রোহিঙ্গাদের নিরানন্দ ঈদ

রোহিঙ্গাদের নিরানন্দ ঈদ

উদাস চোখে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন রোহিঙ্গারা। বুধবার (৫ জুন) সকাল ৮টায় কক্সবাজারের টেকনাফের লেদা রোহিঙ্গা শিবিরে ছোট-বড় ১০টি মসজিদে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। একইভাবে কক্সবাজারের আরও ৩০টি রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদের জামাত হয়েছে। এসব জামাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া লাখো রোহিঙ্গা অংশ নেন। এসব রোহিঙ্গারা ঈদের নামাজ শেষে মোনাজাতে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারা নির্যাতনের বিচায় চেয়ে ও স্বদেশে মর্যাদার সঙ্গে নিরাপদ প্রত্যাবাসনের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন।

সরেজমিনে ঈদের দিন কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন শিবির ঘুরে দেখা গেছে, শিশুরা সকাল থেকেই নিজের পরিষ্কার জামা-কাপড় পরে সেজেগুজে ক্যাম্পের রাস্তায় হৈ-হুল্লোড় আর আনন্দে মেতে উঠে। রোহিঙ্গাদের অনেককে নতুন জামা, গেঞ্জি , লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি ও চশমা পরে দল বেঁধে শিবিরে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে। রোহিঙ্গা কিশোরীরাও নিজেদের সাজানোর চেষ্টা করেছেন মনের মতো করে।

তবে রোহিঙ্গা পরিবারগুলোর মধ্যে বর্ষীয়ানদের মধ্যে ছিল স্বজনহারানোর আক্ষেপ আর হতাশা। অনেককে যন্ত্রণায় কাদঁতে দেখো গেছে। কেন না অতীতে যাদেরকে নিয়ে ঈদ করেছিলেন, এবার তারা অনেকেই শুধু স্মৃতি।

নতুন জামা পরে বেড়াতে বের হওয়া রোহিঙ্গা শিশু আনেয়ার হোসেন (১০) ও মোহাম্মদ জোবাইরের (১২) সঙ্গে কথা হয়। তারা জানায়, আজ তারা সারাদিন ঘুরে বেড়াবে। আইসক্রিম আর চকলেট খাবে, দোলনা চড়বে।

রোহিঙ্গা শিবিরের আশপাশের কয়েকটি জায়গায় নাগরদোলা, চড়কিসহ মিনি মেলা বসতে দেখা গেছে। এর আয়োজক মোহাম্মদ কামাল (৩৫) জানান, এই মেলা কমপক্ষে তিন দিন থাকবে। গত বছরের তুলনায় শিশুরা এই বছর বেশি আনন্দ করছে।

২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট কোরবানি ঈদের মাত্র কয়েকদিন আগে রোহিঙ্গাদের বিদ্রোহী সংগঠন আরসা রাখাইনের ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায় বলে অভিযোগ উঠে। প্রতিক্রিয়ায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নমূলক অভিযান শুরু করে। নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন। বর্তমানে পুরনোসহ উখিয়া ও টেকনাফের ৩০টি শিবিরে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন। তবে বহিরাগমন বিভাগ ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সূত্র মতে এ পর্যন্ত ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৫৪ জন রোহিঙ্গার নিবন্ধন শেষ হয়েছে।

বুধবার সকালে টেকনাফের জাদিমুড়া রোহিঙ্গা শিবিরে কথা হয় মিনারা বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, খুব কাছ থেকে দেখেছি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস রূপ। চোখের সামনেই সেনারা গুলি করে হত্যা করেছে স্বামী ও দুই ভাইকে। ঘরে আগুনে লাগিয়ে হত্যা করা হয় পাশের বাড়ির এক পরিবারকে।

ঈদের দিনটা কেমন কাটছে জানতে চাইলে, সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা বলে কেঁদে ফেলেন মিনারা। যে দেশে জন্ম, বেড়ে ওঠা, সেই দেশেই ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার মিনারা জানান, স্বজন হারানোর বেদনা ঈদের দিনে আরও বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। মিয়ানমারে ঈদে তার স্বামী-সন্তানদের সাজিয়ে-গুছিয়ে ঈদের জামাতে গিয়েছিলেন, আজ তারা নেই। সময়ের ব্যবধান দুই বছরেরও কম। কত বিভীষিকাময় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে তাদের এইটুকু সময়ে।

মংডুর জামবুনিয়া রাঙ্গাবালি গ্রামের বিধবা ছকিনা খাতুন দীর্ঘশ্বাস ফেলছিলেন বারবার। জানালেন, রাখাইন প্রদেশে বসবাস করলেও নাগরিকত্ব মেলেনি। তারপরও সন্তান ও নাতি-নাতনি নিয়ে সুখে-দুঃখে কেটে যাচ্ছিল জীবন। কিন্তু স্বজন হারিয়ে এখন কোনও আনন্দই আর তাকে স্পর্শ করে না। তার কাছে প্রতিটি দিনই বিচ্ছেদ আর বেদনার দিন।

নির্যাতনের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে আসাদের অনেকেরই অবস্থা একসময় ভালো ছিল। এখন এই শিবিরের দুঃসহ জীবনের মধ্যে অতীতের সুখের স্মৃতি তাদের কষ্ট দেয়। এদেরই একজন রোহিঙ্গা আলী জোহার।

তিনি বলছিলেন, ‘২৫ বছর ধরে রাখাইন রাজ্যে বিশাল আয়োজনের মাধ্যমে ঈদ পালন করেছি। ঈদের সময় গ্রামের লোকজন ঘরে এসে সেমাই ও চালের রুটির সঙ্গে রান্না করা গরুর মাংস খেয়েছে। আর এখন সেমাইর জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এটা বড়ই লজ্জার বিষয়।’ ২০১৭ সালে ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সেনাদের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে নিজের সহায় সম্বল রেখে এপারে পালিয়ে আসেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, প্রিয় জন্মভূমিতে সত্যিই ফেরা হবে কিনা এমন সংশয় রয়ে গেছে। এই দেশে বোঝা হয়ে দিনের পর দিন থাকতে হবে, জানি না ফিরে পাবো কিনা হারানো ঈদের সুখের দিনগুলো?

টেকনাফের লেদা শিবিরের ডেভেলপমেন্ট কমিটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশ সরকার অনেক কিছু করেছে। তারপরও আমরা অসহায় হয়ে আর কতদিন এই দেশের বোঝা হয়ে থাকবো? জানি মিয়ানমার সেনারা হাজারো রোহিঙ্গা সদস্যকে হত্যা করেছে। তারপরও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের স্বদেশ, তাই আমরা ফিরতে চাই। তবে রোহিঙ্গাদের যেসব শর্ত রয়েছে, তা মানলেই সবাই ফিরে যাবো।’

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ রবিউল হাসান বলেন, ‘শান্তিপূর্ণভাবে সব রোহিঙ্গা শিবিরে ঈদের নামাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঈদে উপলক্ষে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’