চার গুদাম সিলগালা

সরকারি গুদামে ঢুকছে নিম্নমানের চাল

সরকারি গুদামে ঢুকছে নিম্নমানের চাল

সরকারের বিভিন্ন খাদ্যগুদামে নিম্নমানের চাল কেনার অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, বিভিন্ন জেলায় মিলারদের (চালকল মালিক) যোগসাজশে খাদ্য অধিদফতরের একশ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা মানহীন চাল মজুদ করছেন।

সূত্র জানায়, নিম্নমানের চাল মজুদের অভিযোগে চলতি মাসেই ময়মনসিংহ ও বগুড়ার শান্তাহার সিএসডি’র (সেন্ট্রাল স্টোরেজ ডিপো) ৪টি গুদাম সিলগালা করেছে খাদ্য অধিদফতর। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের নির্দেশে এসব ঘটনা তদন্তে একটি কারিগরিসহ মোট ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

আরও জানা গেছে, ধীরগতিতে সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা ও নিম্নমানের চাল কেনায় ক্ষুব্ধ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা। নিম্নমানের চালের খবর পেলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কঠোর নির্দেশনাও রয়েছে সংশ্লিষ্টদের প্রতি।

যেসব গুদামে নিম্নমানের চাল কেনার খবর পাওয়া গেছে সেখানেই ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন খাদ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা। কিন্তু যেসব গুদামে নিম্নমানের চাল কেনা হচ্ছে, সেগুলোর সব খবর খাদ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরের কাছে পৌঁছায় না। এর পেছনে একটি সিন্ডিকেট জড়িত।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার যুগান্তরকে বলেন, ‘সব সময়ই একটি অশুভ চক্র নিম্নমানের চাল সরকারি গুদামে দিতে চায়। এর সঙ্গে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীও জড়িত থাকে। তবে যখনই খবর পাচ্ছি, তখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। এসব অপকর্ম করে কেউ রেহাই পাবে না।

ময়মনসিংহে আমি নিজে গুদাম পরিদর্শন করে খারাপ মানের চাল থাকায় দুটি গুদাম সিলগালা করে দিয়েছি। বগুড়ার সান্তাহরেও দুটি গুদাম সিলগালা করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে নিশ্চয় দোষী ব্যক্তিরা শনাক্ত হবে।’

জানা গেছে, চলতি মাসের প্রথমদিকেই বগুড়ার সান্তাহার সিএসডিতে নিম্নমানের চাল কেনার খবর পান খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। মন্ত্রীকে জানানো হয়, শান্তাহার সিএসডিতে কয়েকজন মিলার নিম্নমানের চাল সরবরাহ করছে। বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দেন খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. নাজমানারা খানুমকে।

ডিজি তাৎক্ষণিক খাদ্য অধিদফতরের উপপরিচালক মামুন আল মোর্শেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে সান্তাহারে পাঠান। কমিটির অপর দুই সদস্য হচ্ছেন ময়মনসিংহে সংযুক্ত সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক ফজলে রাব্বী হায়দার এবং খাদ্য অধিদফতরে সংযুক্ত রাঙ্গামাটির সহকারী খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাহমুদুল হাসান।

তদন্ত কমিটি ২ থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত শান্তাহার সিএসডিতে সরেজমিন তদন্ত করেন। সেখানে গিয়ে তদন্ত কমিটি গুদামে নিম্নমানের চাল হাতেনাতে আটক করে। শুধু গুদামেই নয়, গুদামে ঢোকানোর জন্য যেসব ট্রাক দাঁড়িয়ে ছিল সেগুলোও পরীক্ষা করে নিম্নমানের চাল খুঁজে পান তারা। যে পরিমাণ চাল মজুদ থাকার কথা সেখানেও ঘাটতি পেয়েছে তদন্ত দল।

খাদ্য অধিদফতরে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশের ১২টি সিএসডির মধ্যে বগুড়ার সান্তাহার সিএসডি অন্যতম। এই সিএসডিতে মোট ৬৯টি গুদাম রয়েছে। এসব গুদামের ধারণ ক্ষমতা ৬২ হাজার ৫০০ টন। সিএসডির ৬৩ নম্বর গুদামের ১টি খামাল এবং ৭৫ নম্বর গুদামের ২টি খামালে নিম্নমানের চাল পাওয়া গেছে।

৬৩ নম্বর গুদামের চাল প্রাপ্তির এবং ৭৫ নম্বর গুদামের চাল সংগ্রহ ও প্রাপ্তি দুটোরই। বিভিন্ন গুদামে ৮২ বস্তা চাল কাগজে-কলমে থাকলেও গুদামে নেই। গুদামটিতে দুই ধরনের চাল রয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া সংগ্রহ এবং নিজেদের সংগ্রহ। চলতি বোরো মৌসুমে ২ হাজার ২০০ টন চাল এই সিএসডির নিজস্ব উদ্যোগে কেনা হয়েছে।

