১ম ধাপের বিশ্ব ইজতেমা সম্পন্ন

মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনা

মোনাজাতে মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ কামনা

দেশ, জাতি ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ এবং দুনিয়া ও আখিরাতের শান্তি কামনা করে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শনিবার সকালে শেষ হয়েছে ৫৪তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম অংশ। এ সময় আত্মশুদ্ধি, মাগফিরাত ও বালা-মুসিবত থেকে মুক্তি চেয়ে কেঁদে বুক ভাসান কয়েক লাখ মুসল্লি। মহামহিম ও দয়াময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সন্তুষ্টি লাভে ‘আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন’ ধনিতে জানান করুণ আকুতি।

মোনাজাত পরিচালনা করেন বিশ্ব তাবলিগ জামাতের অন্যতম মুরব্বি, বাংলাদেশের শূরা সদস্য, কাকরাইল মসজিদের খতিব মাওলানা মুহাম্মদ জোবায়ের। বেলা ১০টা ৪০ মিনিটে শুরু হওয়া ২৪ মিনিটব্যাপী মোনাজাতে প্রথম ১৩ মিনিট আরবিতে পরবর্তী ১১ মিনিট বাংলায় আল্লাহর দরবারে আর্জি জানান তিনি।

বিভিন্ন স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও রেডিও মোনাজাত সরাসরি সম্প্রচার করে। এর পাশাপাশি মুঠোফোন ও ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী মোনাজাতে শরিক হন আরও কয়েক লাখ মানুষ।

আজ থেকে শুরু হবে ইজতেমার দ্বিতীয় অংশ। কাল আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হবে মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম এ সম্মেলন। প্রথম অংশের পরিচালনায় ছিলেন মাওলানা জোবায়েরপন্থী (ভারতের মাওলানা সাদ কান্ধলভীবিরোধী অংশ) মুরব্বিরা। দ্বিতীয় অংশ পরিচালনা করবেন মাওলানা সাদপন্থী মুরব্বিরা।

রোববার আখেরি মোনাজাতের পর মাইকে আগামী বছর দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমার ঘোষণা দেয় মাওলানা জোবায়েরপন্থীরা। ১০-১২ ও ১৭-১৯ জানুয়ারি ওই ইজতেমা হবে। আয়োজকদের অন্যতম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, একপর্বে লোক সংকুলান না হওয়ায় আগামী বছর আবারও দুই পর্বে ইজতেমা হবে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আবদুল্লাহ, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী মো. জাহিদ আহসান রাসেল, গাজীপুর সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াইএম বেলালুর রহমান, মহানগর আওয়ামী লীগ সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমত উল্লাহ খান প্রমুখ আখেরি মোনাজাতে অংশ নেন।

মোনাজাতে শরিক হন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমীর ও হাটহাজারী দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফিসহ দেশের বিশিষ্ট আলেমরা। চট্টগ্রাম থেকে হেলিকপ্টারে এসেছিলেন আল্লামা শফি, মোনাজাত শেষে একইভাবে ফিরেও যান তিনি।
দেশের ৬৪ জেলার মুসল্লি ছাড়াও ৮৫ দেশের হাজারেরও বেশি বিদেশি মেহমান আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়েছেন। মোনাজাত উপলক্ষে টঙ্গী, গাজীপুর, উত্তরা ও ময়দানের চারপাশের এলাকার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, মার্কেট, বিপণিবিতান ও অফিস বন্ধ ছিল। এবারের ইজতেমায় ৫০টি স্বেচ্ছাসেবী, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা মুসল্লিদের স্বাস্থ্য সেবা দেয়।

শনিবার সকালে চারদিক থেকে লাখো মুসল্লি হেঁটে টঙ্গী ইজতেমা ময়দানে আসতে থাকেন। ৯টার আগেই ইজতেমা ময়দান কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। এরপর মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলিগলি, বিভিন্ন ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। ময়দানে পৌঁছাতে না পেরে লাখো মানুষ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক, টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়ক, কামারপাড়া সড়কসহ বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন।

মাঠের আশপাশের বিভিন্ন ভবন, রাস্তা, অলিগলি, বিভিন্ন যানবাহন ও তুরাগ নদে দাঁড়িয়েই আল্লাহর দরবারে হাত তোলেন বহু মানুষ। মাঠের পাশের বাসা-বাড়ি, কলকারখানা, অফিস, দোকানপাট ও এর ছাদ, যানবাহন ও এর ছাদ এবং তুরাগ নদে নৌকায় বসেও অনেকে মোনাজাতে অংশ নেন। অনেকে বিমানবন্দর গোল চত্বর কিংবা উত্তরা থেকে, কাউকে কাউকে টঙ্গী রেলস্টেশন বা চেরাগআলী থেকেই মোনাজাতে অংশ নিতে দেখা যায়। অনেক নারীও অংশ নেন এতে। মোনাজাত চলাকালে রোনাজারিতে ইজতেমা মাঠ ও আশপাশে কয়েক কিলোমিটার এলাকায় আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

