ওয়াসার ১০০ ভাগ সুপেয় পানি এক মাসেই দূষিত হলো কিভাবে?

ওয়াসার ১০০ ভাগ সুপেয় পানি এক মাসেই দূষিত হলো কিভাবে?

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) একটি প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ঢাকা ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেছিলেন, ঢাকা ওয়াসার পানি ১০০ ভাগ সুপেয়। ২০ এপ্রিল দেওয়া এ বক্তব্যের প্রায় এক মাস পর গতকাল বৃহস্পতিবার তার স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হলো ঢাকা ওয়াসার ৫৯ এলাকার পানি বেশি দূষিত। পানের অনুপযোগী।

এমডি স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদনটি গতকাল হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। এর আগে ১৭ এপ্রিল টিআইবি রাজধানীর ৯১ শতাংশ বাসিন্দা ওয়াসার পানি ফুটিয়ে পান করেন উল্লেখ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। টিআইবির এই তথ্য সে সময় প্রত্যাখ্যান করেন ঢাকা ওয়াসার এমডি। বিচারপতি জেবিএম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলম সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে বৃহস্পতিবার রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু ঢাকা ওয়াসার ওই প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন।

পরে প্রতিবেদনে উল্লিখিত দূষিত পানির নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে মতামত জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের (মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্ট) চেয়ারম্যান ড. সাবিতা রেজওয়ানা রহমানকে ২১ মে সকাল সাড়ে ১০টায় হাইকোর্টে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়েছে।

এর আগে গত ১৭ এপ্রিল টিআইবি এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, ঢাকা ওয়াসার ৯১ শতাংশ গ্রাহকই পানি ফুটিয়ে পান করেন। আর বাসাবাড়িতে এ পানি ফোটাতেই বছরে পোড়ানো হয় ৩৬ কোটি ৫৭ লাখ ৩৭ হাজার ঘনমিটার গ্যাস, যার আর্থিক মূল্য ৩৩২ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।

টিআইবির এই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে ওয়াসার এমডি বলেন, ঢাকা শহরে বসবাসরত এক কোটি ৭২ লাখ লোক সবাই পানি ফুটিয়ে পান করেন না। ফুটানোর প্রয়োজনও পড়ে না। ওয়াসার এমডির স্বাক্ষরিত গতকাল জমা দেওয়া প্রতিবেদনে ঢাকার ১০টি জোনের ৫৭টি এলাকায় ময়লা পানির তথ্য উঠে আসে।

গত তিন মাসে ওয়াসা তাদের হটলাইনে (১৬১৬২) এ পানি নিয়ে ওই ৫৯ এলাকা থেকে অভিযোগ পায়। সেসব এলাকা উল্লেখ করে ১৩ মে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এ প্রতিবেদন দেয় ওয়াসা। গতকাল ওয়াসার এমডির এ প্রতিবেদন রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টে উপস্থাপন করে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, তিন মাসে ২৯২ জন গ্রাহকের অভিযোগের মধ্যে ঢাকার ১০টি জোনের ৫৭টি এলাকার পানি সবচেয়ে দূষিত বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জোনগুলো হলো- ১ নম্বর জোন যাত্রাবাড়ী, বাসাবো, মুগদা, রাজারবাগ, কুসুমবাগ, জুরাইন, মানিকনগর, ধোলাইরপার ও মাতুয়াইল; ২ নম্বর জোন ভাগলপুর, লালবাগ, বকশীবাজার ও শহীদনগর; ৩ নম্বর জোন জিগাতলা, ধানমন্ডি, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, ভূতের গলি ও মোহাম্মদপুর; ৪ নম্বর জোন শেওড়াপাড়া, পীরেরবাগ, মনিপুর, পাইকপাড়া, কাজীপাড়া ও মিরপুর; ৫ নম্বর জোন মহাখালী ও তেজগাঁও; ৬ নম্বর জোন সিদ্ধেশ্বরী, শাহজাহানপুর, খিলগাঁও, মগবাজার, নয়াটোলা, রামপুরা, মালিবাগ ও পরিবাগ; ৭ নম্বর জোন কদমতলী, দনিয়া, শ্যামপুর, রসুলবাগ, মেরাজনগর, পাটেরবাগ, শনির আখড়া, কোনাপাড়া ও মুসলিমনগর; ৮ নম্বর জোন বাড্ডা, আফতাবনগর, বসুন্ধরা ও ভাটারা; ৯ নম্বর জোন উত্তরা, খিলক্ষেত, সায়েদাবাদ, মোল্লারটেক ও রানাগোলা এবং ১০ নম্বর জোন কাফরুল, কাজীপাড়া, মিরপুর, কচুক্ষেত ও পল্লবী। অন্যদিকে হাইকোর্টের আদেশে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি প্রতিবেদন দিয়ে বলেছে, উল্লিখিত ১০টি জোনের প্রত্যেক এলাকা থেকে ৩৫৫টি নমুনা সংগ্রহ করা হবে।

