শুভ বাংলা নববর্ষ ১৪২৬

আজ পহেলা বৈশাখ

আজ পহেলা বৈশাখ

রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ বাংলা নববর্ষ নিয়ে কবিতার পঙ্ক্তিতে লিখেছিলেন- ‘ওই যে পূর্ব তোরণ-আগে/দীপ্ত নীলে, শুভ্র রাগে/প্রভাত রবি উঠল জেগে/দিব্য পরশ পেয়ে,/নাই গগনে মেঘের ছায়া/যেন স্বচ্ছ স্বর্গকায়া/ভুবন ভরা মুক্ত মায়া/মুগ্ধ- হৃদয় চেয়ে।’ আজ বাংলার আকাশে উঠেছে নতুন বছরের নতুন সূর্য।

আজ পহেলা বৈশাখ। বঙ্গাব্দ ১৪২৬-এর প্রথম দিন। আজ স্বপ্ন দেখার দিন, নব আনন্দে জেগে ওঠার দিন, নতুন আলোয় হারিয়ে যাওয়ার দিন। কবি রফিক আজাদ যেভাবে বলেছেন, ‘পহেলা বৈশাখ তুই বুক বেঁধে আশার আঁচলে/নতুন দিনের স্বপ্ন মগ্ন হোস বিদ্যুৎ বিভায়।’ বাংলার ঘরে ঘরে আজ উৎসবের আমেজ।

এই উৎসব যে একান্তই বাঙালির। শুধু তা-ই নয়, পহেলা বৈশাখ বাঙালির সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। হাজার বছরের ঐতিহ্যের বহমানতায় আজ বাঙালি হারিয়ে যাবে বাঁধাভাঙা উল্লাসে। লাখো মানুষ আজ ঘরের বাইরে ছুটে আসবে বাঁধভাঙা উল্লাসে মাততে।

আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরে যাবে বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তর। আজকের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পুরনো সব জরা-গ্লানিকে মুছে ফেলে সবাই গেয়ে উঠবে নতুন দিনের গান। ১৪২৫-এর আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার হিসাব চুকিয়ে শুরু হবে নতুন এক পথচলা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সর্বজনীন উৎসবে নববর্ষ উদযাপনে একসঙ্গে গাইবে ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’।

বাংলার গ্রাম, শহর, বন্দর, পথ, ঘাট- সব জায়গায় আজ দোলা দেবে পহেলা বৈশাখ। নাচে-গানে, ঢাকে-ঢোলে, শোভাযাত্রায় পুরো জাতি বরণ করবে নতুন বছরকে। নগরে থাকবে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার উৎসব। জোয়ান-বুড়ো সবাই মাতবে মুড়ি-মুড়কি, মণ্ডা-মিঠাইয়ের সঙ্গে। খোলা হবে বছরের নূতন হিসাব নিয়ে হালখাতা। চলবে মিষ্টিমুখ।

নতুন বছর উপলক্ষে দেশবাসীকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানিয়ে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রধান ও নেতারা।

পহেলা বৈশাখ মানেই পুরাতন, জরাজীর্ণকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাওয়া। জাতির জীবনের নানা পর্যায়ের বিগত ক্লান্তি, ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা ভুলে এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেবে সবাই।

অসাম্প্রদায়িকতার দীক্ষা নিয়ে সব আস্ফালনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার সংকল্প ব্যক্ত করবে। পহেলা বৈশাখ পালনের হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। এটি সারা দেশে ছড়িয়ে গেলেও এ উৎসব মূলত এসেছে গ্রামবাংলার মাটির কোল থেকে। তবে বাঙালি এখন বিশ্ববাঙালি।বিশ্বের যেখানেই থাকুক বাঙালি, আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠবে নতুন বাংলা বছরকে বরণ করে নিতে। পহেলো বৈশাখ উপলক্ষে আজ সরকারি ছুটি। অন্যান্য বছরের মতো এবারও সরকারিভাবে পালন হচ্ছে পহেলা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও সব উপজেলায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ আলোচনা সভা ও গ্রামীণ মেলার আয়োজন করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ইউনেস্কো কর্তৃক মঙ্গল শোভাযাত্রাকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়টিকে গুরুত্বারোপ করে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন করা হচ্ছে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ ব্যবস্থাপনায় জাঁকজমকপূর্ণভাবে নববর্ষ উদযাপন করছে। সেই সঙ্গে বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলো এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। নববর্ষের প্রথম দিনে সব কারাগার, হাসপাতাল ও শিশু পরিবারে (এতিমখানা) ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের ব্যবস্থা করা হবে।

শিশু পরিবারের শিশুদের নিয়ে ও কারাবন্দিদের পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে এবং কয়েদিদের তৈরি বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্রদর্শন করা হবে। জাতীয় জাদুঘর, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের ব্যবস্থাপনায় জাদুঘর ও প্রত্নস্থানগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে (শিশু-কিশোর, প্রতিবন্ধী ও ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা টিকিটে)। সরকারি-বেসরকারি টেলিভিশন ও রেডিও চ্যানেলগুলো প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা। সংবাদপত্রগুলো প্রকাশ করেছে ক্রোড়পত্র ও বিশেষ নিবন্ধ।