মোনাজাত শেষে একসঙ্গে ফিরতে গিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েন এসব মানুষ। বাস-ট্রেন বা অন্য কোনো যানবাহন- ঠাঁই ছিল না কোনোটিতেই। এ সুযোগে বিভিন্ন পরিবহনগুলো বহুগুণ বেশি ভাড়া আদায় করে। এরপরও তিন-চতুর্থাংশ মানুষকে ঘরে ফিরতে হয়েছে হেঁটে। বিকাল পর্যন্ত এ পরিস্থিতি বিরাজ করছিল।

মোনাজাত বাংলায় হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন অনেক মুসল্লি। মোনাজাত প্রচারের জন্য গণযোগাযোগ অধিদফতর ইজতেমা ময়দান থেকে আবদুল্লাপুর ও বিমানবন্দর রোড পর্যন্ত এবং গাজীপুর জেলা তথ্য অফিস ইজতেমা ময়দান থেকে চেরাগআলী, টঙ্গী রেলস্টেশন, স্টেশন রোড থেকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার উড়াল সেতু ও আশপাশের অলিগলিতে পর্যাপ্ত মাইক সংযোগ দেয়।

মোনাজাতে যা বলা হল : মাওলানা জোবায়ের মোনাজাতে বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের জিন্দেগির গুনাহ-খাতা মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, উম্মত গুনাহগার, আপনি সব উম্মতকে মাফ করে দেন। হে আল্লাহ, আমাদের ইমানি জিন্দেগি নসিব করে দেন। ইমানের সঙ্গে মউত নসিব করে দেন। হে আল্লাহ, সারা জীবন যেন আপনার হাবিবের সুন্নতের ওপর চলতে পারি সেই তৌফিক দান করেন। হে আল্লাহ, জাহেলি জামানা খতম করেন। হে আল্লাহ, এলেমি জিন্দেগি কায়েম করে দেন।

কায়মনোবক্যে তিনি বলেন, হে আল্লাহ, আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হয়ে যান। আমরা যেন আপনার সন্তুষ্টি মাফিক চলতে পারি সে তওফিক দেন। সব বালা-মসিবত থেকে আমাদের হেফাজত করেন। হে আল্লাহ, বিশ্বের সব মুসলমানের জানমাল, ঈমান, আমল, ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করেন। হে আল্লাহ, আমাদের ঝগড়া-বিবাদ, মারামারি-হানাহানি খতম করে দেন। সব মুসলমানকে এক শরীরের মতো বানিয়ে দেন। হে আল্লাহ, সারা দুনিয়াকে রক্ষা করেন। আমাদের পেরেশানি দূর করে দেন। হে আল্লাহ, সারা দুনিয়ায় এ দাওয়াতি কাজ পৌঁছে দেন। হে আল্লাহ, বাতিলের সব রাস্তা বন্ধ করে দেন।

সমাপনী বয়ান : মোনাজাতের আগে হেদায়েতি বয়ান করেন পাকিস্তানের মাওলানা ওবায়দুল্লাহ খোরশেদ। তা বাংলায় ভাষান্তর করেন বাংলাদেশের মাওলানা আবদুল মতিন। মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বলেন, আমাদের সব সময় ইমান-আমল ও দাওয়াতের কাজ করতে হবে। নবী-রাসূলগণ এসেছেন, দীনের দাওয়াত দিয়েছেন, কিন্তু কারও কাছে কিছু চাননি। তেমনিভাবে আমরা দাওয়াতের কাজ করতে বের হব, সে মেহনতের পুরস্কার মানুষের কাছে চাইব না। এর পুরস্কার স্বয়ং আল্লাহপাক দেবেন। তিনি বলেন, নবী করিম (সা.) ও সাহাবায়ে আজমাঈন যে তরিকায় মেহনত করেছেন ওই তরিকায় যখন মেহনত হবে তখন আল্লাহতায়লা আমাদের হেদায়েত দান করবেন।

১ হাজার ৬০০ জামাত : অন্যতম মুরুব্বি ইঞ্জিনিয়ার মেজবাহ উদ্দিন বলেন, তাবলিগের শীর্ষ মুরব্বিদের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাত শেষে ১ হাজার ৬০০ জামাত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছেন। এসব মুসল্লি ৪০ দিন, ৪ মাস, ৬ মাস, ১ বছর ও আজীবনের জন্য বেরিয়েছেন আল্লাহর রাস্তায়।

ময়দানের নিয়ন্ত্রণ বদল : গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ওয়াইএম বেলালুর রহমান বলেন, মোনাজাতের পর থেকে রাত ১২টার মধ্যে মাওলানা জোবায়েরপন্থীরা পুরো মাঠ খালি করে দেবেন। মোনাজাতের পর থেকেই খালি করতে শুরু করেন তারা। এরপরে মাঠ মাওলানা সাদ অনুসারীদের বুঝিয়ে দেয়া হবে। বেলালুর রহমান বলেন, মুসল্লিদের প্রস্থান এবং প্রবেশ নিয়ে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না হয় সেদিকে পুলিশ সতর্ক রয়েছে।

মাঠ খালি হতে শুরু হলে সন্ধ্যার পর থেকে মাওলানা সাদের অনুসারীরা মাঠে আসতে শুরু করেন। মাওলানা সাদ অনুসারী মাওলানা সৈয়দ আনিসুজ্জামান যুগান্তরকে জানান, রোববার ভোরে প্রশাসন আমাদের মাঠ বুঝিয়ে দিলে ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হবে।