রয়েছেন অধ্যাপক মোহাম্মদ আবেদ আলী।

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ ঘেঁটে শুধু মহাসচিব মোহাম্মদ আবেদ আলীর কর্মকাণ্ডই নজরে এসেছে বেশি। কখনও তিনি বিভিন্ন মানবাধিকারবিষয়ক সেমিনারে বক্তব্য রাখছেন, কখনও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন।

সর্বশেষ গত ২২ নভেম্বরের একটি ফেসবুক পোস্টে দেখা গেছে, গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে নৌকার প্রতিকৃতি তুলে দিচ্ছেন আবেদ আলী ও ব্যারিস্টার নাজমুল হুদাসহ অন্যান্যরা।

সংস্থাটির ফেসবুক পেজে গত ২৫ সেপ্টেম্বর একটি পোস্ট করা হয়। সেখানে আবেদ আলীর ভাষ্য, “সরকারের অধীনেই সকল ধরণের সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। সময়ের সাথে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়। আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ারও পরিবর্তন হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, পরিবর্তন হলে আমরা মেনে নিতে পারবো না। যে পরিবর্তন আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে সহায়ক, সে নিয়মকে, পরিবর্তনকে স্বাগত জানাই। এ সরকারের নির্বাচন কমিশন ছোট বড় ৬ হাজার নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছে। প্রয়োজনে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হোক। ইতোমধ্যে তাদের নির্বাচন পরিচালনার দক্ষতা আমাদের বিশ্বাস করতে বাধ্য করে।”

ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া অফিসের ঠিকানা ও ফোন নাম্বার অনুযায়ী চলল অনুসন্ধান। টিএন্ডটি-র নম্বরে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চেষ্টা চললো, কিন্তু কেউ ফোন ধরলেন না। ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া কার্যালয়ের ঠিকানার (প্লট-৭, রোড-৪/৩, ব্লক-বি, এভিনিউ-১, মিরপুর-১২) উদ্দেশে বের হলাম।

বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজির পর একটি ছয়তলা আবাসিক ভবনের গেটে ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ লেখা একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়ল। আবাসিক ভবনের গেট বন্ধ, ফুটো দিয়ে উকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। এক যুবক এসে গেট খুলে বললেন, “আপনি কে, কাকে চাই?”

সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর ভেতর থেকে তেড়ে এলেন বয়স্ক একজন। রাগত স্বরে প্রশ্ন করলেন, “কেন এসেছেন?”

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ সম্পর্কে জানতে এসেছি। তিনি বলেন, “এখানে কারো কাছে কোনো তথ্য পাবেন না, চলে যান। খুব বেশি প্রয়োজন হলে মহাসচিব আবেদ আলীকে ফোন দেন।” বলেই- আবেদ আলীর নম্বর দিয়ে, কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ভেতরে চলে গেলেন।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেই ভেতর থেকে গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে এলেন সেই যুবক। বললেন, “ইনিই সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর সভাপতি মো. আব্দুস সালাম। কিছু মনে করবেন না, বয়স হয়ে গেছে তো, তাই স্যারের আচরণ এমন হয়ে গেছে।”

যুবকের নাম জাহেদুল ইসলাম। তিনি এই বাড়ির কেয়ারটেকার বলে জানান। “সভাপতির সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই” বললে গেট খুলে ভেতরে যেতে দিলেন। গিয়ে দেখি, ছোট্ট একটি রুম। দুটি টেবিল, চারটি চেয়ার, একটি সোফা ও একটি আলমারি। নিচতলার এই রুমটিই ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়।

“অফিস কি সবসময় বন্ধই থাকে?”- এমন প্রশ্নের উত্তরে যুবকটি জানালেন, “মাঝে-মধ্যে লোকজন আসেন। আবেদ আলী স্যার আজ বিকালে বা রাতে আসতে পারেন। সবে তো নির্বাচন শেষ হলো, তাই সবাই সেসব নিয়েই ব্যস্ত আছেন।”

নির্বাচনের আগে বা পরে এই কার্যালয়ে কোনো বিদেশি লোক আসেনি বলেও জানান জাহেদুল।

দুই দিনে কয়েকবার ফোনে কথা হলো মাওলানা মোহাম্মদ আবেদ আলীর সঙ্গে। ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর হয়ে কতোজন বিদেশি পর্যবেক্ষক নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করতে এসেছিলেন?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আটজন এসেছিলেন। আরও বেশি আসার কথা ছিলো, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তাদের অনেকেই আসতে পারেননি।”

