গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন নয়: অরুন্ধতী

গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন নয়: অরুন্ধতী

খ্যাতিমান লেখক ও বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী রায় বলেছেন, “অবশ্যই গণতন্ত্রের বিকল্প নেই। গণতন্ত্র মানে শুধু নির্বাচনকে বোঝানো হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি এমন নয়। আজ গণতন্ত্র যাদের প্রতিনিধিত্ব করে তা খুবই স্বল্প মানুষের জন্য।”

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমণ্ডি ২৭ নম্বরে মাইডাস সেন্টারে 'আটমোস্ট এভরিথিং' শিরোনামে আয়োজিত এক আলোচনা অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।

অরুন্ধতী বলেন, “ভোট এল, রাজনীতিবিদরা দুয়ারে এসে উন্নয়নের ফিরিস্তি দিয়ে ভোট চাওয়া শুরু করল। তোমাদের কাছে এই হল গণতন্ত্র।”

“গোটা উপমহাদেশের চিত্র আসলে একই। গণতান্ত্রিক চর্চা ভিন্ন হলেও এই চিত্রটা কেমন করে যেন মিলে যায়। গণতন্ত্র এভাবেই নষ্ট হয়ে যায়।”

ঢাকায় খ্যাতিমান এই লেখকের অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি নিয়ে এর আগে নানা নাটকীয়তার সূচনা করে সরকার। মুক্ত মতের পক্ষে সোচ্চার এই লেখকের পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠান 'অনিবার্য কারণের' ধুঁয়া তোলে বন্ধ করে দেয়া হয়। জানিয়ে দেয়া হয় অনুষ্ঠান করা যাবেনা। আর তাতে আয়োজকদের মতোই হতবাক হয়ে পড়েন দেশের সুশীল সমাজ আর সাধারণ মানুষ। বিষয়টি ভাইরাল হয়ে উঠে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।দেশের বুদ্ধিজীবিরা এক যৌথ বিবৃতি অনুমতি নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের এই টালবাহানার নিন্দা জানান এবং এটাকে কাপুরুষিত বলে মন্তব্য করেন।

দিনভর নাটকীয়তা আর দু'দফায় অনুষ্ঠানের অনুমতি বাতিলের পর শেষমেষ মাইডাস সেন্টারে এর অনুমতি দেয়া হয়।

মানবাধিকার কর্মী অরুন্ধতী বলেন, “গণতন্ত্র মানেই নির্বাচন না। গণতন্ত্র রক্ষা করা হয় কিছু মানুষের জন্য। আমি এ গণতন্ত্রের পক্ষে না।” তিনি বলেন, “আমি একজন ভ্রাম্যমাণ প্রজাতন্ত্রবাদী।”

অনুষ্ঠানে অরুন্ধতী বলেন, “আমি বাংলাদেশের মানুষের জন্য এসেছি। আমার এখানে পাঠক রয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ ছিল। আমার দুটো সত্তা। লেখক সত্তা এবং কর্মী সত্তা। দুটো সত্তাকেই ধারণ করি।”

আলোচনা মঞ্চে অরুন্ধতীর সঙ্গে ছিলেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। শুরুতে লিখিত বক্তব্য পড়েন অরুন্ধতী। এরপর শহিদুল আলমের প্রশ্নের উত্তর দেন তিনি। কথা বলেন সমসাময়িক নানান বিষয় নিয়ে।

অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, ড. শাহদীন মালিক, সাংবাদিক মাহফুজ আনাম, অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, সাংবাদিক নূরুল কবীর, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, সাংবাদিক মিজানুর রহমান খান, আনিসুল হক, নারী অধিকার নেত্রী খুশী কবীর, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, জোনায়েদ সাকী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আলোকচিত্র উৎসব ছবিমেলায় অংশ নিতে গত ৩রা মার্চ ঢাকায় আসেন বুকার পুরস্কারবিজয়ী ভারতীয় লেখক অরুন্ধতী রায়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তান এভাবে আমি এদেশগুলোকে ভাগ করতে চাই না। আসলে এগুলো একই দেশ। গ্লোবাল ভিলেজ ভাবলে এমনটি ভাবতে হবে।”

রাজনীতিকদের খুবই ক্ষমতাবান মনে হলেও অনেক সময়ই তারা ক্ষমতাহীন মন্তব্য করে অরুন্ধতী রায় বলেন, “রাজনীতি এখন মানুষের জন্য মনে হয় করা হয় না। এখন রাজনীতি হয়, নদী, বাঁধ, বিভিন্ন প্রকল্পকে ঘিরে। এ সব কিছুকে রূপ দেয়ার জন্য মানুষের চিরন্তন জীবন বিপন্ন করা হয়।”

অরুন্ধতী বলেন, “আমি নদীকে কেন্দ্র করে বাঁধ কিংবা কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বাসী নই। নদীকে ভাগ করা যায় না। বড় বড় বাঁধ নির্মাণের পেছনে ফ‍্যাসিবাদ আর জাতীয়তাবাদী চেতনা লুকানো থাকে।”

ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট, রামপালসহ নানা বিষয়ে জটিলতা প্রসঙ্গে ভারতের প্রগতিশীল গোষ্ঠী উচ্চকণ্ঠ নয় কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে অরুন্ধতী রায় বলেন, তিনি এ মন্তব্যর সঙ্গে পুরোপুরি একমত। তিনি জেনে–বুঝে এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখছেন। প্রয়োজনে এই ইস্যুতে তিনি বাংলাদেশে আসবেন। উন্নয়নের প্রথাগত ধারণার বাইরে ভাবেন অরুন্ধতী।

