‘মানুষ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে’

‘মানুষ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে’

দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বর্জনের মুখে বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত নিরুত্তাপ নির্বাচনে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র হয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলাম।

পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আতিকের পূর্বসূরী প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকও প্রথমে বিজিএমইএ এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি (এফবিসিসিআই) এবং সার্ক চেম্বারের সভাপতি ছিলেন।

২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর আনিসুল হকের মৃত্যুর এক বছরের বেশি সময় পরে এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বিরোধীদের বয়কটে এ নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকেই জনগণের আগ্রহ ছিল শূন্যের কোঠায়। এ ছাড়া ভোটের দিনে ভোটকেন্দ্রেই ভোটারশূন্যতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

ভোটের দিন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোটার সংকট ছিলো। প্রার্থী, প্রিজাইডিং অফিসার, সাংবাদিক সবাই ভোটারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু খুব কমই ভোটারের দেখা মিলেছে এই নির্বাচনের ভোটকেন্দ্রগুলোতে। এমন অবস্থাতেও ঢাকা উত্তরের এক হাজার ২৯৫টি ভোটকেন্দ্রের সবকটির ঘোষিত ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম ৮ লাখ ৩৯ হাজার ৩০২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী জাতীয় পার্টির শাফিন আহমেদ পেয়েছেন ৫২ হাজার ৪২৯ ভোট।

যদিও এই নির্বাচন সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘এটা একটা ভোটারবিহীন আনুষ্ঠানিকতা হয়েছে। একতরফা নির্বাচন হওয়ার কারণে এর ফলাফল প্রায় পূর্বনির্ধারিত ছিল।’

গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় ভোটগ্রহণ শুরু হয়। কিন্তু অনেক কেন্দ্রেই সকাল ১০টায়ও ভোটারের দেখা মেলেনি৷ এমনকি কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোট শুরুর আড়াই ঘণ্টার মধ্যে একটিও ভোট পড়েনি৷ সেই অভিজ্ঞতার কথা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন সঞ্চিতা সিতু নামে একজন সাংবাদিক।

তিনি বলেন, ‘আমি পূর্ব রামপুরা এলাকায় নারী ভোটকেন্দ্রগুলোতে গিয়েছিলাম। সেখানে হলি ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এবং আইডিয়াল স্কুলের কয়েকটি কেন্দ্র আমি দেখেছি। হলি ক্রিসেন্ট স্কুলে নারীদের তিনটি ভোটকেন্দ্র ছিল। সেখানে সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কোনো ভোট পড়েনি। কল্যাণী রানী নামে একজন ভোটার গিয়েছিলেন। কিন্তু তার নামের সঙ্গে ভোটার লিস্টের অমিল থাকায় তিনি ভোট দিতে পারেননি। এরপর বনশ্রী আইডিয়াল স্কুলে গিয়ে দেখি একটি কেন্দ্রে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৫টি।’

সিতু বলেন, ‘প্রথম আড়াই ঘণ্টায় হলি ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে কোনো ভোট না পড়লেও প্রিজাইডিং অফিসার হাসানুজ্জামান কিন্তু তখন দাবি করেন ভোট পড়েছে, পরে হিসাব দেবেন। তবে পরিস্থিতি দেখে আমি আর কিছু বলিনি। এরপর দুপুর দেড়টার দিকে আমি আবার ওই ভোটকেন্দ্রে যাই। তখনো ভোটকেন্দ্রে কোনো ভোটার ছিলনা, পুরো ফাঁকা। আমি হিসেব নিয়ে একটি বুথে চারটি এবং আরেকটি বুথে আটটি ভোট পড়েছে বলে জানতে পারি৷’

তিনি আরো বলেন, ‘ভোটার না আসার কারণ জানতে কোনো ভোটারের সঙ্গে আমি কথা বলতে পারিনি৷ ভোটারইতো আসেনি, কথা বলবো কীভাবে? তবে একজন প্রিজাইডিং অফিসার আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, মনে হয় তিনদিনের ছুটিতে সবাই বাড়ি চলে গেছেন৷’

জাতীয় পার্টি থেকে মেয়র প্রার্থী শাফিন আহমেদ সকালে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রগুলো ঘুরেও আমি ভোটারদের কোনো দেখা পাইনি৷'' আওয়ামী লীগের প্রার্থী আতিকুল ইসলাম সকালের বৃষ্টিকে ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার জন্য দায়ী করেন৷ তবে পরে রোদ উঠলেও ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিত বাড়েনি।

প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক পার্টির মেয়র প্রার্থী শাহীন খান বলেন, ‘ভোটার উপস্থিতি খুবই কম। ৩-৪ পার্সেন্টের বেশি হবেনা। আমি দুপুর ১২টায় তেজগাঁ রাজধানী উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দেই। ওই সময় আমি ছিলাম চতুর্থ ভোটার।’

ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভোটের উপরে মানুষের আস্থা নেই। গত নির্বাচনে ভোটের আগের রাতেই ভোট হয়ে যাওয়ায় মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। তাঁরা মনে করেছেন ভোট দিয়ে আর লাভ কী! ছুটি পেয়েছি ঘুমাই।’’

আগ্রহ কমে যাওয়ার কারণ জানতে কি ভোটারদের সঙ্গে কথা বলেছেন? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভাই ভোটারইতো নাই৷ কথা বলবো কার সঙ্গে!’

স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমি সকাল ১০টায় ভাসানটেক উচ্চবিদ্যালয়ে ভোট দিই। আমিই ছিলাম প্রথম ভোটার৷ এর আগে কেউ ভোট দেয়নি। এরপর ওই এলাকায় আরো দুই-আড়াই ঘণ্টা ছিলাম। তেমন কোনো ভোটার আমার চোখে পড়েনি।’

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘গত নির্বাচনের পর এখন মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসতে ভয় পায়।’

বিবিসির একজন সংবাদদাতা লিখেছেন, বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা। ঢাকার পল্লবীর একটি ভোট কেন্দ্রের মধ্যে ঢুকে দেখা গেল নৌকা মার্কায় কিছু এজেন্ট ঘোরাফেরা করছেন। পুলিশ এবং প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা অলস সময় পার করছেন। তারা বলছিলেন, বৃষ্টির কারণে ভোটার কম। কিন্তু বেলা বাড়তে থাকে, বৃষ্টিও একসময় থেমে যায় কিন্তু ভোটারদের দেখা মেলে না।

ঢাকা উত্তরের ভোটার মিনারা খাতুন বলছিলেন, কেন তিনি ভোট তিনি যাবেন না।

তিনি বলছিলেন, ‘এখানে প্রার্থী কে জানি না, কোন পোস্টার নেই, মাইকিং নেই, কোন জায়গায় যাবো ভোট দিতে সেটাই জানি না।’

ভোটের দিন অনেক ভোটার জানেন না মেয়র পদে সব প্রার্থীদের নাম। তবে কয়েকজন ভোটার ভোট দিতে না যাওয়ার অন্য একটি কারণকে ক্ষোভের সঙ্গে উল্লেখ করেন।

একজন ভোটার বলছিলেন, ‘ভোট যদি সুন্দরভাবে না দিতে পারি তাহলে এই ভোটের কোন দাম আছে?’

আরেকজন নারী ভোটার বলছিলেন, ‘কাকে ভোট দেব সেটা মনে মনে রাখছিলাম কিন্তু বলে যে আপনার ভোট হয়ে গেছে।’ তবে কেউ কেউ নিজের ভোটটা দেয়ার তাগিদ থেকে ভোট দিয়ে এসেছেন।

একজন ভোটার বলছিলেন, ‘সকালে চার পাঁচজন দেখেছি। লোক খুব কম। আমার ভোট আমি ঘণ্টা খানেক আগে দিয়ে এসেছি।’

নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার তার নিজ কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ডিএনসিসি মেয়র পদে উপনির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি। রাজনৈতিক পরিচয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও প্রধান বিরোধী দলগুলো অংশ নেয়নি। নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক না হলে তাতে ভোটারদের ভোট দিতে যেতে উৎসাহ দেখা যায় না।’

লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমি মগবাজারস্থ ইস্পাহানি ভোটকেন্দ্র পরিদর্শন করেছি। সরকার দলীয় মেয়রের পোলিং এজেন্ট ছাড়া আর কারো পোলিং এজেন্ট সেখানে ছিল না। সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত একই ভবনে অবস্থিত পাঁচটি কেন্দ্রের ১৫টি বুথে মাত্র ৩৮৫ জন ভোট দিয়েছেন। ওই পাঁচ কেন্দ্রে ভোটার রয়েছে ৯ হাজার ৪১৩ জন।’

আর সকাল ১০টার দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেন, ‘ভোটকেন্দ্রে কম ভোটার আসার দায় নির্বাচন কমিশনের নয়৷ এই দায় রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের।’

ভোটারের কম উপস্থিতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘স্বল্প সময়ে বা এক বছরের জন্য মেয়র ও কাউন্সিলরদের নির্বাচন হচ্ছে। এ কারণে ভোটারদের আগ্রহ কম হতে পারে। আবার সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ও প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে৷’

সাবেক কমিশনার সাখাওয়াত হোসেন যা বললেন
নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হলে ভোটারের উপস্থিতি এরকমই হয় বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘মানুষ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এর কারণ হলো, আগেই দেখেছে ভোটাররা ভোট দিতে পারছেন না, তাদের ভোট আগেই হয়ে যায়, বুথ দখল হয়ে যায়। আগের বড় নির্বাচনগুলোতে যা হয়েছে তার প্রভাব পড়ছে। সামনে উপজেলা নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে।’

তাঁর মতে, ‘মানুষের মনের মধ্যে একটা কথা, আমি গেলেই কী, না গেলেই কী? এই রকম ধারণা যখন জন্মে তখন ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ থাকেনা। দ্বিতীয়ত হচ্ছে, যদি নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ না হয় সেখানে গিয়ে মানুষ কাকে ভোট দেবে? আর তৃতীয়ত, ভোটের প্রতি মানুষ আস্থা হারিয়েছে৷’

নির্বাচিত মেয়র মাত্র একবছর ক্ষমতায় থাকবেন, সে কারণে মানুষের আগ্রহ কম কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটা বিষয় নয়, মানুষতো আগে ৬ মাসের জন্যও ভোট দিয়েছে৷ আসল কথা হলো মানুষ লস্ট ইন্টারেস্ট৷’

আরেক প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনতো সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন করবে৷ তবে ভোটার উপস্থিতির জন্য দায় প্রার্থী এবং রাজনৈতিক দলগুলোর, ভোটারদেরও৷ তবে তাঁরা আগ্রহ হারিয়ে ফেললে আর কী করা যাবে!’

তিনি আরো বলেন, ‘কেউ কেউ বলছেন ভোট পড়েছে পাঁচ ভাগ৷ এখন ভোটের ফল নির্বাচন কমিশন কী দেয় সেটাও দেখার বিষয়।’

প্রসঙ্গত, ডিএনসিসি’র মেয়র উপনির্বাচন ছাড়াও উত্তর ও দক্ষিণের ৩৬টি ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচনও হয়েছে। সীমানা জটিলতার কারণে আগে ওই ওয়ার্ডগুলোতে নির্বাচন হয়নি। মেয়র উপনির্বাচনে ভোটারদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও ওই ৩৬টি ওয়ার্ডের ভোট কেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারদের লম্বা লাইন। ভোটারদের উপস্থিতি ছিল সন্তোষজনক।

ইসি সচিবের দাবি
নির্বাচনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে বিকেল চারটায়। এরপর নির্বাচন কমিশন সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে মেয়র পদে উপ-নির্বাচন ও দুই সিটির (উত্তর ও দক্ষিণ) সম্প্রসারিত অংশে কাউন্সিলর পদে নির্বাচনে সব মিলিয়ে ৫০ শতাংশের মতো ভোট পড়তে পারে।’ তিনি বলেন, ‘অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট হয়েছে।’

ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি কম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মেয়র পদে উপ-নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় ভোটারদের উপস্থিতি কম ছিল। তবে যেসব কেন্দ্রে কাউন্সিলর পদে ভোট হয়েছে সেখানে ভোটার উপস্থিতি অনেক বেশি ছিল।’

এমআই