এসব নমুনা তিনটি ল্যাবরেটরিতে রোগজীবাণু ও ভৌত রাসায়নিক সংক্রান্ত পরীক্ষা করতে খরচ হবে ৭৫ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা। আদালতে স্থানীয় সরকারের পক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু। রিটকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ। অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম মাসুম।

শুনানিতে তানভীর আহমেদ বলেন, সম্প্রতি ঢাকা ওয়াসার এমডি তাদের পানি শতভাগ সুপেয় বলে দাবি করেন। কিন্তু এখন তার স্বাক্ষরিত যে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করেছেন তাতে দেখা যাচ্ছে ৫৭টি এলাকার পানি বেশি দূষিত। তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় এমডির বক্তব্য স্ববিরোধী। এর আগে তার বক্তব্য নিয়ে জনমনেও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

তিনি এ সময় ওয়াসার এমডি যেন আর বিভ্রান্তিকর বক্তব্য গণমাধ্যমে না দেন সে বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞাও চান। এ সময় আদালত বলেন, এমডির যে বক্তব্য তার জন্য কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে তার দায়-দায়িত্ব তাকেই নিতে হবে। আদেশের পর রিটকারী তানভীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, পানি পরীক্ষার জন্য ৭৫ লাখ টাকা খরচ হবে বলে মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়। এ ব্যাপারে আদালত এক্সপার্ট মতামত গ্রহণ করার কথা জানিয়েছেন।

যেন খরচ আরো কমানো যায় কিনা। এ জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে গঠিত কমিটির সদস্যদের মধ্য থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাবিতা রিজওয়ানা রহমানকে ২১ মে আদালতে আসতে বলা হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার সরবরাহ করা পানিতে ব্যাকটেরিয়াসহ নানা ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে উল্লেখ করে গত বছর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। পরে ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ওই বছরের ১৪ অক্টোবর হাইকোর্টে জনস্বার্থে রিটটি করেন আইনজীবী তানভীর আহমেদ।

পরে ওই রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ৬ নভেম্বর রুল জারির পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসার পানি পরীক্ষার জন্য পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠনের আদেশ দেন। রুলে নিরাপদ পানি সরবরাহে কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও নিষ্ক্রিয়তাকে কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। চার সপ্তাহের মধ্যে স্থানীয় সরকার সচিব, স্বাস্থ্য সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, ওয়াসার এমডিসহ রিটে উল্লিখিত আট বিবাদীকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়। পরে হাইকোর্টের আদেশ অনুযায়ী স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক করে ১৮ এপ্রিল একটি কমিটি গঠন করা হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল হাইকোর্টে ওই কমিটির দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘নমুনা সংগ্রহ করে তার নির্দিষ্ট পরীক্ষার পর বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করতে একটি তহবিলের পাশাপাশি ল্যাবরেটরিসহ ঢাকা ওয়াসার সামগ্রিক প্রচেষ্টা দরকার। এসব কাজের জন্য যদি তহবিল গঠনও করা হয় এবং বিরতিহীনভাবে ওয়াসার তিনটি ল্যাবরেটরিতে একযোগে কাজ করলে এ প্রতিবেদন তৈরি করতে কমপক্ষে চার মাস সময় প্রয়োজন।’

ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির দাবিতে আন্দোলন করে আলোচনায় আসা মিজানুর রহমান এ বিষয়ে বলেন, কেবল রাজধানীর ৫৭ এলাকায় পানি দূষিত বিষয়টি এমন নয়। রাজধানীর প্রায় সব এলাকার পানিই দূষিত।

ওয়াসার বিশুদ্ধ পানির দাবিতে আন্দোলন করে আলোচনায় আসা মনিরুল ইসলাম ফরাজী এবিষয়ে বলেন, রাজধানীর কোথায়ও শতভাগ সুপেয় পানি নেই। ওয়াসার এমডির দাবি শুধু পুরো রাজধানীবাসী নয় পুরো দেশবাসী প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি তার দ্রুত পদত্যাগ দাবি করছি।

এমআই