সিলেটেও বেপরোয়া ছিলেন ডিআইজি মিজান

সিলেটেও বেপরোয়া ছিলেন ডিআইজি মিজান

ঢাকা, ৩০ জানুয়ারি (জাস্ট নিউজ) : আমার বাড়ির তৃতীয়তলায় ভাড়া থাকতেন ডিআইজি মিজান। কিন্তু সুন্দরী মেয়েসহ বিভিন্ন মডেল প্রায় তার বাসায় আসত। আশপাশের লোকজন এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলতেন। এমনকি পুলিশের কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তাও আমাকে নিষেধ করেন তাকে (মিজান) যেন আমি বাসা ভাড়া না দিই। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে ডিআইজি মিজানকে বাসা ছেড়ে দিতে অনুরোধ করি। এরপর তিনি বাসা ছেড়ে দিলেও প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে আমার লন্ডন প্রবাসী ছোট ভাইকে চাপ দিয়ে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হেনস্তা করার সব চেষ্টা করেন। তবে পুলিশের কিছু ভালো অফিসারের হস্তক্ষেপে সেই বিপদ থেকে রক্ষা পাই।

কিন্তু বাসা ভাড়া নিয়ে মেয়ে এনে ফুর্তির ঘটনায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। তার মতো একজন পুলিশ অফিসারের কাছে এমনটি কোনোদিনও আশা করিনি। ডিআইজি মিজান সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রতিবেদকের কাছে এভাবেই মন্তব্য করেন সিলেটের বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত উস্তার আলী। সিলেটে ডিআইজি থাকাবস্থায় উপশহরে তার বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন সম্প্রতি ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার পদ থেকে প্রত্যাহার হওয়া বহুল আলোচিত-সমালোচিত ডিআইজি মিজানুর রহমান।

প্রসঙ্গত, ‘তুলে নিয়ে বিয়ে করলেন ডিআইজি মিজান’ শিরোনামে ৭ জানুয়ারি যুগান্তরে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে পুলিশ সদর দফতরে প্রত্যাহার করা হয়। ১০ জানুয়ারি অতিরিক্ত আইজিপি (অর্থ) মইনুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।

এদিকে সুন্দরী মেয়েদের তুলে নিয়ে বিয়ে ও নির্যাতনের ঘটনায় পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রতিবেদকের কাছে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে বিস্তর তথ্য ও অভিযোগ আসতে থাকে। তার দ্বারা অন্যায়ভাবে নিগৃহীত পুলিশের অনেক পদস্থ কর্মকর্তাও তথ্যপ্রমাণ নিয়ে হাজির হন। এরপর দ্বিতীয় দফা অনুসন্ধানে নেমে সিলেটেও তার বিরুদ্ধে একাধিক নারী কেলেঙ্কারিসহ দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি খোদ পুলিশ কর্মকর্তারাও ছিলেন ডিআইজি মিজানের ভয়ে তটস্থ। কথায় কথায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি মোবাইলে কথা বলার অভিনয় করে অধীনস্থ কর্মকর্তাদের বিভ্রান্ত করতেন। এক সময় এসব নিয়ে ১৯টি অভিযোগ উল্লেখ করে নামে-বেনামে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পুলিশ সদর দফতরে বিভিন্ন অভিযোগও করা হয়। কিন্তু এসবের কোনোটাই তদন্ত হয়নি। বেনামি অভিযোগ তদন্ত করার বিধান না থাকায় বিপাকে পড়েন ভুক্তভোগীরা। অভিযোগ সত্য হলেও অনেকে ভয়ে নাম-পরিচয় প্রকাশ করার সাহস করেননি। এ সুবাদে রক্ষা পান ডিআইজি মিজান।

তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর থেকে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার ছিলেন মিজানুর রহমান। এরপর অতিরিক্ত ডিআইজি থেকে ডিআইজি পদে পদোন্নতি নিয়ে ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সিলেট রেঞ্জের ডিআইজির দায়িত্বে ছিলেন।