বাঙালির বর্ষবরণ মানেই ছায়ানটের প্রভাতী আয়োজন। সামাজিক সব অনাচারের বিরুদ্ধে মানুষের মনে শুভবোধ জাগিয়ে তোলার মানস নিয়ে ১৪২৬ বঙ্গাব্দকে বরণ করবে ছায়ানট। ‘অনাচারের বিরুদ্ধে জাগ্রত হোক শুভবোধ’- এ আহ্বান নিয়ে সাজানো হয়েছে রমনার বটমূলের প্রভাতী আয়োজন। যথারীতি ভোর সোয়া ৬টায় বছরের প্রথম সূর্যোদয়কে স্বাগত জানানো হবে রাগালাপ দিয়ে।

প্রত্যুষে থাকছে প্রকৃতির স্নিগ্ধতা ও সৃষ্টির মাহাত্ম্য নিয়ে ভোরের সুরে বাঁধা গানের গুচ্ছ। পরের ভাগে থাকছে অনাচারকে প্রতিহত করা এবং অশুভকে জয় করার জাগরণী সুরবাণী, গান-পাঠ-আবৃত্তিতে দেশ-মানুষ-মনুষ্যত্বকে ভালোবাসার প্রত্যয়। বর্ষবরণ ১৪২৬ সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে দেখা যাবে ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে (bit.ly/chhayanaut)।

শিক্ষার্থী-প্রাক্তনী-শিক্ষক নিয়ে, ছোটবড় মিলিয়ে এবারের অনুষ্ঠানে সম্মেলক গান পরিবেশন করবেন শ’খানেক শিল্পী। অনুষ্ঠানে থাকছে ১৩টি একক ও ১৩টি সম্মেলক গান এবং ২টি আবৃত্তি। ছায়ানটের আহ্বান অনুযায়ী রবীন্দ্র রচনা থেকে বেছে নেয়া হয়েছে দুটি আবৃত্তি।

একই ধারায় গানগুলো নির্বাচন করা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ আবদুল করিম, কুটি মনসুর, সলিল চৌধুরী ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনা থেকে। জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের সমাপ্তি টানার আগে ছায়ানট সভাপতি শুভবোধ জাগরণের আহ্বান জানাবেন তার কথনে।

সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে বের হবে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এর এবারের প্রতিপাদ্য- ‘মস্তক তুলিতে দাও অনন্ত আকাশে’। যার মধ্য দিয়ে অস্থির সময়ে প্রেরণার ডাক দেবেন চারুকলার শিক্ষর্থীরা। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে রয়েছে চ্যানেল আই ও সুরের ধারার যৌথ আয়োজনে ‘হাজারো কণ্ঠে বর্ষবরণ’। ভোর সাড়ে ৫টায় শুরু হওয়া এ আয়োজন চলবে দুপুর ১২টা পর্যন্ত।

ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে শিশুপার্কের পাশে নারকেলবীথি চত্বরে অনুষ্ঠিত হবে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান ‘জাগো নব আনন্দে’। অনুষ্ঠানটি উৎসর্গ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা সঙ্গীতশিল্পী আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী আনোয়ার হোসেনকে।

সকাল সাড়ে ৭টায় শুরু হবে এ অনুষ্ঠান। গানে গানে নতুন বছরকে বরণের এ আয়োজনে সংবর্ধনা প্রদান করা হবে কণ্ঠশিল্পী তপন চৌধুরী এবং বাচিকশিল্পী ইশবাল খোরশেদ ও ঝর্ণা সরকারকে।

এছাড়া বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, শিশু একাডেমি, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, জাতীয় প্রেস ক্লাব, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, কেন্দ্রীয় কচিকাঁচার মেলা, বেণুকা ললিতকলা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে।

রাজধানীর পাঁচতারকা হোটেল সোনারগাঁও, র‌্যাডিসন, ওয়েস্টিন, ঢাকা রিজেন্সি, খাজানাসহ হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোর উদ্যোগেও উদযাপিত হবে নতুন বছরের উৎসব। পহেলা বৈশাখ উদযাপন করবে ঢাকা ক্লাব, গুলশান ক্লাব, উত্তরা ক্লাবও।

তবে গত তিন বছরের ধারাবাহিকতায় নিরাপত্তাজনিত কারণে এবারও বিকাল ৫টার মধ্যে বর্ষবরণের সব অনুষ্ঠান শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অন্যদিকে পুরো জাতি মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির মৃত্যুর শোকে শোকাহত।

এদিকে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র‌্যাব) ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক (ডিজি) কর্নেল জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, বর্ষবরণে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাজধানীর উৎসবস্থলগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় থাকবে এবং তা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করবে র‌্যাব।

তিনি বলেন, যে কোনো ধরনের নাশকতা ঠেকাতে প্রস্তুত র‌্যাব। শুক্রবার দুপুরে রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখ অনুষ্ঠানকে ঘিরে র‌্যাবের সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ শেষে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খানসহ র‌্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পহেলা বৈশাখ ঘিরে কোনো ধরনের হুমকি আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কোনো হুমকি নেই। রাজধানীতে র‌্যাবের পাঁচটি ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ কর্মকর্তাই নববর্ষের নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকবেন।

তিনি বলেন, রমনা বটমূলসহ গুরুত্বপূর্ণ সব ভেন্যুতে ডগ স্কোয়াডসহ বোম্ব ডিস্পোজাল ইউনিট সুইপিং করবে। এছাড়া টহল টিম, মোটরসাইকেল পেট্রোল ও অবজারভেশন পোস্ট থাকবে। বড় ভেন্যুগুলো মনিটরিং করার জন্য আমরা নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করেছি। বড় ভেন্যুতে মোবাইল কোর্টসহ মেডিকেল টিম থাকবে, যাতে দেশের মানুষ নির্বিঘ্নে নববর্ষ উদযাপন করতে পারে।

এমআই