নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ : আসিফ নজরুল

নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ : আসিফ নজরুল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, দেশে একের পর এক হত্যা, গুম ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। কিন্তু এসব বন্ধে সরকারের ভূমিকা বরাবরের মতোই প্রশ্নবিদ্ধ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নির্যাতন বিরোধী কনভেনশন এবং এর পাশাপাশি আরো অনেক আন্তর্জাতিক চুক্তির সদস্য রাষ্ট্র যেখানে নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও এদেশে নির্যাতন নির্মূলে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৩১, ৩২ ও ৩৫)। নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ও সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। এসবের পরও নির্যাতন বন্ধে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ।

আজ বুধবার সকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) মিলনায়তনে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘নির্যাতন রোধের দায় দায়িত্ব’ শীর্ষক আলোচনায় মূল প্রবন্ধে তিনি একথা বলেন।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন, শিরিন হক, অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম, র‌্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির ছাত্র লিমন হোসেন, ঢাবির কোটা বিরোধী আন্দোলনের নেতা আতাউল্লাহ প্রমুখ। বিভিন্ন সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

ড. আসিফ নজরুল তার লিখিত প্রবন্ধে আরো বলেন, নির্যাতন সম্পূর্ণভাবে একটি বেআইনি কাজ এবং কোনো পরিস্থিতিতে এটি গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিসঙ্ঘ ২৬ জুন দিনটিকে নির্যাতিতদের সমর্থনে আন্তর্জাতিক সংহতি দিবস হিসেবে পালন করে। এর লক্ষ্য হচ্ছে নির্যাতনকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা এবং ১৯৮৪ সালের নির্যাতন বিরোধী কনভেনশন যথাযথভাবে কার্যকর করা।

তিনি আরো বলেন, ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ‘নির্যাতন বিরোধী কনভেনশনের’ (নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অমর্যাদাকর আচরণ ও শাস্তির বিরুদ্ধে চুক্তি) সদস্য হয়। কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ১৪-এ বলা আছে যে, প্রত্যক রাষ্ট্র তার আইন ব্যবস্থায় এটি নিশ্চিত করবে যে, নির্যাতনের শিকার ব্যক্তি বা তার পরিবার উপযুক্ত প্রতিকার এবং পরিপূর্ণ পুনর্বাসনসহ ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশ চুক্তিটির পক্ষ হওয়ার সময় একটি ঘোষণা দিয়ে জানিয়ে দেয় যে, বাংলাদেশ এই অনুচ্ছেদটি তার নিজস্ব আইন অনুসারে প্রয়োগ করবে। বাংলাদেশের এই ঘোষণা চুক্তিটির দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া হিসেবে তখনি আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়।

নির্যাতন বিরোধী কনভেনশন বা চুক্তিটির প্রতি বাংলাদেশের অনান্তরিক মনোভাব ফুটে উঠে এই চুক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নজরদারী পদ্ধতিগুলো এড়িয়ে যাওয়ার মধ্যে। বাংলাদেশের দায়িত্ব ছিল চুক্তির পক্ষ হওয়ার এক বছরের মধ্যে (এবং এরপর প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর) একটি প্রতিবেদন কনভেনশনটির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত নির্যাতনবিরোধী কমিটির কাছে জমা দেয়া। চুক্তির পক্ষ হওয়ার ২১ বছর অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত প্রথম প্রতিবেদনটিই জমা দেয়নি।

নির্যাতনবিরোধী চুক্তিতে কোনো সদস্য রাষ্ট্রের উপর নজরদারীর জন্য আরো তিনটি পদ্ধতি রয়েছে। এরমধ্যে অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্র (অনুচ্ছেদ ২১) এবং বা নিজ রাষ্ট্রের কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে (অনুচ্ছেদ ২২) কমিটির কাছে অভিযোগ করার সুযোগ দেয়ার জন্য সদস্য রাষ্ট্রকে আলাদাভাবে সম্মতিমূলক ঘোষণা দিতে হয়। বাংলাদেশ একটি ঘোষণাও দেয়নি।

বাংলাদেশে নির্যাতন বন্ধ করার জন্য শক্তিশালী সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি রয়েছে, বিচারিক সিদ্ধান্ত আছে এবং বাংলাদেশ ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ করার জন্য একটি আইন করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই আইনে কারো শাস্তি হয়নি, এমনকি এই আইনে মামলা দিতে গেলেও নানা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। যদিও আইনটিতে বিধান রয়েছে ১২০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করার, কিন্তু এই আইনের অধীনে দায়েরকৃত প্রথম মামলাটিরই নিষ্পত্তি হয়নি গত পাঁচ বছরেও। আরেকটি মামলা বাতিল হয়েছে স্বয়ং সেশন কোর্টের নির্দেশে। এছাড়া বহু নির্যাতনের ঘটনার শিকাররা আদালতে মামলা করার সাহস পাননি এই আইনের অধীনে।

অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত প্রবন্ধে বেশ কিছু পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশও তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে,

এক. নির্যাতন বিরোধী কনভেনশন সম্পূর্ণভাবে মেনে চলা : বাংলাদেশের উচিত কনভেনশনের ১৪ অনুচ্ছেদ সংক্রান্ত বাংলাদেশের ঘোষণা তুলে নেয়া এবং নিয়মিত রিপোর্ট জমা দেয়ার পাশাপাশি এই চুক্তির অন্যান্য বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা।

দুই. বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়ন : নির্যাতন বন্ধে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের উচিত এটি আদালত অবমাননা হিসেবে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের নজরে আনা। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশনাটি মেট্রোপলিটন এলাকার অর্ডিন্যান্সের ক্ষেত্রেও (যেমন: দ্যা ঢাকা মেট্রোপলিটন অর্ডিন্যান্স-১৯৭৬, ধারা ৮৬ ) প্রয়োগের বিষয়টি তাদের নজরে আনা।

তিন. নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর সংষ্কার : ব্লাস্ট এই আইনে সংজ্ঞার সমস্যা, পদ্ধতিগত বিভিন্ন ত্রুটি, পর্যাপ্ত দণ্ডের অভাব এবং নির্যাতিতদের সুরক্ষার অভাবসহ বিভিন্ন বিষয় তাদের একটি প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে হবে এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে আরো কাজ করতে হবে।

চার. নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর বাস্তবায়ন : এই আইনের বাস্তবায়ন জোরদার করার প্রায়োগিক সমস্যা নিয়ে মন্ত্রণালয়, মানবাধিকার কমিশন এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে গবেষণা করতে হবে। বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ ও অন্যান্য অংশীজনদের প্রশিক্ষণে এই আইন অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

পাঁচ. সচতেনতা : নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং সংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে এ ব্যাপারে নেতৃত্ব দিতে হবে।

এমজে/