১৯ অভিযোগের প্রথমেই বলা হয়েছে, ডিআইজি মিজানুর রহমান সিলেট এসএমপিতে যোগদান করেই প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দেন। তিনি প্রায়ই আপা সম্বোধন করে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলছেন অথবা প্রধানমন্ত্রী তাকে ফোন করেছেন বলে সহকর্মীদের বোঝাতেন। এর সত্যতা নিশ্চিত করেন ওই সময়ে সিলেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে তিনি আপা বলার অভিনয় করতেন। এটি যে মিথ্যা অভিনয় তা তারা এক পর্যায়ে বুঝে যান। পরে তার এ রকম আচরণে অনেকে হাসাহাসি করতেন।

তিনি জানান, এসএমপির কমিশনার থাকাবস্থায় ২৫ লাখ টাকা সোর্সমানির প্রায় অধিকাংশই তিনি আত্মসাৎ করেছেন। এছাড়া টি ২০ বিশ্বকাপ খেলার সময় পুলিশের ডিউটি ভাতার এক কোটি টাকা একাই আত্মসাৎ করেন। এ নিয়ে সে সময় সাধারণ পুলিশ সদস্যদের মধ্যে এক রকম ক্ষোভ ও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়ে।

সোর্সমানি আত্মসাতের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, সোর্সমানির কোনো অডিট হয় না। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এ খাতের পুরোটাই তিনি পকেটস্থ করতেন।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো ১৯ অভিযোগের ৯ ও ১০ নম্বরে আছে নারী কেলেঙ্কারির চিত্র। এ বিষয়ে বলা হয়, তিনি (ডিআইজি মিজান) সিলেটে আসার পর পরিবার নিয়ে থাকার কথা বলে উপশহরের একটি বাসায় ওঠেন। কিন্তু পরিবার না এনে প্রায় প্রতি সপ্তাহে সেখানে তার বিশেষ মেহমান আসত। যাদের নিয়ে তিনি পার্টি দিতেন। দু-একজন পুরুষ সদস্য ছাড়াও বেশিরভাগ থাকতেন শোবিজের হাইপ্রোফাইল নায়িকা ও গায়িকা। যারা রাতের বেশিরভাগ সময় হৈচৈ করে পার করতেন। মাসের মধ্যে প্রায় দিন এ ধরনের নতুন নতুন পার্টি হতো।

অভিযোগের অপর এক স্থানে সুনির্দিষ্টভাবে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়ে বলা হয়, বিশ্বকাপ খেলার সময় একজন নারী এএসপিসহ আরও কয়েকজন তরুণী তার বাসায় গিয়ে ওঠেন। পরে তাদের নোহা মাইক্রোযোগে ডিআইজি মিজান (তৎকালীন সিলেটের পুলিশ কমিশনার) শ্রীমঙ্গলের গ্র্যান্ড সুলতান হোটেলে নিয়ে যান। সেখানে রাত কাটান। যাওয়ার সময় প্রাইভেট নোহা গাড়িটি একজন সার্জেন্ট রিকুইজিশন করে দেয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে ভোরে ফিরে আসার সময়। সারারাত আমোদ-ফুর্তি করে মাতাল হয়ে গ্র্যান্ড সুলতান থেকে আসার সময় মোগলাবাজার এলাকায় অন্য একটি প্রাইভেট গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ক্ষতিগ্রস্ত ওই গাড়ির মালিক নেমে এসে কমিশনার মিজানুর রহমানকে বহনকারী নোহা গাড়ির চালককে মারতে গেলে তিনি নিজে গাড়ি থেকে নেমে আসেন।

নিজের পরিচয় দিয়ে মিজানুর রহমান বলেন, আমি এসএমপির কমিশনার। এটা আমার গাড়ি। তখন গাড়ির মালিক তার দেয়া পরিচয় বিশ্বাস করেননি। জানতে চান, আপনি কমিশনার হলে আপনার সরকারি গাড়ি বা বডিগার্ড কই? এ নিয়ে বাদানুবাদ শুরু হলে মোগলাবাজার থানার ওসিকে ফোন করে আসতে বলেন। এর মধ্যে সেখানে আরও কিছু গাড়ি আটকে যায়। ওসির আসতে একটু দেরি হয়। পরে রুদ্ধশ্বাসে ওসি এসে পরিস্থিতি সামাল দেন।

এদিকে ঘটনাস্থলে আসতে দেরি হওয়ায় এবং রাস্তায় প্রটেকশন না থাকায় ওয়্যারলেসে ওসিকে ক্লোজ করার আদেশ দেন মিজানুর রহমান। ঘটনাটি ছিল ২০১৪ সালের ১৬ এপ্রিল। ওসি পরে দুই লাখ টাকা দিয়ে মিজানুর রহমানকে বলেন, স্যার পুলিশ প্রটেকশন ছিল, প্রাইভেট নোহা গাড়ি থাকায় চিনতে পারেনি। এরপর ক্ষমা চেয়ে ক্লোজের আদেশ প্রত্যাহার করান। ওই সময় মোগলাবাজার থানার ওসি ছিলেন বর্তমানে এসএমপির নানা কারণে সমালোচিত ইন্সপেক্টর মোরসালিন।

যোগাযোগ করা হলে মো. মোরসালিন বলেন, আমি তখন মোগলাবাজার থানায় ছিলাম না। এ রকম কোনো ঘটনা আমার জানা নেই।

অথচ মোগলাবাজার থানার ওসির অর্নার বোর্ডে দেখা গেছে, প্রথম দফায় ২০১২ সালের ৯ এপ্রিল থেকে ২০১৩ সালের ১০ জুলাই পর্যন্ত মোগলাবাজার থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ২০১৪ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে ২৯ মে পর্যন্ত ৪ মাস দ্বিতীয় দফায় দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ওই বছরের ২৯ মে থেকে একই বছরের ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত দক্ষিণ সুরমা থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করেন এই মোরসালিন। তবে ৫ মেয়েসহ গ্র্যান্ড সুলতান থেকে ফেরার পথে ভোরে দুর্ঘটনার কথা স্বীকার করেন ওই সময়ে কর্মরত একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, মোরসালিনকে সকালে মোগলাবাজার থেকে প্রত্যাহার করে বিকালে ওই আদেশই বাতিল করা হয়। আমাদের এ রকম আদেশ প্রায়ই করতে হয়েছে, যা সবাই জানেন।

তিনি বলেন, ওই মোরসালিন এখন ডিআইজি মিজানের পকেটে। সেদিনের ওই ঘটনা সম্পর্কে অস্বীকার করার কারণ জানতে চাইলে পুলিশের আরেকজন ইন্সপেক্টর বলেন, ডিআইজি মিজান যখন এসএমপির কমিশনার তখন তার ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ নিয়ে মানবজমিন পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি চৌধুরী মমতাজ ২০১৪ সালের ২১ জুলাই একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এরপর ১৯ আগস্ট সিলেটে বসবাসরত চাঁদপুরের এক তরুণী সিলেট কোতোয়ালি থানায় চৌধুরী মমতাজসহ দু’জনকে আসামি করে ধর্ষণ মামলা দায়ের করে। কোনোরকম তদন্ত ছাড়াই ওই মামলাটি রেকর্ডসহ সিলেটের প্রবীণ এই সাংবাদিককে গ্রেফতারও করা হয়।

তিনি বলেন, ২১ সেপ্টেম্বর মাত্র এক মাসের মাথায় এই মামলার চার্জশিটও দেয়া হয়। দক্ষিণ সুরমা থানার মামলা না হলেও ওই থানার তৎকালীন ওসি মোরসালিন ক্ষমতার অপব্যবহার করে কোতোয়ালি থানা এলাকা থেকে সাংবাদিক মমতাজকে গ্রেফতার করেন। এরপর আর মোরসালিনকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধাপে ধাপে তিনি সিলেটের গুরুত্বপূর্ণ থানায় ওসির দায়িত্ব পালন করেন।

এক ব্যবসায়ী জানান, মমতাজকে গ্রেফতারের বিষয়টি এসএমপির কোনো কর্মকর্তা জানতেন না। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভ, অসন্তোষ দেখা দিলে এসএমপির কয়েকজন পদস্থ কর্মকর্তা মমতাজকে এভাবে গ্রেফতার করার কারণ ওসি মোরসালিনের কাছে জানতে চান। জবাবে ডিআইজি মিজানের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, ওপরের নির্দেশে করতে হয়েছে।

সিলেটের বেশ কয়েকজন সাংবাদিক অভিযোগ করে বলেন, চৌধুরী মমতাজকে ফাঁসাতে ওসি মোরসালিনকে ব্যবহার করেন ডিআইজি মিজান। মামলার বাদীর সঙ্গে ওসি মোরসালিন ও মিজানুর রহমানের সখ্য ছিল। সাংবাদিকদের ওই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করতে যোগাযোগ করা হয় সংশ্লিষ্ট তরুণীর সঙ্গে। তানিয়া ইয়াছমিন মনি পরিচয়ে মামলা করেন ওই তরুণী। অথচ প্রতিবেদককে তিনি নিজেকে সেলিনা বলে পরিচয় দেন।

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, চৌধুরী মমতাজের বিরুদ্ধে মামলা করার পর থেকে তিনি আর ওই মামলার কোনো খোঁজখবর নেননি। ওই মামলা তিনি চালাতেও চান না। এমনকি মামলা কোন পর্যায়ে আছে তা তিনি জানেনও না। ডিআইজি মিজানুর রহমান ও ওসি মোরসালিনের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন এই রহস্যময়ী তরুণী। ডিআইজি মিজানুর রহমানের অফিসে আসা-যাওয়া ছিল তাও স্বীকার করেন।

মামলা চালাতে চান না কেন জানতে চাইলে বলেন, পরিবার চায় না তাই। অনেকটা আত্মগোপন অবস্থায় মনি ডিআইজি অফিসের কাছে গোটাটিকর কদমতলী জামে মসজিদের পাশে একটি ছোট কসমেটিক্সের দোকান দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রতিবেদকের সঙ্গে মনির কথা হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন মোরসালিন। একপর্যায়ে সিলেটের এক ব্যবসায়ীকে প্রতিবেদকের কাছে পাঠিয়ে সাংবাদিক মমতাজের মামলাটি নিষ্পত্তির আশ্বাস দিয়ে বলেন, আর কোনো নিউজ যাতে না হয়। ডিআইজি স্যার (মিজানুর রহমান) অনেক বিপদে আছে। ওই ব্যবসায়ী ডিআইজি মিজানুর রহমানের সঙ্গেও এ বিষয়ে কথা বলে প্রতিবেদককে নানাভাবে খুশি করার প্রস্তাব দেন।

এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়া অভিযোগে ডিআইজি মিজান উপশহরের যে বাসায় থাকতেন সেখানে ডেকোরেশন বাবদ ৫ লাখ টাকা খরচ করার তথ্য দিয়ে বলা হয়, ‘সম্পূর্ণ টাকা দেন ট্রাফিক পুলিশের একজন সার্জেন্ট। ওই বাসার ভাড়াও দিতেন একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট, যা প্রতি মাসের নজরানা হিসেবে দেয়া হতো। তথ্যানুসন্ধানে বাসা ডেকোরেশনের সত্যতা পাওয়া যায়। বাসার মালিক উস্তার আলী বিষয়টি স্বীকার করেন।

২০১৫ সালের ১১ মে সিলেটে আয়োজিত টি ২০ ক্রিকেট খেলার ডিউটিতে আসা পুলিশ সদস্যদের প্রায় এক কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বলা হয়, বাইরের জেলা থেকে আগত পুলিশ কর্মকর্তারা ডিউটি ভাতা দাবি করলে ডিআইজি মিজান তাদের বলেন, আপা বলেছেন, গণভবনে প্রোগ্রামের চাঁদা হিসেবে ওই টাকা দেয়া হবে। ভয়ে কেউ আর ওই টাকার ভাগ চায়নি। প্রায় কোটি টাকার বেশি তিনি (ডিআইজি মিজান) মেরে দিয়েছেন। এই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন তৎকালীন সময়ে সিলেটে কর্মরত একজন পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যার (ডিআইজি মিজান) সিলেটে যখন যোগদান করার আগে ঢাকার এসপি ছিলেন। ওই পুলিশ নিয়োগে অনেক দুর্নীতি-অনিয়মের তথ্য দিয়ে একটি জাতীয় দৈনিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। ঠিকানা পরিবর্তন করা সদস্যদের অনেককেই তিনি নিয়োগ দিয়েছিলেন। বড় আকারে প্রথম পৃষ্ঠায় এই রিপোর্ট প্রকাশের পর তাকে পদোন্নতি দিয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি করা হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন কমিশনার করে পোস্টিং দেয়া হয়। তাই এসব বলে আর লাভ কি?

এক পর্যায়ে বলেন, সোর্সমানি বা ডিউটি মানির কোনো অডিট হয় না। এগুলোর কোনো প্রমাণ পাবেন না। এর কারণ হচ্ছে- অফিসারদের যে স্বাক্ষর নেয়া হয় তাতে টাকার কোনো অঙ্ক থাকে না। সরল বিশ্বাসে সবাই স্বাক্ষর করে। পরে তিনি (ডিআইজি মিজান) তার মতো করে টাকার অঙ্ক বসান। এটা প্রচলিত। আমি তো আর জিজ্ঞাসা করতে পারি না, স্যার আমাকে কত দিয়েছেন? তবে টি ২০ ক্রিকেট খেলার ডিউটি করে অনেকেই টাকা পাননি, এটা সঠিক। একই সময়ে টি ২০ খেলা হয় চট্টগ্রামে। তখন শফিক স্যার (ডিআইজি শফিক) সবাইকে সম্মানজনক টাকা দেন। আর একমাত্র সিলেটের ক্ষেত্রেই হয়েছে ব্যতিক্রম। নাইনটি ভাগ তিনি (ডিআইজি মিজান) একাই নিয়ে গেছেন। এই টাকার অঙ্ক এক কোটি। অন্যের কিসমত নষ্ট করলে একদিন এর ফল ভোগ করতেই হবে, বলেন সিনিয়র ওই পুলিশ কর্মকর্তা।

অভিযোগের এক জায়গায় বলা হয়, তিনি নিজেকে আওয়ামী লীগের একজন ক্যাডার পরিচয় দিলেও জামায়াত-বিএনপির কাছ থেকে নিয়েছেন সব রকম সুবিধা। এই অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করেন আরেকজন পুলিশ ইন্সপেক্টর।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওই ইন্সপেক্টর বলেন, ডিআইজি মিজান মুখে আওয়ামীপন্থী পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিলেও এক বিএনপি নেতার ঘনিষ্ঠ ৯ মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত এক আসামিকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দেন। ওই নির্দেশ না মানায় সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার ওসির বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে তাকে প্রত্যাহার করেন। পরে জানা গেল জগন্নাথপুরের এক বিএনপি নেতা ডিআইজি মিজানের খুবই ঘনিষ্ঠ। পৌর নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীকে দিয়ে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর থানার ওসি আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করান। তৎকালীন পুলিশ সুপার ও জগন্নাথপুরের ইউএনও এ ঘটনা তদন্ত করেন। তবে ডিআইজি মিজান পুলিশ সুপারকে প্রভাবিত করে আসাদুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দেন। এরপর আসাদুজ্জামানকে প্রত্যাহার করে সিলেটের সবচেয়ে ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী এলাকা জগন্নাথপুর থানার ওসি নিয়োগ দেয়া হয় মো. মোরসালিনকে।

বিষয়টি স্বীকার করে কুষ্টিয়া এসপি অফিসের আরও-ওয়ান আসাদুজ্জামান বলেন, স্যার (ডিআইজি মিজান) মোরসালিনকে প্রাইজ পোস্টিং দেয়ার জন্যই আমার বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগ উত্থাপন করেন। এমনকি এসপি স্যারকে দিয়ে আমার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিতে বাধ্য করেন। সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই এটি করা হয়। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। অথচ আমাকেই তিনি নৌকার জন্য সমস্যা মনে করেন। তিনি বলেন, আমি বিষয়টি লিখিত আকারে পুলিশ সদর দফতরে জানিয়েছিলাম। কিন্তু কোনো তদন্তই হয়নি।

ওই সময়ে সিলেটে কর্মরত রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, ডিআইজি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তার সবই আমি প্রধানমন্ত্রীর দফতর পর্যন্ত পৌঁছানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু তিনি ডিপার্টমেন্টে ছাত্রলীগ কর্মী হিসেবে পরিচিত হওয়ায় সব অভিযোগ ধামাচাপা দেয়া হয়।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি রিপোর্টই স্টেট সিকিউরিটি। এগুলো বাইরে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে যেসব অভিযোগ দেয়া হয় এখন শুধু তার শিরোনামগুলো বলতে পারব।
অভিযোগের শিরোনাম জানতে চাইলে চৌকস ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, নির্বাচনে পুলিশি ডিউটির টাকা, টি ২০ ক্রিকেট বিশ্বকাপে পুলিশ ডিউটির ভাতা, পরিবহনপুল থেকে সার্জেন্টকে ধমক দিয়ে তেল নেয়া, টিভি মডেল কয়েকজনকে নিয়ে চলাফেরা, শিক্ষানবিস এএসপি ও কনস্টেবলদের প্রভাবিত করার অভিযোগ ছিল খুবই দুঃখজনক।

শ্রীমঙ্গলের গ্র্যান্ড সুলতান হোটেলে যাতায়াতের বিষয়টি নিশ্চিত করে ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, শুধু যাতায়াতই নয়, একদিন মদ খেয়ে মাতাল অবস্থায় অন্য আরেক মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চড়ও খেয়েছেন ডিআইজি মিজান। একপর্যায়ে হোটেলের সিকিউরিটিদের পরিচয় দিয়ে জনৈক মহিলার কাছে ক্ষমা চেয়ে রেহাই পান। শুধু তাই নয়, এসএমপির কমিশনার থাকাবস্থায় গ্র্যান্ড সুলতান থেকে সারারাত আড্ডা দিয়ে ফেরার পথে মোগলাবাজারে অন্য আরেক গাড়িকে ধাক্কা দেয়। নিজের সরকারি গাড়ি রেখে প্রাইভেট একটি নোহা মাইক্রো নিয়ে চলাফেরা করতেন ডিআইজি মিজান।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, বাসায় যেসব নারীকে নিয়ে রংতামাশা করতেন তার সবই জানেন উপশহরের বাড়ির মালিক উস্তার আলী। তাকে জিজ্ঞাসা করলেই সব পাবেন।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য চেয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় ডিআইজি মিজানুর রহমানের সঙ্গে। সোমবার বিকালে তার ব্যক্তিগত দুটি মোবাইল নম্বরের একটি বন্ধ পাওয়া যায়। অপরটিতে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে সিলেটে থাকাবস্থায় বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করে ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। এরও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। রাত ৮টার দিকে ফোন করা হয় ডিআইজি মিজানুর রহমানের বেইলি রোডের বেইলি রিজ বাসার ল্যান্ডফোনে। সেটিও রিসিভ করা হয়নি।

পরবর্তী সময়ে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) মো. শহীদুল হকের সঙ্গেও যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তিনি ফোনে কথা বলতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে ফিরতি মেসেজ পাঠান। এরপর পরিচয় দিয়ে আবারও ক্ষুদে বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। রাত ৮টায় এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মুঠোফোনে বলেন, অভিযোগ সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজখবর না নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করবেন না। যুগান্তর।

(জাস্ট নিউজ/ওটি/১১২৪ঘ.)