বাংলাদেশে এসে বিদেশি পর্যবেক্ষকরা ছিলেন কোথায়?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, “বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সবাই গুলশান-২ এর ‘হোটেল এক্সিকিউটিভ ইন’-এ ছিলেন।”

‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টা হিসেবে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির এমপিরা রয়েছেন। দলীয় এমপিদের সঙ্গে নিয়ে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ করা যায়? মহাসচিব আবেদ আলী বলেন, “উপদেষ্টাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো প্রভাব আমাদের এখানে পড়ে না। কারণ এখানে আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টির একজন রাজনীতিক রয়েছেন। অপর একজনের নিজেরই একটি দল আছে।”

নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আপনাদেরকে অর্থায়ন করেছে কারা?- এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “যেহেতু এটা আন্তর্জাতিক সংগঠন, বিশেষ করে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আমাদের কমিটি আছে এবং কানাডা থেকে যারা এসেছেন তারাও আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে এসেছেন। আমরা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অর্থায়নে সংগঠন পরিচালনা করি। নির্বাচন উপলক্ষে আমাদের একটি বাজেট ছিলো। আমাদেরকে সরকার অর্থায়ন করেনি, এমনকি নির্বাচন কমিশনও করেনি।”

“আমাদের পরিচালনা কমিটি আছে, বাইরের যারা শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, তাদেরকে আমরা প্রস্তাব দেই যে এই কাজ হচ্ছে, তোমরা আমাদের সাপোর্ট দেবে কী না? তারা যদি ভালো মনে করে, তাহলে তারা আমাদের সহযোগিতা করে,” যোগ করেন তিনি।

বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষী কারা? কীভাবে অর্থ দেন তারা?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “দেশের বাইরে আমাদের বাঙালি কমিউনিটির লোকজন আছেন। তাদের অনেকেই আমার ও আমার কাজের প্রতি সম্মান দেখিয়ে টাকা পাঠান। বিকাশ একাউন্টের মাধ্যমে বা আত্মীয়দের সহযোগিতায় তারা আমাদের কাছে টাকা পৌঁছে দেন।”

চেয়ারম্যান ও উপদেষ্টারা আর্থিকভাবে সহায়তা করেন না? এমন প্রশ্নের জবাবে আবেদ আলী জানান, “আমরা চাইলে উনারা নিজেদের থেকে আমাদের অর্থ সহায়তা দেন বা উনাদের বন্ধু সম্প্রদায়কে সহায়তা করতে বলেন।”

এবারের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য আপনাদের বাজেট কতো ছিল?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা তো কাউকে টাকা দিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করাইনি। যারা কর্মী আছে, তারা নিজেদের উদ্যোগে করেছে এবং তারা এই কাজটিকে উপভোগ করেছে।”

“তবে নির্বাচনের দিন যাতায়াতসহ অন্যান্য কাজে খরচ হয়েছে ৫ লাখ টাকার মতো। সবকিছু মিলিয়ে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে,” যোগ করেন তিনি।

বিদেশি পর্যবেক্ষকের জন্য আপনাদের বাজেট ছিলো কতো?- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “মাত্র তারা গেলেন। আর আমরা এখনও বাজেটটি শেষ করিনি। এখানে কী খরচ হয়েছে না হয়েছে, দেখতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নিজেরাই টিকিট করে এসেছেন। আমরা শুধু তাদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। আর যে হোটেলে তারা ছিলেন, সেটি আমারই চট্টগ্রামের এক ব্যবসায়ী বড় ভাইয়ের হোটেল। সেখানে তাদের জন্য সর্বোচ্চ কনসিডার করা হয়েছিলো।”

বিদেশি পর্যবেক্ষকদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ তৈরি হলো কীভাবে? আপনাদের প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষক হওয়ার জন্য তারা টিকেট কেটে চলে এলেন?- এ প্রশ্নের জবাবে আবেদ আলী বলেন, “বিদেশি পর্যবেক্ষকরা সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের কার্যক্রমগুলো ফলো করে থাকেন। এছাড়াও, কানাডাতে আমাদের যে বাঙালি কমিউনিটির লোকজন রয়েছেন, তারাই পর্যবেক্ষকদের আসতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।”

বলা হচ্ছে- আপনারা অর্থ দিয়ে তাদের এনেছেন। তাদের পর্যবেক্ষক হিসেবে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই।- এর জবাবে আবেদ আলী বলেন, “অভিজ্ঞতা অবশ্যই তাদের আছে। এর আগে ভারত ও নেপাল থেকে কমল ভট্টাচার্য, গৌতম ঘোষ, নাজির মিয়া বাংলাদেশে এসেছিলেন। আর যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তারা ২৮ ডিসেম্বর এসে অভিজ্ঞতা নিয়েছেন, সবাই একসাথে সমন্বয় করেছেন।”

আপনি দাবি করেছেন যে এটি আন্তর্জাতিক সংগঠন, কেন?- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমরা তো মাত্র ২০১৪ সালে বাংলাদেশ সরকার থেকে অনুমোদন পেয়েছি। এছাড়াও, সব জায়গাতেই আমাদের সংগঠনের প্রোফাইল দিয়ে প্রস্তাবনা জমা দিয়ে রেখেছি। ২০১৮ সাল তো চলে গেলো, আশা করছি ২০১৯ সালের মধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনের কাছ থেকে স্বীকৃতি পেয়ে যাবো।”

কোথায় কোথায় আপনাদের সংগঠনের কার্যক্রম রয়েছে?- এমন প্রশ্নে আবেদ আলী জানান, “দুবাই, কাতার, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও লন্ডনে তাদের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এসব দেশে মূলত সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকরা সংগঠিত হয়ে নিজেরাই কমিটি গঠন করেছেন। তারপর কেন্দ্র থেকে তাদের সমর্থন দেওয়া হয়েছে।”

এর আগে সার্ক হিউম্যান রাইটসের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ বা অন্য কোনো দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছেন কী না?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, করিনি, কারণ- আমরা তখন নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ছিলাম না।”

পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও কোন যোগ্যতায় আপনারা নির্বাচন কমিশনের (ইসি) থেকে অনুমোদন পেলেন?- এই প্রশ্নের জবাবে আবেদ আলী বলেন, “এখানে প্রায় ১১৮টি সংগঠন অনুমোদন পেয়েছে। সেখানে এমন সংগঠনও আছে, যাদের নির্বাচন সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। আসলে প্রতিষ্ঠানের কোনো ধারণা থাকে না, ধারণা থাকে ব্যক্তির।”

সার্কভুক্ত দেশগুলোতে আপনাদের কোনো কার্যক্রম আছে বলে তো মনে হচ্ছে না। নামে কেনো ‘সার্ক’ যুক্ত করেছেন?- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “সার্কের বর্তমান মহাসচিব আমজাদ হোসেন সিয়ালের সঙ্গে আমরা বসেছি। উনি আমাদের অভয় দিয়ে বলেছেন, যেহেতু সার্কের কোনো মানবাধিকার সংগঠন নেই, আপনারা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করুন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, সার্কের আগামী মহাসম্মেলনে তারা আমাদের অনুমোদনের ব্যাপারটি ঘোষণা দেবেন।”

গত ৩ জানুয়ারি রাত পর্যন্ত ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’-এর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা গেলেও, এরপর থেকে সেটিতে আর প্রবেশ করা যাচ্ছে না।

ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম’ এবং ‘সার্ক হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন’ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই জানিয়ে সুশাসনের জন্যে নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, “আমরা তো নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করি না, আমরা নির্বাচনের পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করি। তারপরও এই দুটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আমার কিছু জানা নেই। আমি দেশের অনেকগুলো নির্বাচন পর্যবেক্ষকারী প্রতিষ্ঠানকে চিনি। তবে এদের সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই।”

নির্বাচন পর্যবেক্ষণ সংস্থা ব্রতী-র নির্বাহী পরিচালক শারমিন মুরশিদ বলেন, “আমরা এদেরকে সত্যিই চিনি না। ইলেকশন মনিটরিং ফোরাম নামে এর আগে কোনো প্রতিষ্ঠান ছিলো না। তবে, আমার ধারণা এবার এরকম একটি মোর্চা তৈরি করা হয়েছে। এরা নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক বলছে, কিন্তু এরা আর কোথাও নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে কী না সেটি আমার জানা নেই।”

এই দুটি সংস্থার ব্যাপারে জানতে চাইলে জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ বলেন, “আমার জানা মতে, তারা এবারই বোধহয় প্রথম বাংলাদেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে। এর আগে যদি তারা পর্যবেক্ষণ করতো, তাহলে আমাদের সঙ্গে দেখা হতো।” সূত্র : দ্য ডেইলি স্টার

এমজে/একে