নষ্ট চালের বেশির ভাই চলতি মৌসুমে কেনা। নিম্নমানের চাল যে দুটি গুদামে পাওয়া গেছে সেগুলো সিলগালা করে দিয়েছে তদন্ত কমিটি। ইতিমধ্যে তদন্ত কমিটির প্রাথমিক প্রতিবেদন দাখিল করেছে।

এটি পাওয়ার পর খাদ্য অধিদফতর বিস্তারিত তদন্ত করে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও দায়ী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিত করার জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের সমন্বয়ে ৭ সদস্যের একটি কারিগরি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির প্রধান করা হয়েছে খাদ্য অধিদফতরের উপপরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন) আমিনুল এহসানকে।

সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা এখনও তদন্ত শুরু করিনি। কমিটির সবার সঙ্গে কথা আনুষ্ঠানিক বৈঠক করে শিগগিরই তদন্ত শুরু করব।’

অভিযোগ উঠেছে, সান্তহারের ঘটনা তদন্তে কারিগরি কমিটির গঠনের খবর পেয়ে ঘটনা ধামাচাপা দিতে একটি চক্র উঠেপড়ে লেগেছে। সিএসডির ম্যানেজার এমদাদুল ইসলাম শিকদার বিভিন্ন দফতরে তদবির শুরু করেছেন। রোববার বিষয়টি নিয়ে খাদ্য অধিদফতরের ডিজির সঙ্গে দেখা করেছেন।

এ সময় ডিজি দাফতরিক ছুটি না নিয়ে ঢাকায় এসে তদবির করার কারণে ম্যানেজারকে ভর্ৎসনা করেছেন বলে খাদ্য অধিফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শান্তাহার সিএসডির ম্যানেজার এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘শান্তাহার একটি বড় সিএসডি।

এখানে ২৫ লাখ বস্তা খাদ্যশস্য মজুদ রয়েছে। সব বস্তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে গুদামে ঢোকানোর মতো লোকবল নেই। গুদামে নিম্নমানের চাল থাকার অভিযোগ উঠেছে। এটা তদন্তসাপেক্ষ বিষয়। নিরপেক্ষ তদন্ত হলে সব জানা যাবে।’

সরকারি গুদামে নিম্নমানের চাল ঢুকছে, নজরদারির অভাব কিনা- জানতে চাইলে রাজশাহী আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক (আরসি ফুড) মনিরুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘শান্তাহার দেশের একটি বড় সিএসডি। এখানে রয়েছে ২৫ লাখ বস্তা খাদ্যশস্য। প্রতিটি বস্তা দেখে দেখে গুদামে প্রবেশ করানো অসম্ভব।

তাছাড়া প্রয়োজনীয় লোকবলও থাকতে হবে। শান্তাহারে কোনো অনিয়ম হয়ে থাকলে তদন্তেই তা বের হয়ে আসবে।’ শান্তাহার সিএসডির ম্যানেজার এমদাদকে কোনো ছুটি দেননি বলেও জানান তিনি।

এর আগে ৩ জুলাই খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ময়মনসিংহ ও গাজীপুর জেলার বিভিন্ন খাদ্যগুদাম ঝটিকা পরিদর্শনে যান। ওই সময় ময়মনসিংহ সিএসডির দুই ও ৪৮ নম্বর গুদামের চালের মান খারাপ হওয়ায় গুদাম দুটি তাৎক্ষণিকভাবে সিলগালা করার নির্দেশ দেন মন্ত্রী।

এ ঘটনা তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় খাদ্য অধিদফতরের পরিচালক (প্রশাসন) পরিমল কুমার সরকারকে। ওইদিন খাদ্যমন্ত্রী গাজীপুর জেলার জয়দেবপুর খাদ্যগুদাম পরিদর্শন করেন। জয়দেবপুরে এবার বোরো মৌসুমে ধানের বরাদ্দ ছিল ৯৬৮ টন। কিন্তু সংগ্রহ করা হয়েছে মাত্র ৫১ টন।

এরপর তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশালের ধানীখোলা খাদ্যগুদাম পরিদর্শন করেন। সেখানে দেখা যায় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ৫৩৬ টন। কিন্তু সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ১৭০ টন। ধান সংগ্রহের পরিমাণ কম হওয়ায় মন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

ময়মনসিংহ সদরের খাগডহর কেন্দ্রীয় খাদ্য সংরক্ষণাগার পরিদর্শনকালে ২ ও ৪৮নং গোডাউনের চালের মান কাঙ্ক্ষিত না হওয়ায় তিনি ব্যবস্থাপকের ওপর অসন্তোষ প্রকাশ করে গোডাউন ২টি সিলগালা করার নির্দেশ দেন।

এ সময় মন্ত্রী বলেন, ‘আপনারা আগে কি কি করেছেন তা আমি দেখতে চাই না, জানতেও চাই না। এখন থেকে সবাই দায়িত্ব বুঝে কাজ করবেন। কেউ দুর্নীতি বা অনিয়মের আশ্রয় নিলে বিপদে পড়বেন, কেউ রেহাই পাবেন না।’-যুগান্তর