সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

সারাদেশে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি

উজানে ভারী বর্ষণের কারণে দেশের নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ২৩টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অন্তত দশ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র শনিবার এসব তথ্য জানিয়েছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং সংলগ্ন ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের বিস্তৃত এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

এছাড়া উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সংলগ্ন ভারতের বিহার এবং নেপালে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।

এদিকে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে যমুনা নদীর বাধ ভেঙে ১২টি গ্রামে বিস্তৃণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। প্রচণ্ড স্রোতে ভেসে গেছে বাড়িঘর ও কৃষকের পাটের জাগ।

দেওয়ানগঞ্জ প্রতিনিধি পাঠানো খবরে জানা যায়, দেড় কিলোমিটার বাধে ফাটল দেখা দিয়েছে।

স্থানীয়রা জানান, যমুনার নদীতে বন্যা রক্ষায় কোনো বাঁধ নেই। বাহাদুরাবাদ ঘাটে পরিত্যাক্ত রেললাইন থাকায় এখান দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারত না।

এ রেলপথকেই স্থানীয় লোকজন যমুনা নদীর বাঁধ হিসেবে বলে থাকে। রেলপথে ছোট ছোট কয়েকটি ব্রিজ কালভার্ট ছিল পানি যাতায়াতের জন্য এ বছর কালভার্টগুলোর মুখ মাটি দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় যমুনা নদীর প্রচণ্ড চাপে রাত ৯টার দিকে গুজিমারী স্থানে বাঁধ ভেঙে যায়।

আওয়ামী লীগ নেতা শফিউল হক মান্না বলেন ইউএনও ছোট ছোট কালভার্টের মুখগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় বাধ ভেঙে গেল।

চুকাইবাড়ী ইউপি সদস্য নাদু মিয়া সাবেক কাউন্সিলর রঞ্জ জানান, বাঁধে ২ শতাধিক পরিবার রয়েছে।

পুরো রেলপথ বাঁধটি ফাটল আর ইঁদুরের গর্ত দেখা গেছে। বাঁধে আশ্রিত লোকদের মাঝে আতংক দেখা দিয়েছে। পৌর এলাকার ৮নং ওয়ার্ডের গুজিমারী, ডাকরাপাড়া, দাসপাড়া, মোল্লাপাড়া, চুকাইবাড়ী ৬ নং ওয়ার্ডের চুকাইবাড়ী, গুচ্ছগ্রাম বালুগ্রাম, রেললাইন হরিণধরা, চাকুরিয়া, নিশানখালি, জিগাতলা, ব্রিজসহ আশপাশ ১২টি গ্রাম তলিয়ে গেছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা জানান, ভাঙন কবলিত এলাকা দেখতে যাব।

প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এনামুল হক হাসান জানান, দেওয়ানগঞ্জ পৌরসভা সহ ৮টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। দূর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০ মেট্রিকটন চাউল ও ৫০ হাজার বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, দেওয়ানগঞ্জে বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্ট দুপুরে ৫৬ সে.মি পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপৎসীমার ৪৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এছাড়া মনু ও ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জানা গেছে। মৌলভীবাজার প্রতিনিধির পাঠানো খবরে জানা যায়, ভারতে টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মনু নদী ও কমলগঞ্জে ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধগুলো ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। অনেক ঝুকিপূর্ণ প্রতিরক্ষা বাঁধ রক্ষায় গ্রামবাসী চেষ্টা করছেন।

ধলাই নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ২০ মিটার ভেঙে কমলগঞ্জ পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের রামপাশা এলাকাসহ আরো কয়েকটি এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

মনু নদীর কুলাউড়া অংশে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ও মৌলভীবাজার চাঁদনীঘাটে বিপৎসীমার ৩৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। আর ধলাই নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

মনু ও ধলাই নদীর ৫৬টি প্রতিরক্ষা বাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। তবে বাঁধগুলো রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড কাজ করে যাচ্ছে।

এদিকে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তথ্য কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী তথ্যটি নিশ্চিত করে জানান, বৃষ্টি না হলে মনু নদীর নিম্নাঞ্চলে পানি বাড়বে। তবে বন্যা মোকাবেলায় আমরা তৎপর। এছাড়া জনসাধারণকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়েছে।