তিনি বলেন, “অক্সফামের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ভারতে ৫০ কোটি লোকের সম্পদ পুঞ্জীভূত ৯ জন লোকের কাছে। তাই উন্নয়নের কথা এলে লোকজন জানতে চায়, কার জন‍্য উন্নয়ন।”

ভারতীয় এই লেখক মনে করেন, উপমহাদেশে সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে যাওয়ার মূলে রয়েছে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস আর অর্থনীতির ভ্রান্ত ধারণা।

“ধর্ম আর অর্থনীতি নিয়ে এত ভ্রান্ত ধারণা জন্মেছে মানুষের মনে! ক্রমেই বাড়ছে সন্ত্রাসবাদ। রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ বাড়ছে। আর তা মোকাবেলায় দেশগুলো যেন গণতন্ত্র ছেড়ে সামরিক পন্থা বেছে নিচ্ছে।”

ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্র চর্চার পাশাপাশি উন্নয়ন কার্যক্রম, পরিবেশ, নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনধারা নিয়ে কথা বলেন অরুন্ধতী; শোনান নিজের লেখক জীবনের গল্পও।

প্রযুক্তির আধিপত্যে সাহিত্যের আবেদন কমবে কিনা এমন এক প্রশ্নের জবাবে অরুন্ধতী বলেন, “সাহিত্যের উপাদান গুণগত মানসম্পন্ন হলে তার আবেদন কখনও ফুরাবে না।”

“লেখালেখি করতে এলে অবশ্যই এবার লেখার গুণগত মান নিয়ে ভাবতে হবে। যা তা লিখে ফেললেই কিন্তু হবে না। পাঠককে ভালো কিছু দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা থাকতে হবে। প্রযুক্তি যতই আসুক না কেন, পড়ুয়াদের কাছে সাহিত্যের আবেদন কিন্তু কখনও ফুরাবে না।”

প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ দিয়েই সাড়া ফেলেছিলেন অরুন্ধতী রায়, পৈত্রিক সূত্রে বাংলাদেশের বরিশালের যার শেকড় রয়েছে। প্রথম উপন্যাসের ম্যান বুকার জয়ের ২০ বছর পর প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস’।

২০ বছর বিরতির প্রসঙ্গে অরুন্ধতী বলেন, “আমি আসলে মুক্ত মানুষ থাকতে চেয়েছি। এতটা চাপ নিতে চাইনি। প্রথম উপন্যাস লেখার পরই পরবর্তী উপন্যাস খুব দ্রুত প্রকাশ করে জনপ্রিয় হব, এই পুরস্কার পাব, সেই পুরস্কার পাব, এমনটা আমি কখনও ভাবিনি। এসব কঠিন ভাবনার মধ্যে আমি নাই।”

“আমি তখনই ভারতের রাজনীতি নিয়ে ভাবতে শুরু করি। রাজনীতির ভাবনাগুলো সব এক করে নিয়ে পরের উপন্যাসটি লিখতে শুরু করি ২০১২ সালে।”

ভারতের মাওবাদী আন্দোলন নিয়ে প্রগতিশীলদের ধ্যানধারণার বিপরীতে অবস্থান নেওয়ায় তাকে ‘ভারতবিরোধী’ আখ্যাও পেতে হয়েছে একসময়। কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধেও মতামত প্রকাশ করছেন তিনি।

অরুন্ধতী বলেন, “ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা চায়, আমি তাদের মতো কথা বলি। প্রথম দিকে ব্যাপারটা খুব খারাপ লাগত। আমার জাতীয়তাবাদ নিয়েও প্রশ্ন এসেছে বিভিন্ন সময়ে। আমার মতামত প্রকাশের পর চারপাশ থেকে ঘৃণাবাক্য বর্ষণ শুরু হল।”

কাশ্মীর ইস্যুতে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, “তাদেরও শুনতে হবে, তাদেরও বলার আছে। তাদেরকে আমরা কতোটা মূল স্রোতে আনতে পারছি।”

ভারত, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশ- মুক্তমনা লেখকরা তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নির্মাণে এখনও লড়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“হাজারো সমস্যার পর লেখকরা টিকে থাকার লড়াই করছেন। কখনও তারা জেতেন, কখনও হারেন। আর হারের পর একেবারে বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়েন কেউ কেউ। নোংরা লাগে ব্যাপারটা।”

উপমহাদেশের রাজনীতিবিদরা গণতান্ত্রিক উন্নয়নের পথে হাঁটতে গিয়ে নীতি ভুলে বসে থাকেন বলেও অভিযোগ করেন অরুন্ধতী।

“কখনও কখনও তাদের উন্নয়ন কাজের জন্য জনগণকে এমন সব মূল্য চুকাতে হয়! নীতির ঠিক থাকে না বলে উন্নয়নের নামে চলে সব বেআইনি কার্যক্রম।”

‘অ্যাটমোস্ট এভরিথিং’ শিরোনামে সন্ধ্যা পৌনে সাতটায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের শুরুতে শহিদুল আলম অরুন্ধতীকে প্রশ্ন করেন, “আপনি এখানে কেন এসেছেন?” তখন তিনি বলেন, “আমি আপনার জন্য এসেছি। আপনাদের জন্য এসেছি।”

ভারতীয় এ লেখক বুদ্ধিজীবী এবং অ্যাকটিভিস্ট হিসেবেও পরিচিত। ‘দ্য গড অব স্মল থিংসের জন্য খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছান অরুন্ধতী। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি ১৯৯৮ সালের ম্যান বুকার পুরস্কার লাভ করে। এ ছাড়াও তিনি মানবাধিকার সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজে জড়িত।

জিএস/