বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারছেন না বিচারকরাই: সুলতানা কামাল

বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারছেন না বিচারকরাই: সুলতানা কামাল

মানবাধিকারকর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘বাংলাদেশে এখন বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু হয়েছে। উচ্চ আদালতের বিচারকরাই বিচার ব্যবস্থায় আস্থা রাখতে পারছেন না।’

মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার বিচারের দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে তিনি এ মন্তব্য করেন।

সুলতানা কামাল বলেন, “আমাদের কাছে যে পরিসংখ্যান আছে, সে পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৮ সালে হাজারের বেশি নারী ধর্ষিত হয়েছেন; ৬৩ জনের বেশি নারীকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এই ৬৩ হত্যাকাণ্ডের বিচার কবে হবে? আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে ভুগছি। আদালতের বিজ্ঞ বিচারকের মুখে শুনেছি যে, তারাও বলেছেন, ‘সাগর-রুনির হত্যার বিচারের মতো যেন নুসরাত হত্যার বিচারের কাজ হারিয়ে না যায়’। তার মানে যারা উচ্চ আদালতে বিচারক হিসেবে আছেন, তারাও বিচার ব্যবস্থার উপরে আস্থা রাখতে পারছেন না।

এসব ক্ষেত্রে দেশের প্রধান নির্বাহী (প্রধানমন্ত্রী) যদি চান, তাহলে বিচার হবে। আর তিনি যদি না চান, তাহলে এসব ঘটনার বিচার হবে না। যে ৬৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, তাদের বাবা-মা কি প্রধানমন্ত্রীর কাছে গিয়ে তাদের সন্তান হত্যার বিচার চাইতে পারবে? পারবে না, কারণ আমরা বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে বাস করছি।’

মানবাধিকারকর্মী হিসেবে নিজের ৫০ বছরের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মানবাধিকারকর্মী হিসেবে ৫০ বছর ধরে কাজ করছি। কতবার এসব ঘটনার বিচারের দাবিতে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি তা হিসেব করে বলতে পারবো না। প্রতিবারই আমরা দাঁড়িয়েছি, কোনও একটা জঘন্য হত্যাকাণ্ড, যার সঙ্গে অধিকাংশ সময় নারী নির্যাতনের ব্যাপার জড়িত, তার দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাইতে। রিপিট পারফরমেন্সের মতো আমরা রাস্তায় দাঁড়াচ্ছি; আমরা রিপিট পারফরমেন্সের ফাঁদে পড়েছি। ক’দিন পরপর এরকম একটি করে ঘটনা ঘটবে, আর আমরা সমাবেশ-মানববন্ধন করবো এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার চাইবো। কিছুদিন পর সে বিচারের দাবি হারিয়ে যাবে। এমনকি আমরাও যারা বিচারের দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়াই, তাদেরও ভুলে যেতে হয়।’

সুলতানা কামাল বলেন, ‘আজকে নুসরাত প্রাণ দিয়ে আমাদের আবার পথে নিয়ে এসেছে। নুসরাত আমাদের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর যে যৌন নির্যাতন হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে সে সাহস করে তার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে গিয়েছিল। এরকম শত শত ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটছে। কিন্তু অনেকে থানায় নালিশ দিতে যায় না। নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো, এ ভয়ে অনেক নারী আর থানায় নালিশ দিতে যাবে না। নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পেছনে যে উদ্দেশ্য ছিল, সেটা হল– সবাইকে ভয় দেখানো। যাদের ওপর এধরনের নির্যাতন হবে, তারা যেন ভয়ে আর মুখ না খুলে। কোনও সমাজই অপরাধমুক্ত নয়; এমন সমাজ নেই, যেখানে যৌন নির্যাতন হবে না। যারা যৌন নিপীড়নের ভুক্তভোগী তারা যদি মুখ খুলতে পারে এবং পরিবার,সমাজ এবং রাষ্ট্র তাদের পাশে দাঁড়ায়, তাহলে এর প্রতিরোধ এবং প্রতিকার করা যায়। এক্ষেত্রে কখনও কখনও আমরা দেখি,পরিবার এবং সমাজ তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় যে বাহিনী, রাষ্ট্রের সে অঙ্গ এতো অনাচারে লিপ্ত থাকে যে, এ ধরনের ঘটনার বিচার সহজে পাওয়া যায় না।’

নুসরাতের হত্যাকারীদের কাপুরুষের দল বলে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, ‘যারা নুসরাতকে হত্যা করেছে, তারা ভয় পেয়েছে। এক্ষেত্রে নুসরাতের বিরাট বীরত্ব রয়েছে। কারণ সে অপরাধীদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পেরেছে, যার জন্য তাকে কঠিন একটি ফল ভোগ করতে হয়েছে। তাই নুসরাত আমাদের বীরদের মধ্যে একজন হয়ে আজীবন বেঁচে থাকবে।’ এসময় তিনি সব নারী নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবি করেন।

মানববন্ধন শেষে বিশাল একটি মিছিল বের করা হয়। এটি শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের মধ্যদিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়।

মানববন্ধনে অংশ নিয়েছে জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়ন, বাংলাদেশ নারী মুক্তি সংসদ, যৌন ও নারী নিপীড়ন প্রতিরোধ আন্দোলন, বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি, বাংলাদেশ যুব মৈত্রী, জাতীয় হকার্স ফেডারেশন, বাংলাদেশ ছাত্র মৈত্রী, গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ-৭১ সোসাইটি, দক্ষিণ বাংলা নারী আইনজীবী পরিষদ।

এমআই