ব্রহ্মপূত্র-ধরলা-তিস্তা-দুধকুমোর নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে প্রবাহিত হওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

অন্যদিকে কুড়িগ্রামে ধরলা, ব্রহ্মপূত্র, তিস্তা ও দুধকুমোর নদীর পানি শনিবার দুপুরে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে এ চারটি নদের অববাহিকার চর-দ্বীপচর ও নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় কমপক্ষে ২০ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।

ব্রহ্মপূত্র নদের অববাহিকায় যাত্রাপুর, ঘোগাদহ, হাতিয়া, বুড়াবুড়ি, চিলমারী ও নয়ারহাট এলাকায় ৭ হাজার পরিবারের বসতবাড়ী তলিয়ে গেছে বলে নিশ্চিত করেছেন সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তিস্তা এলাকায় নাজিমখান,বিদ্যানন্দ ও ঘড়িয়ালডাঙ্গা এলাকায় ২হাজার বাড়ীঘর প্লাবিত হয়েছে। রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের চতুরা এলাকায় গত এক সপ্তাহে ১২০টি বাড়িঘর বিলীন হয়েছে।

এখানে স্কুল, বাজার, মাদ্রাসা, মসজিদ ও মন্দিরের ভাঙন ঠেকাতে ৫ হাজার জিও ব্যাগ দেয়া হলেও তীব্র ভাঙন ঠেকাতে হিমসিম খাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।

কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুল ইসলাম জানান, কুড়িগ্রাম জেলার ছোটবড় ১৬টি নদ-নদীর মধ্যে ধরলা’য় ৫২সে.মি, ব্রহ্মপূত্র নদে ৩৯ সে.মি, তিস্তা’য় ৯ সে.মি ও দুধকুমোর নদীর পানি বিপৎসীমার ৭সে.মি উপর দিয়ে শনিবার দুপুর থেকে প্রবাহিত হচ্ছিল। ফলে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। ভাঙন দেখা দিয়েছে, সারডোবে ধরলা নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। চিলমারীর নয়ারহাট ও অষ্টমীরচর ইউনিয়নের কয়েকটি চরে নদী ভাঙনে ৫০টি পরিবার গৃহহীন হয়েছে।

রৌমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপঙ্কর রায় জানান, বন্দবের ইউনিয়নের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৩০০মি. ভেঙে গেছে। এছাড়া যাদুরচর ইউনিয়নে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ৫টি স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এসব এলাকার ৫০টি পরিবারকে নিরাপদ স্থানে সড়িয়ে নেয়া হয়েছে। আর ২৮টি পরিবারকে ঘর নির্মানের জন্য ঢেউটিন ও শুকনা খাবার সরবরাহ করা হয়েছে।

কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) হাফিজুর রহমান জানান, বন্যা মোকাবেলায় আমাদের পূর্ব প্রস্তুতি রয়েছে।

ইতিমধ্যে বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোয় ৫০ মে.টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও দেড়শ টন চাল ও তিন লক্ষ টাকা মজুদ রয়েছে।

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতর ও ভারত আবহাওয়া অধিদফতরের তথ্য দিয়ে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং সংলগ্ন ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গের উওরাঞ্চল, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের বিস্তৃত এলাকায় আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় মাঝারি থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও অতি ভারী বৃষ্টিপাতের আশংকা রয়েছে।

এতে বলা হয়, আগামী ৭২ ঘণ্টায় সব প্রধান নদ-নদীর পানি সমতলে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকতে পারে এবং আগামী ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদী সারিয়াকান্দি এবং কাজিপুর পয়েন্ট বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম, সিলেট ও রংপুর বিভাগের সুরমা, কুশিয়ারা, কংস, সোমেশ্বরী, ফেনী, হালদা, মাতামুহুরী, সাঙ্গু, ধরলাসহ প্রধান নদীগুলোর পানি সমতলে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে।

এছাড়াও আগামী ২৪ ঘণ্টায় নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, গাইবান্ধা জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে।